সূরা ইউসুফ; আয়াত ১৬-১৮
সূরা ইউসুফের ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
وَجَاءُوا أَبَاهُمْ عِشَاءً يَبْكُونَ
"(ইউসুফের ভাইয়েরা) রাতে কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিতার নিকট এল।" (১২:১৬)
হযরত ইউসুফ (আ.)এর ভাইয়েরা তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউসুফকে একটি লোকালয়হীন প্রান্তরে অবস্থিত গভীর কূপে ফেলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে গেল। তারা জানতো বাড়ি ফেরা মাত্রই তাদের পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.) হন্তদন্ত হয়ে ইউসুফ সম্পর্কে জানতে চাইবেন। তাই তাদেরকে যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে সেজন্য তারা কান্নার ভান করে এবং বাবাকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করে যে, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ভাইকে হারিয়ে তারাও ব্যথিত ও অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছে। কান্নাও যে ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে এই আয়াতে পাকে তাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনেক সময় ষড়যন্ত্রকারীরাও কান্নার ভান করে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেয়। কাজেই এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত না হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
এই সূরার ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَالُوا يَا أَبَانَا إِنَّا ذَهَبْنَا نَسْتَبِقُ وَتَرَكْنَا يُوسُفَ عِنْدَ مَتَاعِنَا فَأَكَلَهُ الذِّئْبُ وَمَا أَنْتَ بِمُؤْمِنٍ لَنَا وَلَوْ كُنَّا صَادِقِينَ
"তারা বলল,হে আমাদের পিতা! আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের মালপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। এরপর নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু তুমি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবে না যদিও আমরা সত্যবাদী।" (১২:১৭)
হযরত ইউসুফ (আ.)এর বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বলল,আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা দিচ্ছিলাম,আর ইউসুফ আমাদের মালপত্রের কাছে বসা ছিল। একা পেয়ে একটি নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলেছে। এত বড় মিথ্যা বলতে তাদের মনে কোনো দ্বিধা হলো না। তারা মিথ্যা বলার সময় যেন ভুলেই গিয়েছিল যে, ইউসুফকে তারা খেলায় নেয়ার কথা বলেই বাবার কাছ থেকে মাঠে যাওয়ার অনুমতি নিয়েছিল। ইউসুফ তাদের মালপত্র পাহারা দেবে আর তারা নিজেরা খেলবে এটা হওয়ার কথা ছিল না। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, তারা এতবড় নির্জলা মিথ্যা বলার পরও ক্ষান্ত হলো না। উল্টো বাবার উপর চাপ সৃষ্টির জন্য বলতে লাগলো, তুমি কি আমাদের কথা বিশ্বাস করছো না? আমরা কি মিথ্যা বলছি? আমাদের ওপর কি তোমার আস্থা নেই?
কখনও মানুষ একটি মিথ্যা কথা বলার জন্য ১০টি মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়। হযরত ইউসুফ (আ.)এর ভাইদের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। নিজেদের অন্যায়কে ঢাকা দেয়ার জন্য তারা একের পর এক বেপরোয়া মিথ্যা বলে যাচ্ছিল।
এই সূরার ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَجَاءُوا عَلَى قَمِيصِهِ بِدَمٍ كَذِبٍ قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ أَنْفُسُكُمْ أَمْرًا فَصَبْرٌ جَمِيلٌ وَاللَّهُ الْمُسْتَعَانُ عَلَى مَا تَصِفُونَ
"তারা তার (ইউসুফের) জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে পিতার নিকট নিয়ে আসলো। তিনি বললেন,(নেকড়ে বাঘ ইউসুফকে ক্ষতি করেছে এটা হতে পারে না) তোমরা মনগড়া কথা নিয়ে এসেছো। এখন পূর্ণ ধৈর্য ধরাই আমার পক্ষে উত্তম। তোমরা যা বর্ণনা করছো সে বিষয়ে আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাই।" (১২:১৮)
হযরত ইয়াকুব (আ.) আল্লাহর নবী ছিলেন। তাই আধ্যাত্মিক শক্তি বলে তিনি অদৃশ্য জগতের অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে পারতেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইউসুফকে বাঘে খায়নি,সে জীবিত আছে। তাই তিনি তার বড় ছেলেদের কথা বিশ্বাস না করে বলেছিলেন,হিংসার বশবর্তী হয়ে তোমরা ইউসুফের সঙ্গে এত জঘন্য আচরণ করতে পারলে? ইউসুফকে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তোমরা আমাকে এত বেশী দুঃখ ও মানসিক কষ্ট দিয়েছো যে এজন্য আমি আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। হযরত ইয়াকুব (আ.) ইউসুফের সন্ধানে বের হলেন না। কারণ ইউসুফের সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ইউসুফ জীবিত আছে এবং এক সময় মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার আবির্ভাব ঘটবে। এজন্য তিনি শুধু এতটুকু বলেছিলেন যে,আল্লাহ আমাকে ধৈর্য ধরার শক্তি দান করুন।
যে কোনো দুর্ঘটনাই ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে মোকাবেলা করা উচিত। কারণ এর মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন। ধৈর্য তখনই ফলপ্রদ হয় যখন মানুষ চরম বিপদের মধ্যেও শান্তভাবে আল্লাহর সাহায্য কামনা করে।