সূরা রা’দ; (৩য় পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা রা’দ; (৩য় পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 14:47:15 3-10-1403

সূরা রা’দ; আয়াত ৭-১০ (পর্ব-৩)

সূরা রা’দের ৭নং আয়াতে বলা হয়েছে,

وَيَقُولُ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْهِ آَيَةٌ مِنْ رَبِّهِ إِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ وَلِكُلِّ قَوْمٍ هَادٍ

"সত্য প্রত্যাখ্যানকারী কাফেররা বলে তার প্রতি তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে কোন মুজিজা বা নিদর্শন অবতীর্ণ হলো না কেন? (হে রাসূল!) আপনি তো কেবল সতর্ককারী এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যই সতর্ককারী রয়েছে।" (১৩:৭)

যারা নেহায়েত গোয়ার্তুমির বশবর্তী হয়ে সত্যের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছিল,তারা বলতো- হযরত মুহাম্মদ (সা.) কেন অন্যান্য নবী রাসূলের মত মুজিজা বা অলৌকিক কর্ম প্রদর্শন করেন না? এই আয়াতে কাফের মুশরিকদের এ ধরনের বক্তব্যের জবাব দেয়া হয়েছে।

প্রথমত: প্রত্যেক নবীর মুজিজা তার সময়ের সামাজিক প্রথা বা রীতির ভিত্তিতে হয়ে থাকে। যেমন হযরত মুসা (আ.) এর সময় মিশরে জাদুর ব্যাপক প্রচলন ছিল। কাজেই হযরত মুসা (আ.) এর মুজিজাও ছিল অনুরূপ। ফলে হযরত মুসা (আ.) যখন তার মুজিজা প্রদর্শন করেন তখন ফেরাউন তাঁকে ‘বড় জাদুকর’ আখ্যায়িত করেছিল। তেমনিভাবে হযরত ঈসা (আ.) এর যুগে চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নতি সাধিত হয়েছিল, তাই হযরত ঈসা (আ.) এর মুজিজাও ছিল এর সাথে সম্পর্কিত। যেমন তিনি মৃত প্রায় ব্যক্তিকে জীবন দান করতে পারতেন এবং অনেক কঠিন ব্যাধির আরোগ্য বিধান করতে পারতেন। কিন্তু বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে যুগে নব্যুয়ত লাভ করেন সে যুগে আরবে কাব্য ও সাহিত্য বেশ উৎকর্ষতা লাভ করেছিল। কাজেই বিশ্বনবীর ওপর যে মহাগ্রন্থ অবতীর্ণ হয় তা সাহিত্যিক মানের দিক থেকে অদ্বিতীয় এবং অতুলনীয়।

এই আয়াতে আরেকটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, কাফেরদের মধ্যে গোয়ার্তুমি ছিল প্রবল। সত্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা তাদের ছিল না। কাজেই বিশ্ব নবী যদি তাদের আবদার অনুযায়ী কোন মুজিজা প্রদর্শন করতেন তাহলে তারা তা দেখেও সত্যকে গ্রহণ করতো না বরং অন্য কিছুর বাহানা আনতো। আসলে পাপের কালিমায় যাদের অন্তর আচ্ছাদিত হয়ে যায় তাদের পক্ষে সত্য উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না।

এই আয়াত থেকে দুটো বিষয় আমরা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারি :

এক. নবী রাসূলদের আগমনের উদ্দেশ্য মুজিজা বা অলৌকিক কর্ম প্রদর্শন করা নয়। পৃথিবীতে তাদের আগমন ঘটেছে মানুষকে সতর্ক করার জন্য এবং তাদেরকে সত্য পথ প্রদর্শন করার জন্য।

দুই. বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর পর কোন নবী বা রাসূলের আগমন না ঘটলেও আল্লাহতা’লা প্রত্যেক সমাজেই আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন আলেম পাঠাবেন যারা সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন।

এই সূরার ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

اللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَحْمِلُ كُلُّ أُنْثَى وَمَا تَغِيضُ الْأَرْحَامُ وَمَا تَزْدَادُ وَكُلُّ شَيْءٍ عِنْدَهُ بِمِقْدَارٍ

"নারীর গর্ভে যা আছে এবং জরায়ুতে যা কিছু পরিবর্তন ঘটে আল্লাহ তা জানেন এবং তার কাছে প্রত্যেক বস্তুরই একটি পরিমাণ রয়েছে।" (১৩:৮)

এই আয়াতে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর সীমাহীন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সামান্য ধারণা দেয়া হয়েছে। তিনি জগতের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব কিছু সম্পর্কেই অবহিত। মায়ের পেটে ভ্রুণের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে মায়ের কোন ধারণা নেই, কিন্তু মহান আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। তিনিই মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় এবং ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নবজাতকের যাবতীয় প্রয়োজনের সুব্যবস্থা করেন।

আল্লাহর অশেষ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বর্ণনার পাশাপাশি এই আয়াতে এটাও ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ প্রকৃতিতে একটি সুশৃংখল নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন। সব কিছুই আল্লাহর বেধে দেয়া নিয়ম অনুযায়ী চলছে, আবর্তিত হচ্ছে। গর্ভধারণ থেকে নিয়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত হলেও তা হয় প্রকৃতিতে বেঁধে দেয়া নিয়ম অনুসারে। কোন কিছুই তার নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতে পারে না।

মহান আল্লাহ যে শুধুমাত্র বিশ্ব জগতের মৌলিক বিষয়েই জ্ঞান রাখেন আর সূক্ষ্ম বা ছোট খাটো বিষয় তাঁর জ্ঞানের বাইরে থেকে যায় এমনটি নয়। বরং জগতের ছোট বড় সকল বিষয়ের ওপর আল্লাহর জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রণ পরিব্যাপ্ত। এমন কিছু নেই যা তার জানার বাইরে বা তার নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত।

মাতৃগর্ভে ভ্রুণের গঠন ও এর ক্রমবিকাশ, অবশেষে পূর্ণাঙ্গ মানবরূপে এ ধরায় তার আগমন সব কিছুই মহান পরওয়ারদিগারের বেঁধে দেয়া প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী সংঘটিত হয়ে থাকে। এরপর মায়ের বুকে নবজাতকের জন্য উপযুক্ত খাদ্যের ব্যবস্থা তিনিই করে দেন। এ সবই বিশ্ব প্রতিপালক মহান আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞারই প্রমাণ।

সূরা রা’দের ৯ ও ১০ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-

عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْكَبِيرُ الْمُتَعَالِ (9) سَوَاءٌ مِنْكُمْ مَنْ أَسَرَّ الْقَوْلَ وَمَنْ جَهَرَ بِهِ وَمَنْ هُوَ مُسْتَخْفٍ بِاللَّيْلِ وَسَارِبٌ بِالنَّهَارِ

"যা অদৃশ্য ও যা দৃশ্যমান তিনি তা অবগত, তিনি মহান, সর্বোচ্চ মর্যাদাবান।” (১৩:৯)

“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি গোপনে কথা বলে এবং যে ব্যক্তি উচ্চস্বরে কথা বলে তেমনি যে রাতে আত্মগোপন করে এবং যে দিনে প্রকাশ্যে বিচরণ করে তারা সবাই সমভাবেই আল্লাহর জ্ঞানগোচর হয়।" (১৩:১০)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতেও মহান আল্লাহর সীমাহীন জ্ঞানের আরো কিছু উদাহরণ বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে বুঝানো হয়েছে ছোট-বড়, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য আল্লাহর কাছে কোন পার্থক্য নেই। মানুষ আস্তে করে বললেও তিনি যেমন শুনতে পারেন তেমনি জোরে বললেও তিনি তা শুনেন। এমনকি মানুষের মনে যা আছে তাও তিনি বুঝতে পারেন। বস্তু জগতে সব কিছুই তার জ্ঞানের আওতার মধ্যে রয়েছে, এমনকি মানুষ পঞ্চ ইন্দ্রীয় দিয়ে যা অনুভব করতে অপারগ, আল্লাহর কাছে তা সুস্পষ্ট। ফলে যারা বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেন, ঈমান আনেন তারা পাপাচারে লিপ্ত হতে পারে না। কারণ তারা এটা বিশ্বাস করেন যে, গোপনে এবং অপ্রকাশ্যে যা কিছু করা হয় আল্লাহর কাছে তা গোপন নয়। তিনি সবই দেখেন এবং সবই জানেন। কাজেই পাপের শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার কোন পথ নেই।

মহান আল্লাহ সর্বোত্তম ও পূর্ণাঙ্গ সত্তা। কোন অপূর্ণতা তাঁর জন্য অকল্পনীয়। এটাই ইসলামের উপস্থাপিত বিশ্বাস। এছাড়া, আল্লাহ স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে। তিনি সময় বা কোন স্থানের গণ্ডিতে আবদ্ধ নন।