সূরা ইউসুফ; (১০ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা ইউসুফ; (১০ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 15:52:34 3-10-1403

সূরা ইউসুফ; আয়াত ৩১-৩৩

সূরা ইউসুফের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

فَلَمَّا سَمِعَتْ بِمَكْرِهِنَّ أَرْسَلَتْ إِلَيْهِنَّ وَأَعْتَدَتْ لَهُنَّ مُتَّكَأً وَآَتَتْ كُلَّ وَاحِدَةٍ مِنْهُنَّ سِكِّينًا وَقَالَتِ اخْرُجْ عَلَيْهِنَّ فَلَمَّا رَأَيْنَهُ أَكْبَرْنَهُ وَقَطَّعْنَ أَيْدِيَهُنَّ وَقُلْنَ حَاشَ لِلَّهِ مَا هَذَا بَشَرًا إِنْ هَذَا إِلَّا مَلَكٌ كَرِيمٌ

"(আজিজের) স্ত্রী যখন মিশরের নারীদের সমালোচনা শুনলো তখন সে তাদের ডেকে পাঠালো, তাদের জন্য আসন প্রস্তুত করল, তাদের প্রত্যেককে (ফল কাটার জন্য) একটি করে ছুরি দিল এবং ইউসুফকে বলল তাদের সম্মুখে বের হও। অতঃপর তারা যখন তাকে দেখলো তখন তারা তার রূপের গরিমায় অভিভুত হলো এবং নিজেদের হাত কেটে ফেলল, তারা বলল, অদ্ভুত আল্লাহর মাহাত্ম্য! এ তো মানুষ নয়, এ তো মহিমান্বিত ফেরেশতা।" (১২:৩১)

মিশরের অভিজাত নারীরা যখন জানতে পারলো যে রাণী জুলেখা তার ভৃত্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে, তখন তারা রাণীকে ধিক্কার জানালো এবং সমালোচনায় লিপ্ত হলো। পাশাপাশি তারা ঐ ভৃত্য যুবককে এক নজর দেখার অভিপ্রায়ও মনে মনে পোষণ করতে থাকলো। সবার মনে কৌতুহল হল কেমন সেই যুবক যার প্রতি রাণী এভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়লো। অপরদিকে জুলেখাও তার এ অবস্থার একটি ব্যাখ্যা তুলে ধরার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। ফলে একদিন তিনি মিশরের অভিজাত নারীদেরকে নিমন্ত্রণ করলেন এবং ফল কেটে খাওয়ার জন্য প্রত্যেককে একটি করে ছুরি দিলেন। এরপর ইউসুফকে বললেন ফল পরিবেশন করার জন্য। হযরত ইউসুফ এতই সুদর্শন ছিলেন যে, ঐ জলসায় উপস্থিত প্রত্যেক নারীই তার সৌন্দর্য দেখে অভিভুত হয়ে যায় এবং বলতে থাকে অদ্ভুত মহিমা আল্লাহর। একে তো মানুষ বলা যায় না এ তো ফেরেশতা! তারা এতই বিমুগ্ধ হয়েছিল যে ফল কাটতে গিয়ে নিজেদের অজান্তেই নিজেদের হাত কেটে ফেলল।

অনেক সময় মানুষ অন্যের সমালোচনা করে কিন্তু তারা নিজেরা যদি একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় তাহলে তারাও যে একই ধরনের ভুল করবে তাতে সন্দেহ নেই। মিশরের নারীরা জুলেখার সমালোচনায় মুখর হয়েছিল। কিন্তু তারা যখন সুদর্শন ইউসুফকে দেখলো বিস্ময়ে অভিভুত হয়ে ফলের পরিবর্তে নিজেদের হাতই কেটে ফেলল।

এই সূরার ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

قَالَتْ فَذَلِكُنَّ الَّذِي لُمْتُنَّنِي فِيهِ وَلَقَدْ رَاوَدْتُهُ عَنْ نَفْسِهِ فَاسْتَعْصَمَ وَلَئِنْ لَمْ يَفْعَلْ مَا آَمُرُهُ لَيُسْجَنَنَّ وَلَيَكُونَنْ مِنَ الصَّاغِرِينَ

"(জুলেখা তার অতিথিদের উদ্দেশ্যে) বলল, এই সে যার সম্বন্ধে তোমরা আমার নিন্দা করছো। আমি তো তার কাছে অসৎ কর্ম কামনা করেছি কিন্তু সে নিজেকে পবিত্র রেখেছে। আমি তাকে যা আদেশ করি সে যদি তা না করে তবে সে কারারুদ্ধ হবেই এবং অপমাণিতদের অন্তর্ভুক্ত হবে।" (১২:৩২)

জুলেখা যদিও তার স্বামীর কাছে নিজের দোষ স্বীকার না করে উল্টো ইউসুফকেই দোষী সাব্যস্ত করেছিল,কিন্তু ইউসুফকে দেখে তার অতিথিদের যে অবস্থা হয়েছিল তাতে তিনি সত্যকে স্বীকার করে নেন এবং অভিজাত নারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি যদি ইউসুফের কাছে অসৎ কর্ম কামনা করে থাকি তাহলে নিশ্চয়ই এর সঙ্গত কারণ ছিল। কাজেই আশা করি এরপর থেকে আর আমার নিন্দা ও সমালোচনা করা হবে না। পাশাপাশি রাণী এটাও বলে দিলেন, ইউসুফ যেহেতু আমার কথা উপেক্ষা করেছে এজন্য তাকে অবশ্যই কারাভোগ করতে হবে, যাতে সে বুঝতে পারে যে মুনিবের আদেশ অমান্য করা হলে তার পরিণতি কী হয়। সৎ পরায়ণতা এবং পবিত্রতা এত মূল্যবান যে, পাপাচারী অসৎ মানুষও তার প্রশংসা করতে দ্বিধাবোধ করে না।

এই সূরার ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

قَالَ رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ وَإِلَّا تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ وَأَكُنْ مِنَ الْجَاهِلِينَ

"ইউসুফ বলল,হে আমার প্রতিপালক! এই নারীগণ আমাকে যার প্রতি আহ্বান করছে তা অপেক্ষা কারাগার আমার নিকট অধিক প্রিয়। আপনি যদি তাদের ছলনা হতে আমাকে রক্ষা না করেন তবে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং অজ্ঞদের অন্তর্ভূক্ত হব।" (১২:৩৩)

মিশরীয় নারীদের সমাবেশে রানীর স্বীকারোক্তি এবং হযরত ইউসুফ নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পরও রাণীর প্ররোচনায় আজিজ তাকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। এ থেকে এটা বোঝা যায় যে, ক্ষমতার মোহ এবং বিলাস বৈভবে মানুষ তার স্বাধীন ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে ফেলে এবং কুপ্রবৃত্তি ও নারীর ছলনার কাছে বন্দি হয়ে যায়।

ইতিহাসে দেখা যায়- এ ধরনের ব্যক্তিত্বহীন মানুষই ক্ষমতার মসনদে আরোহন করে সর্ব সাধারণের ভাগ্য নির্ধারণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কিন্তু সৎ ও পবিত্র অন্তরের মানুষ সব সময়ই অবৈধ কর্ম ও কুপ্রবৃত্তির দাসত্বের পরিবর্তে কারাভোগকেই প্রাধান্য দেয়। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সব কিছুর উর্ধ্বে স্থান দিয়ে থাকে।

পাপ ও কলুষমুক্ত পরিবেশ মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কলুষিত পরিবেশ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। এতে কষ্ট হলেও তা উত্তম। ইতিহাসে দেখা যায় বহু মানুষ সততা ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য কষ্টকর জীবনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে শিক্ষাহীনতাই কেবল অজ্ঞতা নয়, উশৃঙ্খলতা এবং কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব করাটাও অজ্ঞতার মধ্যে পড়ে।