সূরা আত তাওবা;(২৯তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আত তাওবা;(২৯তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 22:41:17 3-10-1403

সূরা আত তাওবা; আয়াত ১২৭-১২৯

সূরা তাওবার ১২৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন

وَإِذَا مَا أُنْزِلَتْ سُورَةٌ نَظَرَ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ هَلْ يَرَاكُمْ مِنْ أَحَدٍ ثُمَّ انْصَرَفُوا صَرَفَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَفْقَهُونَ

“যখনই কোন সূরা অবতীর্ণ হয় তখন তাদের (মুনাফিকদের)অনেকেই একে অপরের দিকে তাকায় এবং ইশারায় জিজ্ঞাসা করে তোমাদেরকে কি কেউ দেখতে পাচ্ছে? এরপর তারা (আল্লাহর নবীর দরবার থেকে অগোচরে)সরে পড়ে। আল্লাহ তাদের অন্তরকে সত্য বিমুখ করেছেন। কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যাদের বোধশক্তি নেই।"(৯:১২৭)

এই আয়াতটিও মুনাফিকদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে এবং এটা মুনাফিকদের সম্পর্কে সূরা তাওবার শেষ আয়াত। এই আয়াতে বলা হয়েছে,আল্লাহর রাসূলের কাছে যখনই কোনো নতুন আয়াত বা প্রত্যাদেশবাণী অবতীর্ণ হতো, তখন মুনাফিকরা এই ভেবে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো যে, না জানি এই আয়াতে তাদের কোনো কুটিলতার খবর ফাঁস করে দেয়া হয়। তাই নতুন আয়াত নাযিল হতেই তারা সেখান থেকে অন্যদের অগোচরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য একে অন্যকে  বলতো-কেউ আমাদের দেখে ফেলছে না তো?

আয়াতের শেষ অংশে বলা হয়েছে,মুনাফিকরা আল্লাহর রাসূলের মজলিশ ত্যাগ করার কারণ হচ্ছে,বিদ্বেষ,অব্যাধ্যতা ও পাপে তাদের অন্তর  সত্যকে গ্রহণ করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ফলে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং এর সঙ্গে শক্রতা করা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এমনকি তাদের বাস্তব উপলব্ধি ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে।

হ্যাঁ,কুরআনের সাথে দূরত্ব বজায় রাখা এবং ঐশিবাণীর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা মুনাফেকির আলামত। এই দূরত্ব ও অবজ্ঞার ফলে ক্রমেই মানুষের সত্য উপলব্ধির ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং আত্মা হয়ে পড়ে নিস্প্রাণ ও বিপর্যস্ত।

এই সূরার ১২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-

لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ

“তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের কাছে একজন রাসূল এসেছেন, তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তার জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী। মুমিনদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।” (৯:১২৮)

এই আয়াতে নবী করিম (সা.)-এর চারটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে-

এক. রাসূলে খোদাও একজন মানুষ এবং মানবজাতির হেদায়েতের জন্য তিনি প্রেরিত হয়েছেন। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজা-বাদশাহদের মত আচরণ করেন না।

দুই. আল্লাহর নবী মানুষের সমস্যা ও দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে অবহিত এবং তিনি সমাজের একজন হিসেবে অন্যের দুঃখের সমান অংশিদার। সমাজের কেউ দুঃখে পড়লে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনিও তাতে মর্মাহত হন।

তিন. মানুষ সত্য ও সঠিক পথে ফিরে আসুক তিনি সর্বোতভাবে তা কামনা করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি মানুষের সৌভাগ্য ও কল্যাণ প্রত্যাশী। এ ব্যাপারে তাঁর চেষ্টার কোন ক্রটি নেই।

আল্লাহর নবীর চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি মুমিন বিশ্বাসীদের প্রতি অত্যন্ত দয়াদ্র এবং শুভাকাঙ্ক্ষি বলেই তাদেরকে আদেশ নিষেধ করেন। একজন বাবা যেমন সন্তানের মঙ্গলের জন্য কঠিন কর্তব্য নির্ধারণ করে দেন, তেমনি আল্লাহর রাসূলও তার উম্মতকে ভালবাসেন বলেই তাদের করণীয় ও বর্জনীয় দিকগুলো নির্ধারণ করে দেন,যাতে তারা সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভ করতে পারে।

পবিত্র কুরআন ও আল্লাহর নবীর শিক্ষা হচ্ছে ইসলামী সমাজের নেতাদেরকে জনগণের কাতারে অবস্থান করতে হবে। জনগণের ব্যাথায় সমব্যাথী হতে হবে। জনগণের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের কল্যাণের জন্য অকপটে কাজ করা ইসলামী সমাজের নেতাদের প্রধান কাজ।

সূরা তওবার ১২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ

“এরপর তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তুমি বলে দাও,আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ বা উপাস্য নেই। আমি তারই ওপর নির্ভর করি এবং তিনি মহা আরশের অধিপতি।"(৯:১২৯)

সূরা তাওবার সর্বশেষ এই আয়াতে আল্লাহর নবী ও মু'মিন মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে,কিছু লোক যদি সত্য বর্জন করে মুসলমানদের ত্যাগ করে তাহলে তাতে চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ সব সৃষ্টির প্রতিপালক মহান আল্লাহ মুমিন মুসলমানদের সঙ্গে রয়েছেন। বিশ্ব জগতের নিয়ন্তা তিনিই এবং তার কোন শরীক বা সমকক্ষ নেই। কাজেই মুমিন মুসলনাদের উচিত একমাত্র তার ওপর ভরসা করা। কারণ তার পরাক্রম ও শক্তির সঙ্গে কোন শক্তিকেই বিবেচনায় আনা যায় না। আর মহান আল্লাহ মুমিনদেরকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন এবং তাদেরকেই তিনি অফুরন্ত কল্যাণের মাধ্যমে সৌভাগ্যবান করেন।

দোয়া আরাফায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর তাতপর্যমণ্ডিত উক্তিটি থেকে মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসা ও সীমাহীন আস্থাই ফুটে ওঠে। এ দোয়ায় ইমাম হোসাইন (আ.) আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,হে আল্লাহ! যে তোমাকে পায়নি, সে কিছুই পায়নি, আর যে তোমাকে পেয়েছে তার আবার অভাব কিসের!

আল্লাহর ওপর গভীর বিশ্বাস ও আস্থা শক্তিশালী শক্রর বিরুদ্ধে বিজয়কে সহজ করে দেয়। ইসলামের ইতিহাসকে এর বাস্তব দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়। কাজেই সংখ্যায় অবিশ্বাসীদের আধিক্যের কারণে ইসলামের সত্যতার ব্যাপারে সংযমী হওয়া কিংবা হতাশ হয়ে পড়া উচিত নয়; এটা ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য নয়।