সূরা হুদ;(১১তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা হুদ;(১১তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 10:36:2 3-10-1403

সূরা হুদ; আয়াত ৪২-৪৪

সূরা হুদের ৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَهِيَ تَجْرِي بِهِمْ فِي مَوْجٍ كَالْجِبَالِ وَنَادَى نُوحٌ ابْنَهُ وَكَانَ فِي مَعْزِلٍ يَا بُنَيَّ ارْكَبْ مَعَنَا وَلَا تَكُنْ مَعَ الْكَافِرِينَ

"পর্বত প্রমাণ তরঙ্গের মধ্যে এ (নৌকা) তাদের নিয়ে বয়ে চললো, নূহ তার পুত্রকে যে (তাদের ডাকে) পৃথক ছিল, ডেকে বললেন, হে বৎস! আমাদের সঙ্গে আরোহন কর এবং অবিশ্বাসী কাফিরদের সঙ্গী হয়ো না।" (১১:৪২)

হযরত নূহ (আ.) বহু বছর বেঁচে ছিলেন এবং মানুষকে সৎ পথে আনার জন্য তিনি বহুকাল ধরে চেষ্টা চালান। কিন্তু এক পর্যায়ে দেখা গেল তার সম্প্রদায়ের মুষ্টিমেয় মানুষ ছাড়া আর কেউ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে রাজী হলো না, বরং তারা হযরত নূহ (আ.) কে নিয়ে নানাভাবে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা শুরু করলো। ফলে গোঁয়ার্তুমি ও সত্যকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদের উপর ঐশী শাস্তি অনিবার্য হয়ে পড়ে। আল্লাহ তার বিশিষ্ট পয়গম্বর হযরত নূহ (আ.) কে বিষয়টি অবহিত করলেন। আল্লাহর নির্দেশ মত হযরত নূহ একটি বিশাল কিশতী বা নৌকা তৈরি করলেন। এরপর একদিন আল্লাহর শাস্তি দুনিয়াকে গ্রাস করলো, মাটি থেকে পানি উদগত হতে লাগলো এবং মুষলধারে বৃষ্টিপাত হতে থাকলো।

কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী- পাহাড়ের মত তরঙ্গ পৃথিবীকে গ্রাস করলো, মহাপ্লাবনে সব কিছুই তছনছ হয়ে গেল। হযরত নূহ (আ.) এর সঙ্গী সাথী এবং নৌকায় আশ্রিত অন্যান্য প্রাণী এই বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেলেন। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, হযরত নূহ (আ.) এর পুত্র কিনআন কাফিরদের দলভুক্ত হওয়ার কারণে নৌকায় উঠতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। কিন্তু যখন মহাপ্লাবনের প্রাদুর্ভাব দেখা দিল, হযরত নূহ (আ.) এর মনে যেন পিতৃস্নেহ জেগে উঠলো, তিনি স্বস্নেহে পুত্র কিনআনকে কাফিরদের দল ত্যাগ করে মুমিনদের কাতারে শামিল হওয়ার আহ্বান জানালেন। সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের যে দরদ এবং তাদের মঙ্গল ও ভবিষ্যতের ব্যাপারে পিতা মাতার যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, কিনআনের প্রতি হযরত নুহ (আ.)এর আহ্বানে তা ফুটে উঠেছে। এছাড়া অসৎ সঙ্গ বা কাফির মুশরিকদের সাথে ওঠা বসার কারণে যে কেউ এমনকি পয়গম্বরের সন্তানও যে পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে, এই আয়াত তারই উদাহরণ।

সূরা হুদের ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

قَالَ سَآَوِي إِلَى جَبَلٍ يَعْصِمُنِي مِنَ الْمَاءِ قَالَ لَا عَاصِمَ الْيَوْمَ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ إِلَّا مَنْ رَحِمَ وَحَالَ بَيْنَهُمَا الْمَوْجُ فَكَانَ مِنَ الْمُغْرَقِينَ

"(হযরত নূহের পুত্র) বললো,আমি এমন এক পর্বতে আশ্রয় নেব যা আমাকে প্লাবন হতে রক্ষা করবে। (হযরত নূহ) বললেন, আজ আল্লাহর বিধান হতে রক্ষা করার কেউ নেই। (রক্ষা পাবে) সেই যাকে আল্লাহ দয়া করবেন। এরপর তরঙ্গ ওদের বিচ্ছিন্ন করে দিল এবং (হযরত নূহের পুত্র) নিমজ্জিতদের অন্তর্ভুক্ত হলো।" (১১:৪৩)

হযরত নূহ (আ.) এর অবাধ্য পুত্র পিতার শেষ আহ্বান বিবেচনায় না এনে গোঁয়ার্তুমির আশ্রয় নেয়। সে ভেবেছিল, পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেলেই প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। তার এই বোধ ছিল না যে,আল্লাহ সর্বশক্তিমান, পাহাড়-পর্বত সব কিছু তারই নির্দেশের অধীন। আল্লাহ চাইলে পর্বত চূড়াও যে তার ধ্বংসের উপযুক্ত স্থান হয়ে উঠতে পারে এই বিশ্বাস তার ছিল না।

যাইহোক, পিতার সরল আহ্বান পুত্রের মনে রেখাপাত করতে ব্যর্থ হয়। ফলে ক্ষণিকের মধ্যেই এক উত্তাল তরঙ্গ নূহের পুত্রকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মৃত্যুর গহীনে। যারা প্রকৃত মুমিন তারা বিপদের সময় আল্লাহকে স্মরণ করেন। তারই সাহায্য কামনা করেন। আর যাদের মনে ঈমানের স্থিতি দুর্বল অথবা যারা মুশরিক তারা বিপদে পার্থিব বা জড়বস্তুকে অবলম্বন করে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করে। ফলে আল্লাহর সাহায্য থেকে তারা বঞ্চিত হয়।

সূরা হুদের ৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

  وَقِيلَ يَا أَرْضُ ابْلَعِي مَاءَكِ وَيَا سَمَاءُ أَقْلِعِي وَغِيضَ الْمَاءُ وَقُضِيَ الْأَمْرُ وَاسْتَوَتْ عَلَى الْجُودِيِّ وَقِيلَ بُعْدًا لِلْقَوْمِ الظَّالِمِينَ (44)

"(আল্লাহর শাস্তি ও কাফিরদের ধ্বংসের পর) বলা হলো,হে পৃথিবী! তুমি পানি শোষণ করে নাও এবং হে আকাশ! তুমি ক্ষান্ত হও,এরপর বন্যা প্রশমিত হলো এবং কার্য সমাপ্ত হলো,নৌকা জুদী পর্বতের ওপর স্থির হলো এবং বলা হলো- ধ্বংসই সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়ের পরিণাম।" (১১:৪৪)

এই আয়াতে বিশ্ব ইতিহাসের একটি বিরল ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে,হযরত নূহ (আ.) এর সময়কার মহাপ্লাবনের সত্যতা এখন অনস্বীকার্য। ঐ মহাপ্লাবনে সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যায় এবং সৎ ও ঈমানদার মানুষের মাধ্যমে পুনরায় পৃথিবীতে মানুষের বংশ বিস্তার ঘটে। পবিত্র কুরআনে এই ঘটনাটি আল্লাহর শাস্তি হিসাবে পরিণত হয়েছে। হযরত নূহের নৌকা যে জুদি পর্বতে এসে ভিড়েছিল তা কোথায় অবস্থিত সে ব্যাপারে মুফাসসিরদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কারো মতে, জুদী পর্বত তুরস্কের আরারাত পর্বতমালার অংশ। আবার কেউ মনে করেন ইরাকের মুসেলের আশেপাশে এই পর্বতটি অবস্থিত। কোন কোন মুফাসসির ভিন্ন মতও পোষণ করেন। হযরত নূহ (আ.) এর সময়কার এই ঘটনা থেকে মানুষের শিক্ষা নেয়া উচিত। অন্যায় পাপাচার এবং সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করার পরিণতি যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা এই ঘটনা থেকেই উপলদ্ধি করা যায়। এছাড়া বন্যা ও ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের পাপের পরিণতিতেই হয়ে থাকে তাও এ ঘটনা থেকে আমরা উপলদ্ধি করতে পারি।