সূরা আত তাওবা; আয়াত ৯১-৯৪
সূরা তাওবার ৯১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلَا عَلَى الْمَرْضَى وَلَا عَلَى الَّذِينَ لَا يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوا لِلَّهِ وَرَسُولِهِ مَا عَلَى الْمُحْسِنِينَ مِنْ سَبِيلٍ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“দুর্বল, রুগ্ন ও ব্যয়ভার বহনে অসমর্থ লোকদের জন্য (যুদ্ধে যোগদানে অসমর্থ হওয়ায়) কোন অপরাধ নেই, এই শর্তে যে, যদি আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি তাদের অবিমিশ্র অনুরাগ থাকে। যারা সতকর্মপরায়ণ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো হেতু নেই, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(৯:৯১)
এর আগের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মুনাফিকরা বিভিন্ন বাহানায় জিহাদ বা মুসলমানদের ওপর আরোপিত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকত, আল্লাহ তায়ালা তাদের এই মনোবৃত্তি সম্পর্কে বলেছেন, এটা কুফরী এবং ঈমানহীনতার পরিচায়ক। কিন্তু এই সূরার ৯১ ও ৯২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ-তায়ালা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা অপরিহার্য নয় এমন ব্যক্তিদের একটি তালিকা নির্দেশ করেছেন। নারী ও শিশুদের জন্য স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। এছাড়া শারীরিকভাবে অক্ষম, বিকলাঙ্গ মানুষের উপরও যুদ্ধের নির্দেশ বর্তায় না।
এছাড়া, যুদ্ধে গমন করলে পরিবারের লোকজন অভুক্ত থাকবে এমন আশংকা দেখা দেখা দিলে, একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যুদ্ধ পরিহার করার অনুমতি লাভ করতে পারে।
বর্ণিত হয়েছে, একবার আল্লাহর রাসূলের ভীষণ অনুরাগী এক অন্ধ সাহাবী এসে আরজ করলেন, হে রাসূলে খোদা, আমি এক অন্ধ ও অক্ষম, যুদ্ধের ময়দানে কেউ আমার হাত ধরে নিয়ে যাবে এমন লোকও আমার নেই। এ অবস্থায় আমার কর্তব্য কি?
অন্ধ সাহাবীর কথা শুনে রাসূলে করিম (সা.) কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এরপরই সূরায়ে তাওবার ৯১ নম্বর আয়াতটি নাযিল হয়।
এই আয়াত থেকে আমরা এটা বুঝতে পারি যে, ইসলামের নির্দেশ মানুষের শক্তি ও সামর্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সামর্থের বাইরে কোন নির্দেশ ইসলাম মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয় না। যদি কোন কাজ কারো পক্ষে আঞ্জাম দেয়া আসলেই অসম্ভব হয়। তাহলে ইসলামী আইন তাকে সে কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়।
এই সূরার ৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَا عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُوا مَا يُنْفِقُونَ
“তাদের কোনো অপরাধ নেই যারা তোমার নিকট বাহনের জন্য আসলে তুমি বলেছিলে, তোমাদের জন্য কোনো বাহন আমি পাচ্ছি না। তার জিহাদে ব্যয় করতে অসামর্থজনিত দুঃখে অশ্রুসজল চোখে ফিরে গেল।"(৯:৯২)
সূরা তওবার ৯১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, দুর্বল, রুগ্ন ও ব্যয়ভার বহনে অসমর্থ এই তিনদল যুদ্ধ গমনের ব্যাপারে অব্যাহতি পেতে পারে। এই আয়াতে চতুর্থ আরেকটি দলের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, শারীরিক বা স্বাস্থ্যগত দিক থেকে স্বচ্ছল এবং পারিবারিক সমস্যা থেকে মুক্ত থাকা সত্ত্বেও যদি কারো যুদ্ধাস্ত্র বা যুদ্ধের বাহন না থাকে তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র তার জন্যে যুদ্ধাস্ত্র বা যুদ্ধের বাহন সরবরাহ করবে, কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র যদি তা যোগাড় করতে না পারে ঐ ব্যক্তিকেও ইসলাম যুদ্ধে গমনের ব্যাপারে অব্যহতি দিয়েছে।
তবে তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদদের মত পুরস্কার পাবেন। কারণ তারা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন এবং যুদ্ধে যেতে না পেরে দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়েছিলেন।
এই আয়াতের শানে নযুল হচ্ছে,৭ জন দরিদ্র আনসার সাহাবী,আল্লাহর রাসূলের কাছে এসে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাহনের আবেদন জানান। কিন্তু অতিরিক্ত বাহন না থাকায় নবী করিম (সা.)তাদেরকে না সূচক জবাব দেন। ফলে তারা জিহাদে অংশগ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় অত্যন্ত দুঃখ নিয়ে এবং অশ্রুসজল চোখে রাসূলে খোদার কাছ থেকে বিদায় নেন।
তাবুক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় মদিনার কাছাকাছি এসে আল্লাহর রাসূল এই দলকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,কিছু লোক মদিনায় থেকে গেলেও প্রকৃতপক্ষে তারা তোমাদের মতই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীর মর্যাদা পাবে। কারণ তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিল। কিন্তু বাহন বা অন্যান্য অসামর্থজনিত কারণে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।
মানুষের নিয়্যত বা মনের অভিপ্রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মের প্রতি ভালোবাসা ও ধর্মীয় উদ্দীপনার গুরুত্বই সর্বাধিক। কাজেই আল্লাহ ও রাসূলের অনুরাগী ঈমানদাররা যুদ্ধে না যেতে পেরে দুঃখিত হন,নিরবে কাঁদেন। কিন্তু মুনাফিকরা এমন নয়,তারা যুদ্ধ থেকে পালাতে পারলে আনন্দিত হয়।
সূরা তওবার ৯৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّمَا السَّبِيلُ عَلَى الَّذِينَ يَسْتَأْذِنُونَكَ وَهُمْ أَغْنِيَاءُ رَضُوا بِأَنْ يَكُونُوا مَعَ الْخَوَالِفِ وَطَبَعَ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
“তাদের ক্ষেত্রেই অভিযোগের হেতু রয়েছে,যারা অভাবমুক্ত বা সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও তোমার কাছে অব্যাহতি প্রার্থনা করে এবং যারা পেছনে পড়ে থাকা বা ঘরে বসে থাকা লোকদের সাথে থাকতে পেরে আনন্দিত হয়েছে। আর আল্লাহ মোহর এঁটে দিয়েছেন তাদের অন্তরসমূহে ফলে তারা বুঝতে পারে না।" (৯:৯৩)
এই আয়াতে সমাজের বিত্তবান ও প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে যারা নিজেদের সম্পদ হারানোর আশংকায় ইসলামের শক্রদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে কিংবা মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে অংশ নিতে চায় না এবং এজন্য তারা নানা অজুহাত বা বাহানা খাঁড়া করার চেষ্টা করে, বস্তুগত ভোগ বিলাসিতার কারণে তাদের অন্তর এতটাই নিষ্প্রাণ ও নির্জীব হয়ে পড়েছে যে সত্য উপলব্ধি করার ক্ষমতাই হারিয়ে গেছে। ফলে তারা সমাজের অক্ষম ব্যক্তিদের মত নিষ্ক্রিয় বসে থাকাতেই আনন্দ পায়।
দায়িত্ব ও কর্তব্য পালেনে নির্লিপ্ত থাকা বা অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে চুপ করে বসে থাকার নীতিকে ইসলাম সমর্থন করে না, এই ভুল মনোভাবের পরিণতিতে মানুষ সত্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা ও বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে।
এবার সূরা তওবার ৯৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يَعْتَذِرُونَ إِلَيْكُمْ إِذَا رَجَعْتُمْ إِلَيْهِمْ قُلْ لَا تَعْتَذِرُوا لَنْ نُؤْمِنَ لَكُمْ قَدْ نَبَّأَنَا اللَّهُ مِنْ أَخْبَارِكُمْ وَسَيَرَى اللَّهُ عَمَلَكُمْ وَرَسُولُهُ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَى عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
“যখন তোমরা জিহাদের ময়দান থেকে ফিরে আসবে তখন যুদ্ধ ত্যাগকারীরা তোমাদের কাছে অজুহাত পেশ করবে। বলে দাও, অজুহাত পেশ করো না। আমরা তোমাদেরকে কখনোই বিশ্বাস করবো না, আল্লাহ আমাদেরকে তোমাদের অবস্থা অবহিত করে দিয়েছেন, আল্লাহ ও তার রাসূল (এই পৃথিবীতে) তোমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করবেন, তারপর (পরকালে) তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে গোপন ও অগোপন বিষয়ে জ্ঞাত সেই সত্ত্বার নিকট, তিনিই তোমাদেরকে বাতলে দেবেন যা তোমরা করেছিলে।” (৯:৯৪)
বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, অন্তত ৮০ জন মুনাফিক তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে মদিনায় থেকে যায়, কিন্তু মুসলমানরা যখন যুদ্ধ শেষে মদিনায় ফিরে আসেন তখন তারা যুদ্ধে না যাওয়ার নানা কারণ ব্যাখ্যা দেখার চেষ্টা করতে থাকে। এ অবস্থায় এই আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং তাদের অজুহাত এবং ব্যাখ্যায় কর্ণপাত না করার জন্য মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়, যাতে মুনাফিকরা এই ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ না করে যে, মুসলমানদেরকে তারা ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছে এবং তারা মুসলিম বাহিনীর বিজয়ের অংশীদার।
এই আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, যারা ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে না, তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত; যাতে তাদের পরিণতি থেকে অন্যরাও শিক্ষা নিতে পারে।