সূরা আত তাওবা; (১৮তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আত তাওবা; (১৮তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 20:28:30 3-10-1403

সূরা আত তাওবা; আয়াত ৭৪-৭৯

সূরা তাওবার ৭৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ مَا قَالُوا وَلَقَدْ قَالُوا كَلِمَةَ الْكُفْرِ وَكَفَرُوا بَعْدَ إِسْلَامِهِمْ وَهَمُّوا بِمَا لَمْ يَنَالُوا وَمَا نَقَمُوا إِلَّا أَنْ أَغْنَاهُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ مِنْ فَضْلِهِ فَإِنْ يَتُوبُوا يَكُ خَيْرًا لَهُمْ وَإِنْ يَتَوَلَّوْا يُعَذِّبْهُمُ اللَّهُ عَذَابًا أَلِيمًا فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَمَا لَهُمْ فِي الْأَرْضِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ

“(মুনাফিকরা)আল্লাহর নামে শপথ করে বলে যে, তারা (মন্দ) কেন কিছু বলেনি, অথচ নিঃসন্দেহে তারা কুফরিতুল্য বাক্য বলেছে এবং মুসলমান হওয়ার পর তারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী বা কাফেরে পরিণত হয়েছে। তারা এমন কাজের সংকল্প নিয়েছিল যা বাস্তবায়িত হয়নি। আল্লাহ ও তার রাসূল নিজ কৃপায় তাদেরকে অভাবমুক্ত করেছিলেন। কিন্তু তারা কৃতজ্ঞ না হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ হয়েছিল। তারা তওবা করলে তা তাদের জন্য মঙ্গল হবে, কিন্তু তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহ ইহলোক ও পরলোকে তাদের মর্মন্তুদ শাস্তি দেবেন। তারা পৃথিবীতে কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী এবং সাহায্যকারী পাবে না।” (৯:৭৪)

এই আয়াতে মুনাফিকদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, তাদের কুফরিতুল্য কথাবার্তার কারণে মুসলমান দাবি করার অধিকার বা যোগ্যতাও তারা হাতছাড়া করেছে। আল্লাহর রাসূলের কাছে গিয়ে তারা কসম বা শপথ করে বলতো আমরা আসলে কিছুই বলিনি। কিন্তু আল্লাহতালা তাদের মনের সব কিছুই তার নবীকে জানিয়ে দেন। মুনাফিক চরিত্রের এসব মানুষ শুধু যে উল্টোপাল্টা কথা বলে বেড়াতো তাই নয় বরং তাদের একটি দল নবী করিম (সা.)কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল।

এই আয়াতের শেষভাগে বলা হয়েছে, মুনাফিকরা মনে মনে কেন মুসলমান এবং আল্লাহর রাসূলের ব্যাপারে এত বিদ্বেষ পোষণ করে? তারা কেন মুসলমানদের ক্ষতি করতে চায়? তারা কি ইসলাম গ্রহণের কারণে বৈষয়িক দিক থেকে লাভবান হয়নি? যুদ্ধলব্ধ গণিমতের মালের ভাগ কি তাদেরকে দেয়া হয়নি?

এই আয়াত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, মিথ্যা কসম বা মিথ্যা শপথ করে কথা বলা কপটতা বা মুনাফিকির লক্ষণ। মুমেন মুসলমানদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। মুনাফিকদের এ ধরনের নোংরা স্বভাবের কারণে এই পৃথিবীতেই তাদের ওপর ঐশি শাস্তি নেমে আসে। উদ্ভ্রান্ত অবস্থা এবং মানসিক অশান্তির মত বিষয়গুলো হচ্ছে এসব ঐশি শাস্তির অন্যতম।

এই সূরার ৭৫ ও ৭৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمِنْهُمْ مَنْ عَاهَدَ اللَّهَ لَئِنْ آَتَانَا مِنْ فَضْلِهِ لَنَصَّدَّقَنَّ وَلَنَكُونَنَّ مِنَ الصَّالِحِينَ (75) فَلَمَّا آَتَاهُمْ مِنْ فَضْلِهِ بَخِلُوا بِهِ وَتَوَلَّوْا وَهُمْ مُعْرِضُونَ

“তাদের মধ্যে অনেকেই আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, তিনি যদি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন, তাহলে অবশ্যই আমরা সাদাকা প্রদান করব এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে থাকব।” (৯:৭৫)

“অতঃপর যখন তিনি তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহের মাধ্যমে দান করলেন, তখন তাতে তারা কার্পণ্য করেছে এবং (অঙ্গীকার) ভঙ্গ করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।” (৯:৭৬)

আগের আয়াতে মুনাফিকদের কৃতঘ্ন আচরণের জন্য তিরস্কার করা হয়েছে। এই আয়াতে তাদের অকৃতজ্ঞতার আরেকটি প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, একবার মদিনার এক মুসলমান নবী করিম (সা.)এর কাছে এসে আর্জি পেশ করলো যে, হে আল্লাহর রাসূল আপনি দোয়া করে দিন, আল্লাহতা’লা যেন আমার ধন-সম্পদ আরো বাড়িয়ে দেন। আসূলে খোদা (সা.) তাকে বললেন, কৃতজ্ঞতা আদায় করা অসাধ্য এমন অপরিমিত সম্পদের চেয়ে পরিমিত সম্পদ অনেক উত্তম। কারণ এর কৃতজ্ঞতা আদায় করা সম্ভবপর।

আল্লাহর রাসূলের এই কথা শুনে লোকটি বললো, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আল্লাহপাক যদি আমাকে দান করেন তাহলে আমি অবশ্যই তার যাকাত এবং সাদাকা প্রদান করবো। এরপর বিশ্বনবী (সা.)এর দোয়ার বরকতে লোকটির সম্পদ দিন দিন বৃদ্ধি পেল, এরপর দেখা গেল লোকটি এতবেশি সম্পদশালী হয়েছে যে, নামাজের জামাতেও আসতে পারছেন না। এক পর্যায়ে তার কাছে যাকাতের জন্য লোক পাঠানো হলে সে যাকাত দিতে অস্বীকার করে বসলো। কাজেই কৃতজ্ঞতা, নিয়ামতের স্বীকৃতি দান ও প্রতিশ্রুতি পুরনের মত চারিত্রিক গুণাবলী মুনাফিকদের মধ্যে অনুপস্থিত।

মানুষের যদি যোগ্যতা না থাকে অর্থাত কেউ যদি উপযুক্ত না হয় তাহলে ঐশি কল্যাণও তার জন্য অমঙ্গল হয়ে দেখা দেয়। অকৃতজ্ঞ ও ওয়াদা ভঙ্গকারীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় ধন-সম্পদের প্রাচুর্য তাদের জন্য প্রশান্তিদায়ক হয় না। এগুলো তাদের জন্য অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া আল্লাহতালা ধনি মানুষের সম্পদে গরীবের অধিকার নির্ধারণ করেছেন। কাজেই যারা গরীবের এই অধিকার আদায় করে না, তাদের জন্য এই ধন-সম্পদই অকল্যাণ ও অশান্তির উপাদান হয়ে দেখা দেয়।

এই সূরার ৭৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَأَعْقَبَهُمْ نِفَاقًا فِي قُلُوبِهِمْ إِلَى يَوْمِ يَلْقَوْنَهُ بِمَا أَخْلَفُوا اللَّهَ مَا وَعَدُوهُ وَبِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ

“আল্লাহর সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা এবং মিথ্যা বলার পরিণতিতে তাদের অন্তরে কপটতা বদ্ধমূল হয়ে গেল, সেদিন পর্যন্ত যেদিন তারা আল্লাহর সাথে মিলিত হবে।” (৯:৭৭)

প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা এবং মিথ্যা বলার অভ্যাস মানুষ এবং ঈমানের মধ্যে ব্যবধান গড়ে তোলে। ফলে মানুষ বেইমান এবং মুনাফিকে পরিণত হয়। ইসলামের প্রথম যুগেও বহু মানুষ যারা ঈমান এনেছিল এবং নবী করিম (সা.)এর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়েছিল তারাও এসব কুস্বভাবের কারণে পবিত্র ঈমান হেফাজত করতে সফল হতে পারেনি।

আসলে মুখ এবং আচরণে যদি কপটতা থাকে তাহলে এক সময় মানুষের অন্তর ও স্বভাব কপটতায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। দরিদ্র এবং অসহায়-নিঃস্ব মানুষকে দান করার ব্যাপারে যারা কার্পণ্য করে তারা দুনিয়ার জীবনেই অশান্তি ও দুঃখ-যাতনায় নিষ্পেষিত হয়। এ জন্য আল্লাহর অনুগ্রহের ব্যাপারে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।

সূরা তাওবার ৭৮ ও ৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ سِرَّهُمْ وَنَجْوَاهُمْ وَأَنَّ اللَّهَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ (78) الَّذِينَ يَلْمِزُونَ الْمُطَّوِّعِينَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ فِي الصَّدَقَاتِ وَالَّذِينَ لَا يَجِدُونَ إِلَّا جُهْدَهُمْ فَيَسْخَرُونَ مِنْهُمْ سَخِرَ اللَّهُ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“তারা কি জেনে নেয়নি যে, আল্লাহ তাদের রহস্য ও গোপন শলা-পরামর্শ সম্পর্কে অবহিত এবং যা অদৃশ্য তা তিনি বিশেষভাবে জানেন?” (৯:৭৮)

“মুমিনদের মধ্যে যারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে সাদাকা দেয় এবং মুমিনদের মধ্যে যাদের পরিশ্রমলব্ধ সামান্য বস্তুছাড়া দান করার কিছু নেই তাদেরকে নিয়ে যেসব মুনাফিক দোষারোপ এবং বিদ্রুপ করে, আল্লাহও তাদেরকে বিদ্রুপ করেন তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।” (৯:৭৮)

আগের আয়াতে বলা হয়েছে, মুনাফিকরা যাকাত এবং সাদাকা প্রদানের ব্যাপারে কার্পণ্য করতো। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, মুনাফিকরা যে শুধু নিজেরা যাকাত-সাদাকা দান থেকে বিরত থাকত তাই নয় বরং মুমিনদের মধ্যে যারা যাকাত প্রদানের পরও যুদ্ধ কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনের সময় আর্থিক সাহায্য প্রদান করত, মুনাফিকরা তাদেরকে উপহাস করে বলতো লোক দেখানোর জন্য এরা এসব করছে। আবার অপেক্ষাকৃত গরীব ঈমানদাররা তাদের সামর্থ অনুযায়ী যে যত-সামান্য সাহায্য নিয়ে আসতো তারা তা দেখে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে বলত এই সামান্য সাহায্যের তো কোনো মূল্যই নেই।

পবিত্র কুরআন মুনাফিকদের এই নোংরা আচরণের জবাবে বলেছে, তারা কি জানে না যে, আল্লাহতা’লা কাফেরদের মনের সকল অভিপ্রায় জানেন এবং তাদের গোপন শলা-পরামর্শের ব্যাপারেও তিনি খবর রাখেন? কাজেই তাদের জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহতা’লা সময়মত তাদের উপযুক্ত প্রতিদান দেবেন। আর প্রতিদান হবে অত্যন্ত কঠিন ও বেদনাদায়ক।

ঈমানদার মুসলমানদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা মুনাফিকির লক্ষণ। কাজেই মুসলমানদের উচিত নিজেরা কোনো ভালো কাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ না পেলেও অন্যের কাজ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা না করা।

এই আয়াত থেকে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্রত্যেকের সামর্থ অনুযায়ী তার দায়িত্ব নির্ধারিত হয়। ফলে দানের পরিমাণের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে নিয়তের ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ।