সূরা হুদ;(৭ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা হুদ;(৭ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 12:16:59 3-10-1403

সূরা হুদ; আয়াত ২৫-২৮

সূরা হুদের ২৫ ও ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُبِينٌ (25) أَنْ لَا تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّهَ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ أَلِيمٍ

"নিশ্চয়ইই আমি নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। (তিনি বলেছিলেন) আমি তোমাদের জন্য প্রকাশ্য সতর্ককারী।” (১১:২৫)

“যাতে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অপর কিছুর উপাসনা না কর। আমি তোমাদের জন্য এক যন্ত্রণাদায়ক দিনের শাস্তি আশঙ্কা করি।” (১১:২৬)

এই আয়াতে হযরত নূহ (আ.) এর রেসালত এবং তার সম্প্রদায়ের প্রতি একত্ববাদের আহ্বান ও এর পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। তিনি মূর্তি পুজার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন এবং নিজ সম্প্রদায়কে এক সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বছরের পর বছর এমনকি যুগের পর যুগ অতিক্রান্ত হলেও খুব অল্প সংখ্যক মানুষ তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। ফলে এক পর্যায়ে তিনি নির্বোধ ও সত্য বিমুখ ঐসব মানুষের শাস্তি কামনা করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। তার ঐ অভিশাপের ফলে শুরু হয়ে যায় দুনিয়া জুড়ে এক মহাপ্লাবনের। ওই প্লাবনে হযরত নূহের অনুসারী মুমিনরা ছাড়া বাদবাকী সব মানুষ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। নবী রাসূল বা আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষরা অনর্থক কিছু বলেন না। তাদের হুমকি বা সতর্কবাণী খুব গুরুত্বের সাথেই গ্রহণ করা উচিত। হযরত নূহ (আ.) যুগ যুগ ধরে মানুষের জন্য সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু বেশীর ভাগ মানুষ তাতে কর্ণপাত করেনি। এর পরিণতি তাদেরকে ভোগ করতে হয়েছিল। পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসেছেন, তাদের সকলেই তাওহীদ বা একত্ববাদের বাণী প্রচার করেছেন। তারা মানুষকে এক সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করতে বলেছেন এবং শিরক বা মুর্তিপুজার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।

এই সূরার ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

فَقَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَوْمِهِ مَا نَرَاكَ إِلَّا بَشَرًا مِثْلَنَا وَمَا نَرَاكَ اتَّبَعَكَ إِلَّا الَّذِينَ هُمْ أَرَاذِلُنَا بَادِيَ الرَّأْيِ وَمَا نَرَى لَكُمْ عَلَيْنَا مِنْ فَضْلٍ بَلْ نَظُنُّكُمْ كَاذِبِينَ

"তার সম্প্রদায়ের প্রধান ব্যক্তিরা যারা ছিল অবিশ্বাসী কাফির, তারা বললো-আমরা তোমাকে তো আমাদের মতই একজন মানুষ দেখছি। আমরা দেখছি যারা আমাদের মধ্যে অধম তারাই অনুধাবন না করে তোমার অনুসরণ করছে এবং আমরা আমাদের ওপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব দেখছি না বরং আমরা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করি।" (১১:২৭)

পৃথিবীতে যত নবী রাসূলের আগমন ঘটেছে, প্রত্যেকেই তৎকালীন সমাজের প্রতাপশালী ব্যক্তিদের বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েছেন। সমাজের প্রতাপশালী ব্যক্তিরা সব সময় নবী রাসূলদেরকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং একচ্ছত্র ক্ষমতার ব্যাপারে হুমকি হিসাবে বিবেচনা করেছে। মানুষ নবী রাসূলদের আনুগত্য করলে সমাজে তাদের একচ্ছত্র প্রভাব ও কর্তৃত্ব খর্ব হবে এই ভেবে তাদের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। এ প্রসঙ্গে এই পবিত্র আয়াতে বলা হয়েছে, হযরত নূহ (আ.) এবং তার অনুসারীদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তৎকালীন সমাজের নেতারা সাধারণ মানুষকে আল্লাহর বিধান গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখার কৌশল গ্রহণ করেছিল। তারা প্রচার করেছিল নূহ তো আমাদের মতই একজন মানুষ আমাদের ওপর তার কি শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে যে, তার আনুগত্য করতে হবে?

একটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সকল নবী-রাসূলই স্পষ্ট করে বলেছেন, আমরাও অন্যদের মত মানুষ, ফেরেশতা নই। কিংবা (আল্লাহ মাফ করুক) আমরা সৃষ্টিকর্তার সন্তানও নই। আমাদের সাথে অন্যান্য মানুষের পার্থক্য হচ্ছে, আমাদের ওপর ওহী বা আল্লাহর প্রত্যাদেশ বাণী আসে, আর আমরা এই ঐশী বাণী হুবহু মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছি। অবিশ্বাসী কাফিররা হযরত নূহ (আ.) এর অনুসারীদেরকে হেয় করার জন্য বলতো ওরা মুর্খ এবং স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। সমাজের নিম্ন শ্রেণীর এসব মানুষের স্বীকৃতি ও আনুগত্য আপনার নব্যুয়তের সত্যতার প্রমাণ হতে পরে না। আসলে সব সময়ই সমাজের দুর্বল শ্রেণী সত্য গ্রহণে অগ্রগামী হয়েছে। এর কারণ বিত্তবানদের প্রতাপ এবং নিস্পেষণের হাত থেকে নিস্কৃতি লাভের জন্য গরীব ও দুর্বল মানুষ নবী রাসূলদের আনুগত্যের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হয়েছে।

যাইহোক, যারা সত্য দ্বীনকে গ্রহণ করতে চায়নি, তারা সব সময়ই নানা বাহানা দাঁড় করিয়েছে। নবী-রাসূলদেরকে তারা জাদুকর এবং আল্লাহর বাণীকে রূপকথা বলতেও তারা দ্বিধা করেনি। এই আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলতে পারি যে, পার্থিব জগতের প্রতি যার মোহ যত কম, সত্য দ্বীনের প্রতি এবং আল্লাহর প্রতি তার আকর্ষণ ততবেশী।

সূরা হুদের ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

قَالَ يَا قَوْمِ أَرَأَيْتُمْ إِنْ كُنْتُ عَلَى بَيِّنَةٍ مِنْ رَبِّي وَآَتَانِي رَحْمَةً مِنْ عِنْدِهِ فَعُمِّيَتْ عَلَيْكُمْ أَنُلْزِمُكُمُوهَا وَأَنْتُمْ لَهَا كَارِهُونَ

"নূহ (আ.) বললেন, হে আমার জাতি! দেখ তো আমি যদি আমার পালনকর্তার পক্ষ থেকে স্পষ্ট নিদর্শনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকি এবং তিনি যদি তার পক্ষ থেকে আমাকে অনুগ্রহ দান করে থাকেন, আর তা যদি তোমাদের চোখে না পড়ে, তাহলে আমি কি তা তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই চাপিয়ে দিতে পারি ?"(১১:২৮)

হযরত নূহ (আ.) কাফিরদের তিরস্কারকে ভ্রুক্ষেপ না করে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তাদেরকে বললেন, যদিও আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ, তারপরও আমি নব্যুয়তের যে দাবি করছি তার পক্ষে সু্স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। আমার হাতে মোজেজা বা অলৌকিক কাজ প্রদর্শনের ক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া আমার আহ্বানের পেছনে শক্তিশালী এবং অকাট্য যুক্তি রয়েছে যা বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা অগ্রাহ্য করতে পারবে না। আমি যা বলছি তা আমার কথা নয়, বরং আমি তোমাদেরকে শিরক বা অংশীবাদের কদর্যতা থেকে মুক্ত করে আল্লাহমূখী করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। মহান সৃষ্টিকর্তা আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং রেসালতের কঠিন দায়িত্ব আমার কাঁধে অর্পন করেছেন। তবে আমি কিংবা সৃষ্টিকর্তা কোন কিছু তোমাদের উপর চাপিয়ে দেব না। কারণ সৃষ্টিকর্তা মানুষের বিচার বুদ্ধি এবং বিবেচনা করার ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। নবী-রাসূলগণ অনর্থক এবং অযৌক্তিক কোন কথা বলেন না। তাদের প্রতিটি কথাই যুক্তি ও প্রমাণ সাপেক্ষ। ফলে জ্ঞানী ব্যক্তিরাই সে দিকে বেশী আকৃষ্ট হয়।

এই আয়াত থেকে আরেকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে,ধর্মীয় বিশ্বাস কারো ওপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। মানুষই একমাত্র সৃষ্টি যার জ্ঞান ও বিচার বিবেচনার ক্ষমতা রয়েছে, তাই আল্লাহ চান মানুষ তার জ্ঞান ও বিচার-বুদ্ধির মাধ্যমে সত্যকে গ্রহণ করুক।