সূরা ইউসুফ; (২৪তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা ইউসুফ; (২৪তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 12:6:51 3-10-1403

সূরা ইউসুফ; আয়াত ৮৭-৮৯

সূরা ইউসুফের ৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

يَا بَنِيَّ اذْهَبُوا فَتَحَسَّسُوا مِنْ يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلَا تَيْئَسُوا مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لَا يَيْئَسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ

“হে আমার পুত্রগণ, তোমরা যাও, ইউসুফ ও তার সহোদরের অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহর রহমত হতে তোমরা নিরাশ হয়ো না। কারণ অবিশ্বাসী সম্প্রদায় ব্যতীত আল্লাহর রহমত বা আশিস হতে কেউ নিরাশ হয় না।" (১২:৮৭)

আগের পর্বে আলোচনা হয়েছে যে, বেনইয়ামিনকে মিশরে আটক রাখার খবর যখন হযরত ইয়াকুব (আ.) কে জানানো হল, তখন ইউসুফের ঘটনা তাঁর মনে পড়ে গেলে। ফলে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তিনি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন এবং এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করলেন।

বাল্যকালে দেখা হযরত ইউসুফের তাতপর্যপূর্ণ স্বপ্নের কথা ইয়াকুব (আ.) এর মনে ছিল। তাই তিনি নিশ্চিত ছিলেন, ইউসুফ মারা যায়নি বরং স্বপ্নের কারণে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, আল্লাহ ইউসুফকে এই পৃথিবীতেই একজন সম্মানী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এজন্য তিনি পুত্রদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, তোমরা পুনরায় মিশরে যাও এবং সেখানে ইউসুফকে অনুসন্ধান কর। পাশাপাশি বেনইয়ামিনের মুক্তির জন্য চেষ্টা কর। এরপর দু’জনকে নিয়ে তোমরা আবার আমার কাছে ফিরে এসো। তিনি পুত্রদেরকে এ কাজে উৎসাহিত করার জন্য আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত ও রহমতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং বললেন, আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে কখনও হতাশ হতে নেই। কারণ হতাশা বা নিরাশা কুফরের নিদর্শন।

আল্লাহর আশিস বা রহমতের ব্যাপারে নিরাশ হতে নেই। নবী-রাসূল এবং অলী আউলিয়াগণ সব সময় মানুষকে আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে আশাবাদী করতেন। পথভ্রষ্ট কাফের মুশরিকরাই মানুষকে হতাশায় নিমজ্জিত করে। তাই যে কোনো কাজের ব্যাপারে মানুষকে উদ্যোগী হতে হবে, তার কর্ম ও চেষ্টা থাকতে হবে। তাহলেই আল্লাহর বিশেষ সাহায্য তার কাজকে সহজ করতে সহায়ক হবে।

এ সূরার ৮৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَلَمَّا دَخَلُوا عَلَيْهِ قَالُوا يَا أَيُّهَا الْعَزِيزُ مَسَّنَا وَأَهْلَنَا الضُّرُّ وَجِئْنَا بِبِضَاعَةٍ مُزْجَاةٍ فَأَوْفِ لَنَا الْكَيْلَ وَتَصَدَّقْ عَلَيْنَا إِنَّ اللَّهَ يَجْزِي الْمُتَصَدِّقِينَ

"তারা যখন ইউসুফের নিকট উপস্থিত হলো, তখন বলল, হে আজিজ! আমরা ও আমাদের পরিবার-পরিজন বিপন্ন হয়ে পড়েছি এবং আমরা (গম ক্রয়ের জন্য) সামান্য মূল্য সঙ্গে এনেছি। আপনি আমাদের রসদ পূর্ণমাত্রায় দিন এবং আমাদেরকে কৃপা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাতাগণকে পুরস্কৃত করে থাকেন।" (১২:৮৮)

তৃতীয়বার যখন তারা মিশরে গেল,তখন তারা অত্যন্ত অনুনয়-বিনয় করে হযরত ইউসুফকে বলল, আমরা দুর্ভিক্ষের কারণে ভীষণভাবে বিপন্ন হয়ে পড়েছি। এজন্য খাদ্য বা রসদ কেনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারা আবদার করল,প্রথমবার যেমন তাদের পূর্ণ অর্থ ফেরত দেয়া হয়েছিল এবার যেন অনুগ্রহ করে অর্ধেক মূল্য মাফ করে দেয়া হয়।

অভাব এবং দারিদ্র্যের কারণে অনেক সময় মানুষের দম্ভ ও অহংকার চূর্ণ হয়ে যায়। হযরত ইউসুফের বৈমাত্রেয় ভাইদের এক সময় খুব অহংকার ছিল। তারা দম্ভভরে বলতো, আমরা অত্যন্ত শক্তিশালী ও সামর্থবান। বাবা আমাদেরকে গুরুত্ব না দিয়ে ভুল করছেন। কিন্তু দেখা গেল, এক সময় এই ভাইয়েরা অভাবের তাড়নায় অর্ধেক মূল্যে খাদ্য পাওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করতে বাধ্য হচ্ছে।

৮৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

  قَالَ هَلْ عَلِمْتُمْ مَا فَعَلْتُمْ بِيُوسُفَ وَأَخِيهِ إِذْ أَنْتُمْ جَاهِلُونَ

"ইউসুফ বলল, তোমরা কি জান ইউসুফ ও তার সহোদরের প্রতি তোমরা কিরূপ আচরণ করেছিলে, যখন তোমরা ছিলে অপরিণামদর্শী।" (১২:৮৯)

ভাইদের অনুনয়-বিনয় এবং দুরবস্থা দেখে হযরত ইউসুফের মন আবেগে উদ্বেগ হয়ে উঠল। তিনি আর পারলেন না নিজের পরিচয় গোপন রাখতে। তাই তিনি এক রহস্যময় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ভাইদেরকে চমকে দিলেন। তিনি এভাবে বললেন না যে, আমি ইউসুফ আর তোমরা আমার সঙ্গে কি অন্যায় করেছিলে বরং তিনি বললেন, তোমাদের কি মনে আছে যে, অজ্ঞতা ও অপরিণামদর্শীতার কারণে তোমরা তোমাদের ভাই ইউসুফ ও তার সহোদরের সঙ্গে কি আচরণ করেছো? তিনি এই প্রশ্নের মাধ্যমে এটাই বুঝাতে চাইলেন যে, তাদের সব অপকর্মের ব্যাপারে তিনি ওয়াকিবহাল। কাজেই এই অভাব বা দুরবস্থার মধ্যে তারা যদি তাদের অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয় তাহলে আল্লাহর দরবারে বিনত মস্তকে তাদের তাওবা করা উচিত। এজন্য তিনি তাদের প্রতি অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করলেন। বুঝাতে চাইলে, যা করেছো, তাতে তোমাদের তেমন হাত ছিল না। অজ্ঞতা এবং শয়তানের কুপ্ররোচনায় তোমরা সেদিন ভুল করেছিলে।

হযরত ইউসুফ (আ.) মিশরের অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও ভাইদের নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিশোধ গ্রহণের চিন্তাই করলেন না। বরং তিনি অত্যন্ত বিনীতভাবে বৈমাত্রেয় ভাইদের অভাব অনটন এবং পরকালীন মুক্তির পথ প্রশস্ত করার উদ্যোগ নিলেন। তাদেরকে অনুগ্রহ করলেন এবং তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। এটাই ইসলামের শিক্ষা। এটাই নবী-রাসূলদের আদর্শ। মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ কখনো নিতে হয় না।