সূরা হুদ;(১৩তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা হুদ;(১৩তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 10:4:28 3-10-1403

সূরা হুদ; আয়াত ৫০-৫৬

সূরা হুদের ৫০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا مُفْتَرُونَ

"আদ জাতির প্রতি আমি তাদের ভাই হুদকে প্রেরণ করেছি। তিনি (তাদেরকে) বললেন, হে আমার জাতি! আল্লাহর বন্দেগী কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন উপাস্য নেই, তোমরা তো কেবল মিথ্যা রচনাকারী।" (১১:৫০)

হযরত নূহ (আ.) ও তার অনুসারীদের বিবরণ দেয়ার পর এই আয়াত থেকে হযরত হুদ (আ.) ও তার সম্প্রদায়ের বর্ণনা শুরু হয়েছে। আর এজন্যই এই সূরাটি পরিচিত হয়েছে ‘হুদ’ নামে। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, হযরত নূহ (আ.) মৃত্যুর আগে তার অনুসারীদেরকে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুর পর অনেক বছর কোন নবী-রাসূলের আগমন ঘটবে না। ফলে পৃথিবীতে আগুন বা খোদাদ্রোহী শক্তির উত্থান ঘটবে, এরপর আমার বংশ ধারা থেকে একজন আগমন করবেন যিনি মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান জানাবেন এবং তাগুতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন আর তার নাম হবে হুদ।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,

প্রথমতঃ সকল নবী-রাসূল একত্ববাদের প্রচার করেছেন। তাদের কথার মর্মার্থ এক ও অভিন্ন, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা এক এবং একক, কেবল তারই উপাসনা করতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর সাথে শিরক করা বা তার অংশী স্থাপন করার অর্থ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তাকে অপমান করা। শিরকের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ এককভাবে এই বিশ্বজগত পরিচালনা করতে সক্ষম নন। তাই তার জন্য শরীক বা অংশীদার প্রয়োজন। ঐশী ধর্মগুলো এবং সকল নবী রাসূল শিরক বা অংশীবাদকে অমার্জনীয় পাপ বলে মানবজাতিকে সতর্ক করে দিয়েছেন।

সূরা হুদের ৫১ ও ৫২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

يَا قَوْمِ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى الَّذِي فَطَرَنِي أَفَلَا تَعْقِلُونَ (51) وَيَا قَوْمِ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِدْرَارًا وَيَزِدْكُمْ قُوَّةً إِلَى قُوَّتِكُمْ وَلَا تَتَوَلَّوْا مُجْرِمِينَ

"হে আমার সম্প্রদায়! আমি সত্য ধর্ম প্রচারের জন্য তোমাদের নিকট শ্রমফল কামনা করি না, আমার শ্রমফল রয়েছে তারই নিকট যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি অনুধাবন করবে না? (১১:৫১)

“হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তার দিকে প্রত্যাবর্তন কর,তিনি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে বৃষ্টিধারা প্রেরণ করবেন এবং তোমাদেরকে আরও শক্তি দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করবেন। আর তোমরা অপরাধী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না।" (১১:৫২)

শিরক‌ বর্জন এবং একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপনের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি হযরত হুদ (আ.) তার সম্প্রদায়কে পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং তাওবা করতে বলেছেন। কারণ এর ফলে মানুষের অন্তর পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র হয় এবং আল্লাহর বিশেষ কৃপা লাভের পথ সুগম হয়। এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, পাপের জন্য তওবা এবং ক্ষমা প্রার্থনার ফলে খরা ও দুর্ভিক্ষের মত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া য়ায়। পাশাপাশি আল্লাহর বিশেষ রহমত স্বরূপ পরিমিত বৃষ্টিপাত হয়, যার পরিণতিতে ফসল ভালো উৎপন্ন হয় যা সমাজ ও মানুষের মনে বাড়তি শক্তি যোগায়। একজন মানুষ যখন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং অতীত পাপের জন্য তওবা করে তখন আল্লাহ ইহজগতেও তাকে পুরস্কৃত করেন। পার্থিব পুরস্কার হিসাবে আল্লাহ পাক তার ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করেন এবং সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তি দান করেন। মানুষকে আত্মিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ কৃপা লাভের যোগ্য করে তোলার জন্যই যুগে যুগে নবী-রাসূলদের আগমন হয়েছে। তারা ব্যক্তি ও সমাজকে পরিশুদ্ধ করা এবং তাওহীদবাদী আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

এই সূরার ৫৩,৫৪ ও ৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

قَالُوا يَا هُودُ مَا جِئْتَنَا بِبَيِّنَةٍ وَمَا نَحْنُ بِتَارِكِي آَلِهَتِنَا عَنْ قَوْلِكَ وَمَا نَحْنُ لَكَ بِمُؤْمِنِينَ (53) إِنْ نَقُولُ إِلَّا اعْتَرَاكَ بَعْضُ آَلِهَتِنَا بِسُوءٍ قَالَ إِنِّي أُشْهِدُ اللَّهَ وَاشْهَدُوا أَنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ (54) مِنْ دُونِهِ فَكِيدُونِي جَمِيعًا ثُمَّ لَا تُنْظِرُونِ

 “তারা বললো, হে হুদ!  তুমি আমাদের নিকট কোন স্পষ্ট প্রমাণ আননি,তোমার কথায় আমরা আমাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করব না এবং আমরা তোমার ওপর বিশ্বাস করি না।” (১১:৫৩)

“আমরাতো এটা বলি যে,আমাদের উপাস্যদের মধ্যে কেউ তোমার ওপর অশুভ ছায়া ফেলেছে। তিনি বললেন,আমি আল্লাহকে সাক্ষী করছি এবং তোমরাও সাক্ষী হও যে, তোমরা যাকে আল্লাহর অংশী কর,তাদের ব্যাপারে আমি বিতৃষ্ণ।”(১১:৫৪)

“আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা সকলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কর এবং আমাকে কোন অবকাশ দিও না।” (১১:৫৫)

হযরত হুদ (আ.) যখন এক আল্লাহর উপাসনা করার জন্য এবং অতীত পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানালেন, তখন সমাজের অধিকাংশ মানুষই তার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করলো। তারা সোজাসুজি বলে দিল, আমরা আমাদের বাবা-দাদার ধর্ম, মূর্তিপুজা এসব কিছুই বাদ দিতে পারব না। আর তোমার দাবিও আমাদের বিশ্বাস হয় না। বরং আমাদের মনে হয়, দেব-দেবীর বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে তোমার ওপর হয়তো তাদের কুপ্রভাব পড়েছে। তাই তোমার নিশ্চয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে এবং উল্টো-পাল্টা বলে যাচ্ছো। সত্যের আহ্বানের ব্যাপারে মানুষের এই প্রতিক্রিয়া চিরাচরিত। কুসংস্কার ও বিভ্রান্তিতে নিপতিত মানুষ সবসময় সত্যকে প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখেছে এবং ঐশী বাণী ও আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচারণে লিপ্ত হয়েছে। কী অদ্ভুত! যারা মাটি ও কাঠখড়ির তৈরি মুর্তি এবং অন্যন্য সৃষ্ট জীবের পুজা অর্চনা করতো তারাই নবী-রাসূলদের যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত দাবির পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ দাবি করে বসতো। প্রত্যেক নবী-রাসূল এমনকি যারাই সমাজের কুসংস্কার ও বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, তাদেরকেই প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অপবাদ ও বাধা বিপত্তির দুর্গম প্রাচীর ডিঙিয়ে তারা মানব সভ্যতাকে আলো দান করেছেন। জগতকে সভ্যতার আলোয় উদভাসিত করতে নবী-রাসূল এবং অন্যান্য সমাজ সংস্কারককে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে এবং সেই পথ যে কখনো মসৃন ছিল না তা বোধগম্য।

এই সূরার ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

  إِنِّي تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ رَبِّي وَرَبِّكُمْ مَا مِنْ دَابَّةٍ إِلَّا هُوَ آَخِذٌ بِنَاصِيَتِهَا إِنَّ رَبِّي عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

"আমি নির্ভর করি আমার ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর ওপর। এমন কোন জীব-জন্তু নেই যে তার পূর্ণ আয়ত্তাধীন নয়। আমার প্রতিপালক সরল পথে আছেন।" (১১:৫৬)

মুশরিকদের নানা অপবাদ ও ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে হযরত হুদ (আ.) বললেন, তোমরা সর্বশক্তি দিয়ে যত পার আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কর। তবে এটা মনে রেখ যে, আমি আমার প্রতিপালক আল্লাহর উপর নির্ভর করি। তিনি শুধু আমার কেন, সকলেরই তিনি স্রষ্টা ও প্রতিপালক। তোমরা এটা মনে কর না যে, তিনি শুধু আমারই সৃষ্টা এবং তোমাদের ওপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই! এটা জেনে রাখা উচিত যে, অতি ক্ষুদ্র থেকে সর্ববৃহৎ যা কিছুই বিশ্ব জগতে বিদ্যমান সবই আল্লাহর পূর্ণ আয়ত্বে রয়েছে। তবে তিনি অন্যায্য কোন আচরণ করেন না। তার পথ সরল এবং তিনি ন্যায়বান।