সূরা আ'রাফ; (৪২তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আ'রাফ; (৪২তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 18:45:24 3-10-1403

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৮৪-১৮৭

সূরা আল আ'রাফের ১৮৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

أَوَلَمْ يَتَفَكَّرُوا مَا بِصَاحِبِهِمْ مِنْ جِنَّةٍ إِنْ هُوَ إِلَّا نَذِيرٌ مُبِينٌ

"(মক্কার লোকেরা) কি এটা চিন্তা করে না যে তাদের সহচর কোনো ধরনের উন্মাদ নন এবং তিনি একজন প্রকাশ্য সতর্ককারী।" (৭:১৮৪) 

যুগে যুগে একদল সৎ ও পবিত্র মনের মানুষ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণের বক্তব্য মেনে নিয়ে ঈমান এনেছে। কিন্তু অন্য এক দল মানুষ গোঁড়ামি ও দাম্ভিকতার কারণে সত্যকে অস্বীকার করতো। এ আয়াতে বলা হচ্ছে- যারা ইসলামের নবীকে অস্বীকার করার জন্যে তাকে  জিনের মাধ্যমে প্রভাবিত বা জিনগ্রস্ত বলতো এবং যারা বলতো ইসলামের নবী কিছুটা উন্মাদ বা পাগল হয়ে গেছেন বলেই সৃষ্টিকুলের শুরু ও শেষ সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলছেন, তারা এর আগে চল্লিশ বছর পর্যন্ত  ইসলামের নবীর মধ্যে পাগলামী বা অস্বাভাবিক কোনো আচরণ আবিস্কার করতে পারেনি। তারা কেন এ নিয়ে চিন্তা করে না? চল্লিশ বছর ধরে ইসলামের নবীকে তারা দেখছে,  এ দীর্ঘ সময়ে  তারা মুহাম্মদ (সা.)’র মধ্যে পবিত্রতা, ন্যায়পরায়নতা, সত্যবাদিতা ও সততা ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পেরেছে কি? এখনও তিনি খারাপ ও নোংরা কাজের পরিণতি সম্পর্কে ভয় দেখানো ছাড়া অযৌক্তিক অন্য কিছু বলছেন কি? তাই জেনেশুনেও তোমরা কেন তাঁকে পাগল বলছো?

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো অন্যান্য যুগেও কাফেররা নবীগণকে পাগল বলে অপবাদ দিত! কাফের বা অবিশ্বাসীরা হয়তো ভবিষ্যত পরিণামের চিন্তা ও নিজ প্রবৃত্তির কূমন্ত্রণা দমন করাকে এক ধরনের পাগলামী বলে মনে করেন!

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ

এক. কাফেরদের বক্তব্য যুক্তি ভিত্তিক হয় না, বরং তারা অপবাদ ও দম্ভের ভিত্তিতেই কথা বলে। ধর্মীয় সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে তাদের কোনো যুক্তি নেই এবং এ কারণে তারা অযৌক্তিক আচরণের আশ্রয় নেয়।

দুই. খারাপ বা নোংরা কাজের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক বাণী স্পষ্ট ও প্রকাশ্য হওয়া উচিত এবং এ ব্যাপারে কোনো গোপনীয়তা বা অস্পষ্টতা বজায় রাখা উচিত নয়।

সূরা আরাফের ১৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

  أَوَلَمْ يَنْظُرُوا فِي مَلَكُوتِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا خَلَقَ اللَّهُ مِنْ شَيْءٍ وَأَنْ عَسَى أَنْ يَكُونَ قَدِ اقْتَرَبَ أَجَلُهُمْ فَبِأَيِّ حَدِيثٍ بَعْدَهُ يُؤْمِنُونَ

"কাফেররা কি আকাশমণ্ডলী ও ভূমণ্ডলের পরিচালনা ব্যবস্থার প্রতি এবং আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি লক্ষ্য করে না (অর্থাত এসবের সৃষ্টি কি অর্থহীন)? (এবং এ বিষয়েও কি চিন্তা করে না যে, ) সম্ভবত তাদের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে?  তাই এসব স্পষ্ট নিদর্শন (কুরআন) থাকা সত্ত্বেও তারা কোন্ কথার প্রতি আকৃষ্ট এবং কোন্ কথা তারা বিশ্বাস করবে?" (৭:১৮৫)

মহানবী (সা.)’র বক্তব্য ও আচরণের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে এবং তাঁর প্রতি অপবাদ না দিতে ও  ঔদ্ধত্য প্রকাশ না করতে কাফেরদের প্রতি আল্লাহর আহবানের পর এ আয়াতে আকাশ ও পৃথিবীসহ আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার আহবান জানানো হয়েছে। মহান আল্লাহ বলছেনঃ এ বিশাল সৃষ্টি জগতের সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও মালিকানা কার হাতে নিবদ্ধ?  এক আল্লাহ ছাড়া এসবের কি অন্য কোনো স্রষ্টা আছেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ কি এসবের ওপর কর্তৃত্বশীল? পার্থিব জীবন ও খেয়ালীপনায় মত্ত কাফেররা কি মৃত্যুর কথা ভাবে না? তারা যদি মৃত্যুকে বাস্তব বলে মনে করে, তাহলে কেন তারা সত্যকে অস্বীকার করছে? কেন তারা নবীর সত্য বাণীকে গ্রহণ না করে অন্যদের অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন কথা বিশ্বাস করছে?

এ আয়াতের শিক্ষা হল:

এক.  সৃষ্টি জগত নিয়ে গভীর চিন্তা ভাবনা করা উচিত। প্রকৃতি আল্লাহর মহিমার নিদর্শন। তাই প্রকৃতিকে ভালোভাবে জানলে আল্লাহর মহত্ত্বকে জানা সম্ভব হবে।

দুই. মৃত্যু সম্পর্কে উদাসীনতা চিন্তা ও কাজে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকে উৎসাহ দেয়। মৃত্যুর চিন্তা মানুষকে সত্য গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত করে এবং এর ফলে মন থেকে গোড়ামী ও বিদ্বেষ দূর হয়ে যায়।

সূরা আরাফের ১৮৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

مَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ وَيَذَرُهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ

"(পাপ ও অসততার জন্যে) আল্লাহ যাদের বিপথগামী করেন তাদের জন্যে কোনো পথ প্রদর্শক নেই। আল্লাহ তাদেরকে তাদের অবাধ্যতার মধ্যে অন্ধের মত ঘুরে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে রাখেন।" (৭:১৮৬)

এ আয়াতে কাফেরদের কাজের পরিণতি সম্পর্কে বলা হয়েছে: সত্যের প্রতি কাফেরদের অন্ধ বিদ্বেষ ও তাদের অযৌক্তিক গোঁড়ামির কারণে আল্লাহ তাদেরকে নিজ অবস্থার ওপর ছেড়ে দেন এবং এর ফলে তারা সুপথ থেকে বঞ্চিত হয়। আর আল্লাহর পথ থেকে যে বিচ্যুত হয় সে স্বাভাবিকভাবেই বিভ্রান্তির মধ্যে ঘুরপাক    খাবে। পথভ্রষ্ট ব্যক্তি প্রতিদিনই আরো বেশি বিভ্রান্ত হয়, কারণ, সে তার লক্ষ্য কি সেটাই  জানে না। আর এ জন্যে তার কাজ ও লক্ষ্যের মধ্যে কোনো মিল থাকে না।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা উচিত-

এক. নবী-রাসূলগণের সাথে অসহযোগিতা বা তাদের শিক্ষার বিরোধিতা করা হলে এ পৃথিবীতেই আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে। এ ধরনের শাস্তির মধ্যে প্রধান শাস্তিটি হলো নবীর বিরোধীদেরকে নিজ বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত করা এবং খোদায়ী সাহায্য থেকে দূরে রাখা ।

দুই. পৃথিবীতে মানুষ সব সময়ই পতনের দ্বার প্রান্তে থাকে। আল্লাহ তাদের পতনকে ঠেকিয়ে রাখেন যারা সত্য পথে টিকে থাকার চেষ্টা করে। যখনই আল্লাহ বিভ্রান্ত ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করেন, তখনই সে বিভ্রান্তির ঘূর্ণিপাকে পড়ে আরো তলিয়ে যেতে থাকে ।

সূরা আরাফের ১৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّي لَا يُجَلِّيهَا لِوَقْتِهَا إِلَّا هُوَ ثَقُلَتْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَا تَأْتِيكُمْ إِلَّا بَغْتَةً يَسْأَلُونَكَ كَأَنَّكَ حَفِيٌّ عَنْهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللَّهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

"(হে রাসূল!) তারা আপনাকে প্রশ্ন করে - কিয়ামত কখন ঘটবে? বলুন,- এ বিষয়ে জ্ঞান শুধু আমার প্রতিপালকের কাছেই আছে। শুধু তিনিই নির্দিষ্ট সময়ে তা প্রকাশ করবেন।  সেটা আসমান ও জমিনগুলো মধ্যে এক কঠিন গুরুভার হবে। এটি তোমাদের ওপর হঠাৎ করে এসে পড়বে। আপনি এ বিষয়ে সবিশেষ জানেন মনে করে তারা আপনাকে প্রশ্ন করে। আপনি বলুন,- এ বিষয়ে জ্ঞান শুধু আমার প্রতিপালকের কাছেই আছে। কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানে না।" (৭:১৮৭)

কাফেররা যেসব প্রশ্ন করে মহানবী (সা.)কে জব্দ করতে চাইতো, তার মধ্যে কিয়ামত কবে হবে - এ  প্রশ্নটি ছিল অন্যতম। অথচ কিয়ামত কবে হবে তার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এ বিষয়ের সত্যতা। যেমনিভাবে এটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে কে এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা? তাই এ প্রশ্নের উত্তর জানাটাই জরুরী। যদি বলা হয় যে,  ত্রিশ লক্ষ বছর আগে বিশ্ব জগত সৃষ্টি করা হয়েছে তাহলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় না। তা ছাড়া এ উত্তর ঠিক না ঠিক নয় তা প্রমাণেরও কোনো উপায় নেই। মহানবী (সা. ) যদি বলতেন যে, দশ হাজার বছর পর কিয়ামত বা মহাপ্রলয় ঘটবে তাহলে তা যে ঠিক বা ঠিক নয় তা প্রমাণের কোনো উপায় আছে কি?

পবিত্র কুরআন এখানে দু'টি মৌলিক দিক তুলে ধরছে। প্রথমতঃ কিয়ামত আকস্মিকভাবে ঘটবে এবং তা কখন ঘটবে  সে বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা মানুষের নেই । তাই মানুষ কিয়ামতকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে বলে মনে করাও ঠিক নয়। দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টির সূচনা ও সমাপ্তি সংক্রান্ত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহরই জানা আছে। অন্যরা, এমনকি নবী-রাসূলগণও তা জানেন না।

এ আয়াতের দু'টি শিক্ষা: 

এক. কিয়ামত বা শেষ বিচার দিবসের জন্যে সব সময়ই প্রস্তুত থাকা উচিত। কারণ, আমরা জানি না যে কিয়ামত কখন ঘটবে ।

দুই.যা আমরা জানি না সে বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করতে লজ্জা করা উচিত নয় । নবী-রাসূলগণও যা জানতেন না সে বিষয়ে স্পষ্ট করে বলতেন যে-আমরা জানি না ।