সূরা হুদ;(৫ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা হুদ;(৫ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 9:41:44 3-10-1403

সূরা হুদ; আয়াত ১৭-১৯

সূরা হুদের ১৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন‍-

أَفَمَنْ كَانَ عَلَى بَيِّنَةٍ مِنْ رَبِّهِ وَيَتْلُوهُ شَاهِدٌ مِنْهُ وَمِنْ قَبْلِهِ كِتَابُ مُوسَى إِمَامًا وَرَحْمَةً أُولَئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ وَمَنْ يَكْفُرْ بِهِ مِنَ الْأَحْزَابِ فَالنَّارُ مَوْعِدُهُ فَلَا تَكُ فِي مِرْيَةٍ مِنْهُ إِنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يُؤْمِنُونَ

“যিনি অর্থাৎ পয়গম্বর (সা.) প্রভূর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নিদর্শন প্রাপ্ত হয়েছেন, এর সাথে রয়েছে প্রভূর পক্ষ থেকে একজন সাক্ষী এবং তার পূর্ববর্তী মুসা (আ.) এর গ্রন্থও এর সাক্ষী, যা ছিল পথ নির্দেশক ও রহমত স্বরূপ। তিনি কি এমন কারো সমতুল্য হতে পারেন যিনি এসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নন? (যারা সত্য সন্ধানী ) তারাই (এই কুরআনে) বিশ্বাস স্থাপন করেন। যারা (কুরআনকে) অস্বীকার করে নরকই হচ্ছে তাদের স্থান। সুতরাং আপনি এতে সন্দিগ্ধ হবেন না,নিঃসন্দেহে এটি আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ধ্রুব সত্য। যদিও অনেকেই তা বিশ্বাস করে না।” (১১:১৭)

ইসলামের প্রথম যুগে যারা পবিত্র কুরআনকে ঐশী গ্রন্থ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল তাদের মধ্যে মদীনার ইহুদীরা ছিল অন্যতম। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই ইহুদীরা কুরআনের সত্যতার ব্যাপারে বিভ্রান্তিকর নানা প্রশ্নের উদ্রেক করতো এবং বলে বেড়াত হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নব্যুয়তের দাবি সত্য নয়। এই আয়াতে এসব বিদ্বেষ পরায়ণ ইহুদী পণ্ডিতদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে,তাহলে কি তোমরা হযরত মুসার রেসালাত এবং তৌরাতের সত্যতা ও দাবিকে অস্বীকার করবে? হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর নব্যুয়তের দাবিকে কেন্দ্র করে এত বিস্ময়ের ভাব কেন দেখাচ্ছো, তৌরাতে কি শেষ নবীর আগমন বার্তা সুষ্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়নি? তাওরাতের ভাষ্য অনুযায়ী তোমরা ইহুদীরা কি শেষ নবীর আগমনের জন্য অপেক্ষা করছো না? সত্যিই যদি তোমরা তাওরাতে বিশ্বাসী হয়ে থাকো তাহলে তোমাদের উচিত হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে সর্বশেষ পয়গম্বর এবং কুরআনকে সর্বশেষ ঐশীগ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করা তা না হলে অন্যান্য অবিশ্বাসীদের মত তোমাদেরও স্থান হবে নরকে।

এই আয়াতে কুরআন ও শেষ নবীর সত্যতার সাক্ষী হিসেবে তাওরাতের কথা বলার পাশাপাশি নবী বংশের একজনকে এর সাক্ষী হিসেবে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত আলীর প্রতিই এই ইঙ্গিত করা হয়েছে। কারণ তিনিই শিশু বয়সে আল্লাহর রাসূলের সান্নিধ্য লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন এবং তাঁরই সরাসরি তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন । ফলে আল্লাহর রাসূলের সহচরদের মধ্যে একমাত্র হযরত আলীই হচ্ছেন একমাত্র ব্যক্তি যাকে ইসলাম পূর্ব যুগের কোন কদর্যতা স্পর্শ করতে পারেনি। সততা, ন্যায়পরায়নতা অবিচল বিশ্বাস এবং ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি হিসেবে যিনি ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে রয়েছেন।

হযরত আলীর মর্যাদা রাসূল্লাহর সাথে পারিবারিক বন্ধনের কারণে এ ধরনের দাবি যথার্থ নয়। আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্ভেজাল আনুগত্য এবং জ্ঞানদীপ্ত অন্তরের কারণেই খোদা প্রদত্ত মর্যাদার উচ্চাসনে তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

শুধুমাত্র আত্মীয়তা বা পারিবারিক বন্ধন এক্ষেত্রে বিবেচিত হয়নি। আত্মীয়তার গুরুত্বকে যদি বেশি দেয়া হতো তাহলে রাসূলের চাচা আবু লাহাবও ইসলামে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে স্থান করে নিতে সক্ষম হতেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঈমান না থাকার জন্য এবং ইসলামের বিরুদ্ধে শক্রর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কারণে আবু লাহাবের ধ্বংস কামনা করে পবিত্র কুরআনে একটি স্বতন্ত্র সূরাই অবতীর্ণ হয়েছে।

আয়াতটির শেষ ভাগে গুরুত্ব আরোপ করে বলা হয়েছে, অধিকাংশ মানুষের বিরোধিতা বা সত্য প্রত্যাখ্যানের কারণে মুসলমানদের উচিত হবে না নিজেদের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপারে সন্ধিগ্ধ হয়ে পড়া, কুরআন আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান এবং এই কিতাব সব ধরনের প্রক্ষেপ মুক্ত, এতে কোন সন্দেহ নেই।

অধিকাংশ মানুষের সমর্থন বা বিরোধীতা কোন বিশ্বাস বা চিন্তা দর্শনের সত্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। যেটি প্রত্যাদিষ্ট এবং যুক্তি ও বিবেক সম্মত তাই সত্য।

এই সূরার ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أُولَئِكَ يُعْرَضُونَ عَلَى رَبِّهِمْ وَيَقُولُ الْأَشْهَادُ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى رَبِّهِمْ أَلَا لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ (18) الَّذِينَ يَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا وَهُمْ بِالْآَخِرَةِ هُمْ كَافِرُونَ

“তাদের চেয়ে বড় যালিম কে হতে পারে যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে? এসব লোককে তাদের পালনকর্তার সামনে উপস্থিত করা হবে আর সাক্ষীগণ বলতে থাকবে, এরাই এদের প্রতিপালকের বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করেছিল। জেনে রাখ, যালেমদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত রয়েছে।” (১১:১৮)

“যারা আল্লাহর পথে বাধা দেয় আর তাতে দোষ ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়,এরাই আখেরাতকে অস্বীকার করে।” (১১:১৯)

আল্লাহর কোন নবীকে অস্বীকার করা বা নবুয়্যতের মিথ্যা দাবি করার অর্থ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করা। এই আয়াতে বলা হয়েছে, কেউ যদি যে কোন উপায়ে আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করে তাহলে অবশ্যই ইহলোকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। সে দিন কোন কিছু গোপন থাকবে না, গোপন করাও সম্ভব হবে না। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সকল সৃষ্টির ছোট বড় সব কর্মই স্পষ্ট। এছাড়া সেদিন অনেকেই অনেকের কর্মের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে।

পবিত্র কুরআনের অনেক আয়াত থেকে জানা যায় যে, কেয়ামতের দিন প্রত্যেক নবী এবং অনেক ওলী-আওলিয়া তাদের অনুসারীদের কর্মের সাক্ষী হবেন। এমনকি প্রত্যেক মানুষের সাথে থাকা দুই ফেরেশতা, মাটি, মানুষের অঙ্গ -প্রত্যঙ্গও সেদিন সাক্ষ্য দেবে। কাজেই কৃত কর্ম অস্বীকার করার কোন উপায় সেদিন থাকবে না।

এই আয়াত থেকে আমরা দুটো বিষয় বুঝে নিতে পারি :

এক. সমাজের বুদ্ধিজীবী,লেখক এবং চিন্তাবিদদের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, কারণ তাদের ভ্রান্ত দিক নির্দেশনায় বহু মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে পারে।

দুই. ইসলামের পথ অত্যন্ত স্পষ্ট এবং সহজ। ইসলামের শক্ররাই মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে,বেদআত ও নানা কুসংস্কারের প্রচলন ঘটায় এবং ধর্মের ব্যাপারে সন্দেহের সৃষ্টি করে।