সূরা হুদ; আয়াত ৩৮-৪১
সূরা হুদের ৩৮ ও ৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَيَصْنَعُ الْفُلْكَ وَكُلَّمَا مَرَّ عَلَيْهِ مَلَأٌ مِنْ قَوْمِهِ سَخِرُوا مِنْهُ قَالَ إِنْ تَسْخَرُوا مِنَّا فَإِنَّا نَسْخَرُ مِنْكُمْ كَمَا تَسْخَرُونَ (38) فَسَوْفَ تَعْلَمُونَ مَنْ يَأْتِيهِ عَذَابٌ يُخْزِيهِ وَيَحِلُّ عَلَيْهِ عَذَابٌ مُقِيمٌ
"হযরত নূহ (আল্লাহর নির্দেশে) নৌকা নির্মাণ করতে লাগলেন এবং তার সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা যখন তাঁর পাশ দিয়ে যেত, তখন তারা তাঁর বিদ্রুপ করতো। তিঁনি (তাদের বিদ্রুপের জবাবে) বলতেন,তোমরা যদি আমাদেরকে উপহাস কর, তাহলে আমরাও তদ্রুপ তোমাদেরকে উপহাস করবো।” (১১:৩৮)
“তোমরা অচিরেই জানতে পারবে কার ওপর লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আসবে ও স্থায়ী শাস্তি কার জন্য অবশ্যম্ভাবী।" (১১:৩৯)
সুদীর্ঘকাল সত্যের দাওয়াত প্রচারের পর যখন মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া বাকীরা হযরত নূহ (আ.)এর কথা বিশ্বাস করলো না তখন তিনি হতাশ হয়ে অবিশ্বাসীদের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে অনুযোগ করলেন এবং তাদের জন্য শাস্তি কামনা করলেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত নূহের দোয়া কবুল করলেন। হযরত নূহ (আ.) আল্লাহর শাস্তি অর্থাৎ প্রলয়ঙ্করী প্লাবনের বিষয়ে অবহিত হলেন এবং মুমিন বিশ্বাসী ও অন্যান্য জীব-জন্তুর বংশধারা রক্ষার জন্য একটি জাহাজ তৈরির জন্য তিনি আদিষ্ট হলেন।
এই আয়াতে বলা হয়েছে, হযরত নূহ (আ.) যখন বড় নৌকা বা জাহাজ তৈরি করতে শুরু করলেন, তখন তার সম্প্রদায়ের লোকজন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে বলতো, জীবনভর পয়গম্বরী করে এখন নৌকা ব্যবসায়ী হয়েছো। তারা আরো বলতো, ‘পাগলে কিনা করে’, ‘মরুভূমিতে জাহাজ বানাচ্ছে’- ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ ধরনের ব্যঙ্গ বিদ্রুপে হযরত নূহ (আ.) মনে কষ্ট পেতেন। তাই তিনিও তাদেরকে বলতেন, এমন দিন আসবে যে দিন আমরা সবাই জাহাজে আরোহন করব এবং তোমাদেরকে উপহাস করব। সেদিন আমরা দেখব কিভাবে তোমরা নিমজ্জিত হচ্ছো। তবে এটাও জেনে রাখ, যা কিছু ঘটবে তা তোমাদের জন্য দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী শাস্তি মাত্র। আখেরাতের চিরস্থায়ী শাস্তি তো থেকেই যাচ্ছে। আসলে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা অজ্ঞ-মূর্খ মানুষের কাজ। জ্ঞানী ব্যক্তিরা কখনো তা করতে পারে না। এছাড়া বিজ্ঞ বা ধর্মীয় ব্যক্তিদের বক্তব্য বা নির্দেশনা কখনো উপহাস করতে নেই। তেমনী শত্রু পরে সমালোচনা বা বিদ্রুপে ভ্রুক্ষেপ করা ঠিক নয়।
সূরা হুদের ৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
حَتَّى إِذَا جَاءَ أَمْرُنَا وَفَارَ التَّنُّورُ قُلْنَا احْمِلْ فِيهَا مِنْ كُلٍّ زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ وَأَهْلَكَ إِلَّا مَنْ سَبَقَ عَلَيْهِ الْقَوْلُ وَمَنْ آَمَنَ وَمَا آَمَنَ مَعَهُ إِلَّا قَلِيلٌ
"অবশেষে আমার আদেশ এলে ভূপৃষ্ঠ প্লাবিত হলো, আমি বললাম, এতে প্রত্যেক জীবের এক এক জোড়া উঠিয়ে নাও এবং যাদের বিরুদ্ধে পূর্ব সিদ্ধান্ত হয়েছে তারা ব্যতীত তোমার পরিবার পরিজনকে এবং যারা বিশ্বাস করেছে তাদেরকে উঠিয়ে নাও, যদিও খুব অল্প সংখ্যক লোকই তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল।" (১১:৪০)
নৌকা তৈরির কাজ শেষ হলে আল্লার নির্দেশে ভূপৃষ্ঠ উচ্ছসিত হয়ে পানি নির্গত হতে লাগলো। পাশাপাশি মুষলধারে বৃষ্টিপাত হতে থাকলো। অল্প সময়েই হযরত নূহের কিশতি পানিতে ভাসমান হয়ে উঠলো আল্লাহ প্রত্যেক জীবের এক জোড়া করে কিশতিতে উঠানোর নির্দেশ দিলেন। এ ছাড়া হযরত নূহ (আ.) এর পরিবার-পরিজন ও মুমিন বিশ্বাসীরা কিশতিতে আরোহন করলেন। তবে হযরত নূহ (আ.) এর স্ত্রী ও পুত্র কেন্আন নৌকায় উঠতে অস্বীকার করেছিল। কারণ তারা কখনো পয়গম্বরের ওপর বিশ্বাসী ছিল না। ধর্মীয় বন্ধন যে পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে প্রাধান্য পাবে, এ আয়াতেও সে কথারই প্রমাণ পাওয়া যায়। হযরত নূহ (আ.) এর স্ত্রী ও পুত্র অবিশ্বাসী কাফির হওয়ার কারণে কিশতিতে ওঠার অনুমতি পায়নি। যারা আল্লাহ ও তার পয়গম্বরের উপর ঈমান এনেছিল কেবল তারাই কিশতিতে উঠার অনুমতি পেয়েছিলেন।
সূরা হুদের ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَقَالَ ارْكَبُوا فِيهَا بِسْمِ اللَّهِ مَجْرَاهَا وَمُرْسَاهَا إِنَّ رَبِّي لَغَفُورٌ رَحِيمٌ
"হযরত নূহ (নৌকার আরোহীদের) বললেন,এতে আরোহন কর। এর গতি ও স্থিতি আল্লাহরই নামে। নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু।" (১১:৪১)
আল্লাহর গুজব বা ঐশী শাস্তিগুলোর আলামতগুলো সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর হযরত নূহ (আ.) মুমিনদেরকে নৌকায় উঠতে বললেন এবং আল্লাহর এই বিশেষ অনুগ্রহের কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, এই কিশতি আল্লাহর নির্দেশে চলা শুরু করেছে এবং তারই নির্দেশে তা পুনরায় থামবে। ফলে এর চলা ও থামানোর ক্ষেত্রে আমার কোন ভূমিকা নেই, এটি সম্পূর্ণ আল্লাহর মর্জি ও কুদরাতের অধীন।
প্রসঙ্গত: এখানে একটি কথা না বলে পারছি না। হাদিস শরীফে বিশ্ব নবী (সা.) এর পবিত্র বংশধর বা আহলে বাইতকে নূহ নবীর কিশতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আহলে বাইত হচ্ছে নূহ নবীর নৌকার মত, যে এতে আরোহন করবে সে মুক্তি পাবে আর যে এতে আরোহন করবে না সে নিমজ্জিত হবে। হ্যাঁ আহলে বাইত বা বিশ্বনবী (সা.) এর পবিত্র বংশধরদের ব্যাপারে এ ধরনের অনেক হাদিস রয়েছে, যা ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ বিন জুবাইর, আনাস বিন মালেক আবু সাঈদ খুদরীর মত বিখ্যাত ব্যক্তিরা বর্ণনা করেছেন।