সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৯৩-১৯৬
সূরা আল আ'রাফের ১৯৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِنْ تَدْعُوهُمْ إِلَى الْهُدَى لَا يَتَّبِعُوكُمْ سَوَاءٌ عَلَيْكُمْ أَدَعَوْتُمُوهُمْ أَمْ أَنْتُمْ صَامِتُونَ
"তোমরা যদি তাদের (তথা সেইসব শরীক উপাস্যদের দিকে ডাক) সুপথের দিকে ডাক তারা তা মান্য করবে না। তোমরা তাদের আহ্বান কর অথবা চুপ করে থাক, তোমাদের জন্য উভয়ই সমান।" (৭:১৯৩)
আগের আয়াতের আলোচনায় আমরা বলেছি, কোনো কোনো বাবা-মা তাদের সন্তানকে আল্লাহর পরিবর্তে কল্পিত কিছু উপাস্যের দিকে আহ্বান করত। অথচ সন্তানাদি আল্লাহরই দেয়া আমানত মাত্র। এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, তোমরা যাদের পথ-নির্দেশক বলে মনে করছ তাদেরকে যদি হেদায়াত বা সুপথ দেখাতে বল তাহলে তারা তা পারবে না। কারণ, তাদের সেই ক্ষমতাসহ কোনো ক্ষমতাই নেই। তাদেরকে আহ্বান কর বা দাওয়াত দাও কিংবা নীরব থাক তাতে তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। এ বিশ্বে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোই স্বাধীন কোনো ক্ষমতা নেই। কোনো অস্তিত্বই আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় ক'টি দিক হল:
এক. নির্জীব বস্তুকে তো দূরের কথা আল্লাহর বান্দা বা মানুষকেও উপাস্য মনে করার কোনো অজুহাত বা যুক্তি নেই। জড় পদার্থ বা বস্তু কোনো কিছুই করতে সক্ষম নয়।
দুই. প্রভু বা উপাস্যের কাছ থেকে মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা বা দাবি হল সুপথ তথা সৌভাগ্যের পথ-নির্দেশনা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই তা দেখাতে সক্ষম নয়।
সূরা আল আরাফের ১৯৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ فَادْعُوهُمْ فَلْيَسْتَجِيبُوا لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ
"আল্লাহ্ ছাড়া তোমরা যাদের ডাক, নিশ্চয়ই তারা তোমাদের মত [আল্লাহ্র] দাস। যদি তোমরা [প্রকৃতই] সত্যবাদী হও তবে তাদের আহ্বান কর এবং তারা তোমাদের আহ্বানে সাড়া দিক।" (৭:১৯৪)
আগের আয়াতের বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, সব মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি ও দাস। তাদের সবাইই আল্লাহর দয়া ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী। কোনো মানুষের ওপরই অন্য মানুষের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তাই তোমরা কেন অন্য মানুষকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করছ ও তাদের কাছে সাহায্য চাইছ? তোমরা কি মনে কর যে তাদের নিজস্ব বা স্বাধীন কোনো ক্ষমতা আছে? যদি তেমন কোনো ক্ষমতা তাদের আছে বলে মনে কর তাহলে তাদের কাছে গিয়ে তোমাদের চাহিদাগুলো পূরণ করতে বল। আর এভাবে দেখ যে তারা তোমাদের আহ্বানে সাড়া দেয় কিনা।
এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:
এক. উপাস্যকে অবশ্যই উপাসনাকারীর চেয়ে বড় হতে হবে। মানুষ তারই মত আরেক মানুষের উপাসনা করবে- এর কোনো যুক্তি নেই।
দুই. মাবুদ বা উপাস্যকে মানুষের চাহিদাগুলো পূরণে সক্ষম হতে হবে। আল্লাহ ছাড়া আর কেউই মানুষের চাহিদাগুলো পূরণ করতে সক্ষম নয়।
সূরা আল আ'রাফের ১৯৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
َلَهُمْ أَرْجُلٌ يَمْشُونَ بِهَا أَمْ لَهُمْ أَيْدٍ يَبْطِشُونَ بِهَا أَمْ لَهُمْ أَعْيُنٌ يُبْصِرُونَ بِهَا أَمْ لَهُمْ آَذَانٌ يَسْمَعُونَ بِهَا قُلِ ادْعُوا شُرَكَاءَكُمْ ثُمَّ كِيدُونِ فَلَا تُنْظِرُونِ
"তোমরা যে মূর্তিগুলোর পূজা করছ সেগুলোর কি চলার জন্য পা আছে? বা ধরার জন্য হাত, অথবা দেখার জন্য চোখ? অথবা শোনার জন্য কান? [হে মুহাম্মদ] বল, "তোমাদের কল্পিত [আল্লাহ্র] শরীকদের ডাক। আমার বিরুদ্ধে [তোমাদের নিকৃষ্টতম] ষড়যন্ত্র কর এবং আমাকে কোন সুযোগ দিও না।" (৭:১৯৫)
আগের আয়াতে মানুষ হয়েও অন্য আরেক মানুষকে উপাস্য সাব্যস্ত করার সমালোচনা করা হয়েছে। এ আয়াতে মানুষের চেয়েও অক্ষম বস্তু তথা কাঠ ও পাথরের মত জড় বস্তুকে উপাস্য মনে করার অযৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে। আর আল্লাহ বলছেন, এসব বস্তুর না হাঁটার ক্ষমতা আছে, না আছে বলার, দেখার বা শোনার ক্ষমতা। এরা প্রাণহীন মূর্তি কিংবা দেয়ালে অথবা কাপড়ে আঁকা ছবির মতই নিষ্প্রাণ।
যারা এইসব বস্তুকে বা মূর্তিকে উপাস্য বলে মনে করে তাদের এই কুসংস্কারাচ্ছন্নতা তথা উদাসীনতার ঘুম থেকে জাগানোর জন্য আল্লাহ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে বলছেন, আপনি তাদের বলুন, হে মুশরিকরা, মুসলমানদের নির্মূল করার জন্য যত ইচ্ছা কঠিনতম ষড়যন্ত্র করতে মূর্তিগুলোর প্রতি আহ্বান জানাও যাতে সবাই এটা দেখতে পারে যে তাদের কোনো কিছুই করার ক্ষমতা নেই।
এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার:
এক. নবী-রাসূলরা আল্লাহর প্রতি এত গভীর ঈমান রাখতেন যে তারা অত্যন্ত শক্তিমত্তা ও সাহস নিয়ে শত্রুদেরকে লড়াইয়ের জন্য আহ্বান জানাতেন যাতে তাদের অক্ষমতা মানুষের কাছে তুলে ধরা যায়।
দুই. মুশরিকরা নবী-রাসূলদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করত। তারা বলত, এ তো আমাদের মতই মানুষ। অথচ তারা নিজেদের চেয়েও দুর্বল ও অক্ষম নিষ্প্রাণ মূর্তির উপাসনা করার মত অবমাননা মেনে নিত।
সূরা আল আরাফের ১৯৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّ وَلِيِّيَ اللَّهُ الَّذِي نَزَّلَ الْكِتَابَ وَهُوَ يَتَوَلَّى الصَّالِحِينَ
"(হে নবী আপনি বলুন) আমার সহায় তো হলেন আল্লাহ, যিনি এই কিতাব তথা কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। বস্তুত; তিনিই সাহায্য করেন সৎকর্মশীল বান্দাদের।" (৭:১৯৬)
আগের আয়াতে মিথ্যা উপাস্যদের অক্ষমতা ও দুর্বলতাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)-কে আল্লাহর এ পরিচয় তুলে ধরতে বলা হয়েছে যে, আমি মানুষের বা জড় বস্তুর উপাসনার পরিবর্তে একমাত্র আল্লাহর কর্তৃত্বকেই গ্রহণ করেছি এবং তাঁকেই আমার অভিভাবক বলে মনে করি। তিনি আমার কাছে প্রত্যাদেশ বা ওহী নাজেল করেন। আর এইসব আল্লাহরই আয়াত বা নিদর্শন। তিনি পবিত্র ও সতকর্মশীল মানুষকে সুপথ দেখিয়ে থাকেন এবং তিনি তাদের অভিভাবক।
এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষা হল:
এক. আল্লাহর কাছে সালেহ বা সত বান্দাদের রয়েছে উচ্চ মর্যাদা। কুরআনে নবী-রাসূলদের সালেহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুই. সত্যের পথ অনুসরণে ভয় করা উচিত নয়। আল্লাহ সত্যের পথিকদের সহায়তা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনিই তাদের অভিভাবক।
তিন-আল্লাহ মানুষকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি দেয়ার পাশাপাশি সেগুলো বাস্তবায়নেও তাদের সহায়তা করেন।