সূরা ইউসুফ; (৪র্থ পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা ইউসুফ; (৪র্থ পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 16:9:13 3-10-1403

সূরা ইউসুফ; আয়াত ১১-১৫

সূরা ইউসুফের ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: 

قَالُوا يَا أَبَانَا مَا لَكَ لَا تَأْمَنَّا عَلَى يُوسُفَ وَإِنَّا لَهُ لَنَاصِحُونَ (11) أَرْسِلْهُ مَعَنَا غَدًا يَرْتَعْ وَيَلْعَبْ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ

"(ইউসুফের ভাই’রা) বলল, হে আমাদের পিতা, ইউসুফের ব্যাপারে আপনি আমাদেরকে বিশ্বাস করছেন না কেন? যদিও আমরা তার শুভাকাঙ্ক্ষী।” (১২:১১)

“আপনি আগামীকাল তাকে আমাদের সঙ্গে পাঠান, সে (খোলা প্রান্তরে) খেলাধুলা করবে ও (ফলমূল) খাবে,আমরা নিশ্চয়ই তার রক্ষণাবেক্ষণ করবো।" (১২:১২)

হযরত ইউসুফের ভাইয়েরা প্রথমে তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল,এরপর তারা হত্যার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তাকে গভীর কোনো কূপে ফেলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের পর তারা ফন্দি ফিকির করতে থাকে কিভাবে ইউসুফকে বাবার সঙ্গ থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায়। তাই তারা একদিন তাদের বাবাকে বলল,আপনি কেন ইউসুফকে আমাদের কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছেন? তাকে আমাদের সঙ্গে মাঠে যাওয়ার অনুমতি দিন। আমরা ক্ষেতে কাজ করবো, আর সে খোলা প্রান্তরে ঘুরবে,খাবে-দাবে এবং খেলা করবে। আমরাই তার দেখা শোনা করবো।

খেলাধুলা ও দৌড়ঝাঁপ করা শিশু বয়সে অত্যন্ত জরুরি। এজন্য হযরত ইয়াকুব (আ.) মন থেকে না চাইলেও বড় ছেলেদের আবদার উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি হযরত ইউসুফকে তাদের সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। এই আয়াতের তিনটি শিক্ষণীয় দিক রয়েছে।

এক. যে কারো কথা বিশ্বাস করা উচিত নয়। যেমন হযরত ইউসুফের ভাইয়েরা নিজেদেরকে বিশ্বস্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের মনে দুরভিসন্ধি কাজ করছিল।

দুই. হিংসা মানুষকে এমন পর্যায়ে ঠেলে দেয় যে,অনেক সময় নিজের আপনজনও হিংসার বশবর্তী হয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিতে দ্বিধা করে না।

তিন. খেলাধুলা ও বিনোদন সবার জন্যই প্রয়োজন বিশেষ করে শিশু বয়সে এটা অপরিহার্য। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, এই স্বাভাবিক প্রয়োজনটি যেন অপব্যবহারের হাতিয়ারে পরিণত না হয়।

এবার এই সূরার ১৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক।

قَالَ إِنِّي لَيَحْزُنُنِي أَنْ تَذْهَبُوا بِهِ وَأَخَافُ أَنْ يَأْكُلَهُ الذِّئْبُ وَأَنْتُمْ عَنْهُ غَافِلُونَ

"(হযরত ইয়াকুব) বললেন,এটা আমাকে কষ্ট দেবে যে, তোমরা তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে,আমি আশঙ্কা করি তোমরা তার প্রতি অমনোযোগী হলে তাকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলবে।"(১২:১৩)

হযরত ইয়াকুব (আ.)ও আল্লাহর নবী ছিলেন। কিন্তু পিতা হিসেবে ছোট সন্তানের প্রতি বিশেষ দরদ ও মমত্ববোধের কারণে তিনি ইউসুফকে একাকী ভাইদের সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিতে চাচ্ছিলেন না। পক্ষান্তরে হযরত ইউসুফ তখন বয়সে তরুণ,ধীরে ধীরে বড় হচ্ছেন। তাই বাবার উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে তাকে স্বনির্ভর করে তোলাও জরুরি। এসব বিবেচনা করে হযরত ইয়াকুব (আ.) ইউসুফকে ভাইদের সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে,সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে সব সময় লক্ষ্য রাখতে হবে, শিশুর ব্যক্তিত্ব এবং তার চিন্তার স্বাধীনতা যেন ব্যহত না হয়। শিশু ব্যথা পেতে পারে বা তার জন্য অন্য কোনো বিপদ আসতে পারে এই আশঙ্কায় তাকে কিছুতেই ঘরে বন্দি করে রাখা উচিত নয়।

এবার এই সূরার ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالُوا لَئِنْ أَكَلَهُ الذِّئْبُ وَنَحْنُ عُصْبَةٌ إِنَّا إِذًا لَخَاسِرُونَ

"(ইউসুফের ভাইয়েরা) বলল,আমরা এক ভারী দল হওয়া সত্ত্বেও যদি নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলে তাহলে আমরা নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হব।" (১২:১৪)

হযরত ইউসুফকে পথের কাঁটা মনে করে তাকে অপসারণের ফন্দি এঁটেছিল তার বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা। হযরত ইয়াকুব (আ.)এর মনে এক ধরনের ভয় ও শংকা কাজ করছিল। কিন্তু তার বড় ছেলেরা যখন নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যকে যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করল তখন তিনি তাদের আবদার উপেক্ষা করতে পারলেন না।

এই সূরার ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَلَمَّا ذَهَبُوا بِهِ وَأَجْمَعُوا أَنْ يَجْعَلُوهُ فِي غَيَابَةِ الْجُبِّ وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِ لَتُنَبِّئَنَّهُمْ بِأَمْرِهِمْ هَذَا وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ

"এরপর তারা যখন তাকে নিয়ে চললো এবং অন্ধকূপে নিক্ষেপ করতে একমত হলো,আমি তাকে জানিয়ে দিলাম যে তুমি তাদেরকে এ কাজের কথা এমন সময় বলবে যখন তারা তোমাকে চিনবে না।" (১২:১৫)

শেষ পর্যন্ত হযরত ইউসুফ তার বৈমাত্রেয় ভাইদের সঙ্গে রওনা হয়ে গেলেন। এক পর্যায়ে তার ভাইয়েরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হযরত ইউসুফকে এক গভীর কূপের কাছে নিয়ে কুপটির মাঝামাঝি এবং পানির কিছুটা উপরে একটি খুপরির মত স্থানে ইউসুফ (আ.) কে রেখে দিল। কারণ তারা হযরত ইউসুফকে প্রাণে মারতে চায়নি। তারা চেয়েছিল, কোনো বণিক দল কূপের ভেতর ইউসুফকে পেয়ে যেন দূর কোনো দেশে নিয়ে যায়। তরুণ ইউসুফ যাতে ঘন অন্ধকার এবং একাকিত্বের কারণে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে না পড়ে সেজন্য আল্লাহ-তায়ালা তাকে সান্ত্বনা দিলেন। হযরত ইউসুফের প্রতি এলহাম হলো,"হে ইউসুফ তুমি ভয় পেয়ো না,অচিরেই এমন সময় আসবে যখন তোমার ভাইয়েরা তোমার কাছে আসতে বাধ্য হবে আর তুমি তাদের এই ঘৃণ্য কাজের বর্ণনা তাদের সামনেই তুলে ধরবে।"