সূরা রা’দ; (৬ষ্ঠ পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা রা’দ; (৬ষ্ঠ পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 14:46:3 3-10-1403

সূরা রা’দ; আয়াত ১৭-১৯

সূরা রা’দের ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَسَالَتْ أَوْدِيَةٌ بِقَدَرِهَا فَاحْتَمَلَ السَّيْلُ زَبَدًا رَابِيًا وَمِمَّا يُوقِدُونَ عَلَيْهِ فِي النَّارِ ابْتِغَاءَ حِلْيَةٍ أَوْ مَتَاعٍ زَبَدٌ مِثْلُهُ كَذَلِكَ يَضْرِبُ اللَّهُ الْحَقَّ وَالْبَاطِلَ فَأَمَّا الزَّبَدُ فَيَذْهَبُ جُفَاءً وَأَمَّا مَا يَنْفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الْأَرْضِ كَذَلِكَ يَضْرِبُ اللَّهُ الْأَمْثَالَ

"তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর স্রোতধারা প্রবাহিত হতে থাকে নিজ নিজ পরিমাণ অনুযায়ী। অতঃপর প্লাবন তার উপরিস্থিত আবর্জনা বহন করে। যখন অলংকার অথবা তৈজসপত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে কিছু অগ্নিতে উত্তপ্ত করা হয় তখন এরূপে আবর্জনা উপরিভাগে আসে। এভাবে আল্লাহ সত্য ও অসত্যের দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকেন। অতএব ফেনা বা আবর্জনা চলে যায় এবং মানুষের জন্য যা উপকারী মাটিতে তা থেকে যায়। আল্লাহ এভাবে উপমা দিয়ে থাকেন।" (১৩:১৭)

এই আয়াতের শেষ ভাগে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের সামনে সত্য ও মিথ্যা সুস্পস্ট করার জন্য এমন উদাহরণ বা উপমা ব্যবহার করেন যার সাথে তারা পরিচিত এবং যা তাদের সহজেই বোধগম্য হয়। এই আয়াতে সত্যকে পানির সাথে এবং মিথ্যাকে পানির ফেনার সাথে তুলনা করা হয়েছে। পানির অপর নাম জীবন। জীবন ধারণের জন্য পানি অপরিহার্য। এই অপরিহার্যতা পূরণের জন্য মহান আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টির ব্যবস্থা করেছেন। বৃষ্টির পানিতে নদী-নালা, খাল-বিল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। অবারিত বর্ষণে নদী-নালা পূর্ণ হয়ে যে শ্রোতধারা তৈরি করে তাতে এক ধরনের ফেনা পানির উপরে ভাসমান হয়ে ওঠে। এক সময় এই ফেনা বিলীন হয়ে যায় কিন্তু পানি রয়ে যায় এবং মানুষ তা দিয়ে প্রয়োজন মেটায়।

স্বর্ণকারের দোকানেও একই ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। অলংকার তৈরির সময় স্বর্ণ যখন উত্তপ্ত করা হয় তখন এর খাদগুলো উপরে উঠে আসে। ফলে খাদ থেকে খাঁটি সোনা আলাদা করা সম্ভব হয়। পানির ফেনা যেমন ক্ষণিকের জন্য দৃশ্যমান হয়ে তা এক পর্যায়ে বিলীন হয়ে যায় তেমনি সাময়িকভাবে মিথ্যা বা বাতিল শক্তির উত্থান ঘটলেও এর বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।

মানব জাতির প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ পরিমাপ করে শেষ করা যাবে না। তার দয়া ও অনুগ্রহ অবারিত। মানুষের প্রতি তাঁর কল্যাণের ধারা সবসময় চলমান। কে কতটুকু পেল বা গ্রহণ করতে পারল তা মানুষের নিজেস্ব ব্যাপার। যার যোগ্যতা ও ধারণ ক্ষমতা বেশি সে বেশী পাবে আর যার যোগ্যতা ও ধারণ ক্ষমতা কম সে কম পাবে এটাই স্বাভাবিক।

এই সূরার ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

لِلَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِرَبِّهِمُ الْحُسْنَى وَالَّذِينَ لَمْ يَسْتَجِيبُوا لَهُ لَوْ أَنَّ لَهُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لَافْتَدَوْا بِهِ أُولَئِكَ لَهُمْ سُوءُ الْحِسَابِ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمِهَادُ

“যারা প্রতিপালকের আদেশ পালন করে তাদের জন্য উত্তম প্রতিদান রয়েছে। এবং যারা আদেশ পালন করে না তাদের কাছে যদি জগতের সব কিছু থাকতো এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরো কিছু থাকতো তাহলে সবই শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দিয়ে দিত। তাদের হিসাব হবে কঠোর এবং জাহান্নাম হবে তাদের আবাস। সেটা কতই না নিকৃষ্ট বাসস্থান।” (১৩:১৮)

এই আয়াতে বিশ্বাসী মুমিন এবং অবিশ্বাসী কাফেরদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করেছে তাদের জন্য রয়েছে উত্তম পুরষ্কার, আর যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে চলেছে তারা এত ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হবে যে, সে সময় তারা যদি পৃথিবীর সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশী সম্পদের মালিক হয়, ওই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তারা সবই বিলিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু সে দিন তাদের কোন কথা, কোন আর্জিই গ্রহণ করা হবে না। তাদের ধনসম্পদ, কোন কিছুই সেদিন তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না।

আয়াতের শেষ ভাগে বলা হয়েছে, সে দিন অবিশ্বাসী কাফেরদের কাছ থেকে কঠোর হিসাব নেয়া হবে। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে- যারা ইহজগতে মানুষের সঙ্গে কঠোর আচরণ করবে কেয়ামতের দিন তাদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করা হবে, আর যারা দুনিয়ায় মানুষের ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর সৃষ্টিতে দেখবে এবং নম্র আচরণ করবে কেয়ামতের দিন তাদের সঙ্গে অনুরূপ আচরণই করা হবে।

যারা বুদ্ধিমান তারা এই নশ্বর জীবনের জন্য সঠিক পথটাই বেছে নেয়, যে পথে রয়েছে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ। আর যারা এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে চায় না,যাদের চিন্তা-চেতনা নশ্বর জগতকে নিয়েই আবর্তিত হয় তাদেরকে নেহায়েত অপরিণামদর্শী ও নির্বোধ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

সূরা রা’দের  ১৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে,

أَفَمَنْ يَعْلَمُ أَنَّمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ الْحَقُّ كَمَنْ هُوَ أَعْمَى إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُولُو الْأَلْبَابِ

"আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাকে যে ব্যক্তি সত্য বলে বিশ্বাস করে,তার সাথে জ্ঞানান্ধ ব্যক্তির কি তুলনা চলে? বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।" (১৩:১৯)

বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা দিয়ে এই আয়াতে বলা হয়েছে, সত্য দ্বীন বা জীবন বিধানকে যারা মনে প্রাণে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে তারাই প্রকৃত জ্ঞানি ও বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান বলেই তারা বাস্তব সত্যকে উপলব্ধি করতে পেরেছে। কিন্তু যারা সত্য দ্বীনকে গ্রহণ না করে তা প্রত্যাখ্যান করে তাদের চোখ থাকলেও তারা আসলে অন্ধের মত। তাদের বিবেক বুদ্ধি কুসংস্কার, গোঁয়ার্তুমি এবং অজ্ঞতার আবরণে ঢাকা পড়ে গেছে। কুরআনের ভাষায় এরা হচ্ছে উলুল আলবাব। পবিত্র কুরআনে ১৬ বার নাম উচ্চারিত হয়েছে। অনেক অন্ধও জ্ঞান ও হৃদয়ের আলোতে সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে, কিন্তু অনেক চক্ষুষ্মান ব্যক্তির হৃদয় অজ্ঞতার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাওয়ার কারণে সত্য উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়ে পড়ে ।