সূরা আত তাওবা; আয়াত ৬৬-৬৯
সূরা তাওবার ৬৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ إِنْ نَعْفُ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْكُمْ نُعَذِّبْ طَائِفَةً بِأَنَّهُمْ كَانُوا مُجْرِمِينَ
“(হে মুনাফিকরা!) ছলনার আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা কর না, তোমরা ঈমান আনার পর কাফের হয়ে গেছ। তোমাদের মধ্যে কোনো দলকে ক্ষমা করে দিলেও অন্য দলকে শাস্তি দেব। কারণ তারা অপরাধী।” (৯:৬৬)
আগের কয়েকটি আয়াতে নবী করিম (সা.) এবং মুমিন মুসলমানদের সঙ্গে মুনাফিকদের অসদাচরণের কিছু দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। এই আয়াতে মুনাফিকদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, মুমিনদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে কিংবা ইসলামের অবমাননা করে তা হাল্কাভাবে দেখানোর কোনো উপায় নেই। কারণ ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে কৌতুক তামাশা করার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই মজা করার জন্য কিংবা স্রেফ কৌতুকের বশবর্তী হয়ে আল্লাহর রাসূল বা মুমিনদেরকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা এক ধরনের কুফরী। আয়াতটির পরের অংশে বলা হয়েছে, যারা না জেনে অজ্ঞতার কারণে এমন গর্হিত কাজ করে ফেলেছে, আল্লাহ হয়তো তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু ইচ্ছাকৃত এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে যারা এ ধরনের কাজ করবে তাদেরকে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ঐশি বিধান বা ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপারে ঠাট্টা-বিদ্রুপ এমনকি কৌতুক করা বা হাসি তামাশা করা কুফরীর সমতুল্য এবং এর পরিণতি ভালো নয়। তবে এই আয়াতে এটাও বলা হয়েছে যে, যারা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এ ধরনের কাজ করে এবং যারা নেহায়েত না জেনে না বুঝে এটা করে ফেলে তাদের উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কাজেই প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পাবে এবং নিরিহ মানুষরা শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাবে।
এই সূরার ৬৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُمْ مِنْ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنْكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْ نَسُوا اللَّهَ فَنَسِيَهُمْ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
“মুনাফিক নর ও নারী একের অপরের অনুরূপ। তারা অসতকর্মের নির্দেশ দেয় এবং সতকর্মের ব্যাপারে নিষেধ করে, তারা (আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়ের ব্যাপারে) হাতবদ্ধ করে রাখে। তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে আল্লাহও তাদেরকে ভুলে গেছেন, নিঃসন্দেহে মুনাফিকরা ফাসেক বা পাপাচারী।” (৯:৬৭)
মুনাফিকদের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কয়েকটি হচ্ছে, তারা ঈমানদার মুসলমানদেরকে অবজ্ঞা করে, তাদের ভাল কাজ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে, পাপাচারীদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাদের কাজকর্মকে আদর্শ ও আধুনিক বলে মনে করে। মুনাফিক বা কপট চরিত্রের মানুষের এসব আচরণের ফলে সমাজের অন্যান্য মানুষ ভালো কাজের ব্যাপারে নিরুতসাহিত হয় এবং অসত কাজের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হয়। এ ছাড়া, মুনাফিকরা যেহেতু কেয়ামতের ব্যাপারে খুব বেশি আস্থাশীল নয় তাই আল্লাহর রাস্তায় দান করার ব্যাপারেও তাদের আগ্রহ নেই। তাদের ব্যাপারে এই আয়াতের শেষভাগে উপযুক্ত মূল্যায়ন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, তাই আল্লাহও তাদেরকে ভুলে গেছেন। এখানে আল্লাহর ভুলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণে তারা বহু নেয়ামত এবং বিশেষ কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়াকে বুঝানো হয়েছে।
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, সমাজকে ভালো বা মন্দের দিকে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া, এই আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, মানুষের কৃতকর্ম অনুযায়ী ঐশি শাস্তি বা পুরস্কার নির্ধারিত হয়ে থাকে। মানুষ যদি আল্লাহকে ভুলে যায় তাহলে তিনিও এসব বিভ্রান্ত মানুষকে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন।
সূরা তাওবার ৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَعَدَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا هِيَ حَسْبُهُمْ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُقِيمٌ
“মুনাফিক নর-নারী ও কাফিরদেরকে আল্লাহ জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যেখানে তারা স্থায়ীভাবে থাকবে। এটাই তাদের জন্য যথেষ্ট এবং আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেছেন। তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী শাস্তি।” (৯:৬৮)
আগের আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের ধর্ম অবমাননাকে কুফরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই আয়াতে মুনাফিকদেরকে কাফিরদের কাতারে অন্তর্ভূক্ত করে বলা হয়েছে, মুনাফিকরাও কাফেরদের মত জাহান্নামের অধিবাসী হবে এবং সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। এ ছাড়া, তাদের ওপর বর্ষিত হবে আল্লাহর অভিসম্পাত।
এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, কপট-মুনাফিকরা পৃথিবীতে মুসলমান নাম ধারণ করে মুসলিম সমাজের অংশ হিসেবে জাহির করলেও আসলে কেয়ামতের দিন তাদের স্থান হবে কাফিরদের কাতারে।
এই সূরার ৬৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
كَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ كَانُوا أَشَدَّ مِنْكُمْ قُوَّةً وَأَكْثَرَ أَمْوَالًا وَأَوْلَادًا فَاسْتَمْتَعُوا بِخَلَاقِهِمْ فَاسْتَمْتَعْتُمْ بِخَلَاقِكُمْ كَمَا اسْتَمْتَعَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ بِخَلَاقِهِمْ وَخُضْتُمْ كَالَّذِي خَاضُوا أُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ
“তোমরাও (মুনাফিকরা) তোমাদের পূর্ববর্তীদের মত, যারা শক্তিতে তোমাদের চেয়ে প্রবল ছিল এবং যাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি ছিল তোমাদের চেয়ে অধিক এবং তারা তাদের ভাগ্যে যা ছিল তা ভোগ করেছে। তোমাদের ভাগ্যে যা ছিল তোমরাও তা ভোগ করেছ, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ভাগ্যে ছিল। আর তোমরাও বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়েছ যেমনি তারাও নিমজ্জিত হয়েছিল। তাদের কর্ম ইহলোক ও পরলোকে ব্যর্থ এবং তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।” (৯:৬৯)
এই আয়াতে ইতিহাসে মুনাফিকদের কপটতা ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, মুনাফিকদের এটা ভাবা উচিত নয় যে তারা খুব চালাক এবং তারা ঈমানদার মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়েছে। তারা ধর্মের লেবাস পরে যা খুশি তাই করতে পারে। তাদের আগেও যারা এমন চরিত্রের অধিকারী ছিল তারা ধনে-সম্পদে ও বৈষয়িক অন্যান্য দিক থেকে আরও শাক্তিশালী ছিল। কিন্তু কোনো কিছুই তাদেরকে রক্ষা করতে পারেনি। অত্যন্ত অপমান ও অপদস্থ হয়ে তাদেরকে এ দুনিয়া ছাড়তে হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, খালি হাতে তাদেরকে কিয়ামতের দিন হাজির হতে হবে।
দুনিয়ার জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, তাই দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয়া হলে ক্ষতি ছাড়া আর কিছু অর্জন করা যাবে না। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তার দ্বীনের ব্যাপরে আন্তরিক হওয়ার তাওফিক দান করুন।