সূরা ইউনুস;(১৭তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা ইউনুস;(১৭তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 7:27:31 3-10-1403

সূরা ইউনুস; আয়াত ৮৭-৯২

সূরা ইউনুসের ৮৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

 وَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى وَأَخِيهِ أَنْ تَبَوَّآَ لِقَوْمِكُمَا بِمِصْرَ بُيُوتًا وَاجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ قِبْلَةً وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ

"আমি মুসা ও তার ভাইকে প্রত্যাদেশ করলাম মিশরে তোমাদের সম্প্রদায়ের জন্য গৃহ স্থাপন কর এবং তোমাদের গৃহগুলোকে সামনা-সামনি বা সম্মুখবর্তী করে তৈরি কর, নামাজ প্রতিষ্ঠা কর এবং বিশ্বাসীদেরকে সুসংবাদ দাও।" (১০:৮৭)

হযরত মুসা (আ.) বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করার পর, তাদের সামাজিক সংস্কার ও পুনর্বাসনের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ আসে। মিশরে তাদের জন্য আবাসন গড়ে তোলার নির্দেশ আসে। তারা যাতে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক জীবন শুরু করতে পারে সেজন্য বলা হয়, তাদের ঘরবাড়িগুলো যেন একই অঞ্চলে পাশাপাশি বা সামনা-সামনি স্থাপন করা হয়। এই আয়াতের শেষভাগে যেহেতু নামাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে সেজন্য কোনো কোনো মুফাসসির 'কেবলা' শব্দের অর্থ করতে গিয়ে লিখেছেন, তাদের বাড়ি-ঘরগুলো কেবলামুখী করে তৈরি করার নির্দেশ এসেছিল যাতে বনি ইসরাইল সম্প্রদায় নিজেদের বাড়িতেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে পারে। তবে মুফাসসিরদের অনেকেই লিখেছেন, এখানে কেবলা শব্দের অর্থ হচ্ছে তাদের বাড়িঘরগুলো সামনা সামনি বা সম্মুখবর্তী করে তৈরি করতে বলা হয়েছিল।

নবী-রাসূলগণ মানুষের বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক সব ধরনের উন্নতি ও কল্যাণের দিকে নজর রাখবেন। মানুষ যাতে ইহকাল ও পরকালে শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে- আল্লাহর নবী ও রাসূলরা মানুষকে সে দিকেই পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন।

সূরা ইউনুসের ৮৮ ও ৮৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

  وَقَالَ مُوسَى رَبَّنَا إِنَّكَ آَتَيْتَ فِرْعَوْنَ وَمَلَأَهُ زِينَةً وَأَمْوَالًا فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا رَبَّنَا لِيُضِلُّوا عَنْ سَبِيلِكَ رَبَّنَا اطْمِسْ عَلَى أَمْوَالِهِمْ وَاشْدُدْ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُوا حَتَّى يَرَوُا الْعَذَابَ الْأَلِيمَ (88) قَالَ قَدْ أُجِيبَتْ دَعْوَتُكُمَا فَاسْتَقِيمَا وَلَا تَتَّبِعَانِّ سَبِيلَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ (89(

"মুসা বললো, হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গকে পার্থিব জীবনে শোভা ও সম্পদ দান করেছ। হে আমাদের প্রতিপালক, এসব দিয়ে ওরা মানুষকে তোমার পথ হতে বিচ্যুত করে। হে আমাদের প্রতিপালক, ওদের সম্পদ বিনষ্ট কর, ওদের হৃদয় মোহর করে দাও। ওরা তো কঠোর শাস্তি প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত বিশ্বাস করবে না।” (১০:৮৮)

“(আল্লাহ) বললেন, তোমাদের দু'জনের প্রার্থনা গৃহিত হলো। সুতরাং তোমরা দৃঢ় থাক এবং কখনও অজ্ঞদের পথ অনুসরণ করো না।" (১০:৮৯)

হযরত মুসা (আ.) ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে বহু দিন সত্যের দাওয়াত দিয়ে যান কিন্তু তারা হযরত মুসার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে নানা ধরনের অত্যাচার ও উতপীড়নের পথ বেছে নেয়। এক পর্যায়ে হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, হে আল্লাহ! ফেরাউন আজ যে সম্পদ ও ক্ষমতার বলে মানুষকে তোমার পথ থেকে বিচ্যুত করছে, তো তো তুমিই তাকে দিয়েছো, তাই তুমি তার সম্পদ ও প্রতাপ ধ্বংস করে দাও।

দীর্ঘ দিন চেষ্টার পর হযরত মুসা যখন বুঝলেন, ফেরাউন ও তার পরিষদবর্গ কোনভাবেই সতপথে ফিরে আসবে না এবং একত্ববাদের বাণী গ্রহণ করবে না, তখন তিনি এই দোয়া করেন। আল্লাহতায়ালা হযরত মুসা (আ.)-এর দোয়া কবুল করেন এবং ঈমানদারদেরকে দৃঢ় ও অবিচল থাকার নির্দেশ দেন।

বিভিন্ন বর্ণনায় দেখা যায়, হযরত মুসা (আ.)-এর এই অভিশাপ বা বদ-দোয়ার ৪০ বছর পর ফেরাউন ও তার দলবল সাগরে নিমজ্জিত হয়েছিল।

একমাত্র ধন-সম্পদ ও প্রতাপ প্রতিপত্তিই আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের প্রমাণ বহন করে না। কারণ আল্লাহ তায়ালা অনেক অবাধ্য এবং নিষ্ঠুর মানুষকেও এ জগতে ধন-সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি দান করে থাকেন। এই আয়াত থেকে আমরা আরেকটি জিনিস বুঝে নিতে পারি; তা হচ্ছে যারা সমাজে সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম করে তাদের সংশোধনের চেষ্টার পর ঈমানদাররা তাদের দোয়া ও প্রার্থনায় এসব জালেম, অত্যাচারীদের পতন কামনা করতে পারেন।

সূরা ইউনুসের ৯০, ৯১ ও ৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُودُهُ بَغْيًا وَعَدْوًا حَتَّى إِذَا أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ آَمَنْتُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا الَّذِي آَمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ (90) آَلْآَنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ (91) فَالْيَوْمَ نُنَجِّيكَ بِبَدَنِكَ لِتَكُونَ لِمَنْ خَلْفَكَ آَيَةً وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ عَنْ آَيَاتِنَا لَغَافِلُونَ (92(

"আমি বনি-ইসরাইলকে সমুদ্র পার করালাম, ফেরাউন ও তার সৈন্য বাহিনী বিদ্বেষ পরবশ হয়েও ন্যায়ের সীমা লংঘন কোরে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। পরিশেষে যখন সে নিমজ্জিত হলো, তখন বললো, বনি ইসরাইল যাতে বিশ্বাস করে আমিও তাতে বিশ্বাস করি যে, তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আত্মসমর্পনকারীদের অর্ন্তভুক্ত।” (১০:৯০)

“(তাকে সম্বোধন করে বলা হলো) এখন! এর আগে তো তুমি অমান্য করেছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অর্ন্তভুক্ত ছিলে। (১০:৯১)

“আজ আমি তোমার দেহ চড়া ভূমিতে রক্ষা করবো যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক। অবশ্য মানুষের মধ্যে অনেকেই আমার নিদর্শন সম্পর্কে উদাসীন।” (১০:৯২)

এই আয়াতে ফেরাউন ও তার অনুসারীদের প্রতি হযরত মুসা (আ.)-এর বদ দোয়া কিভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল সে ঘটনার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। হযরত মুসাকে উদ্দেশ করে এখানে বলা হয়েছে, যখন ফেরাউন ও তার দলবল তোমাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাড়া করে তখন আল্লাহ তায়ালা হঠাত নীল নদের মাঝখান দিয়ে রাস্তা করে দেন, তোমরা ওই অলৌকিক রাস্তা দিয়ে অনায়াসে নীল নদ পার হয়ে গেলে। কিন্তু ফেরাউন ও তার দল বল তোমাদেরকে তাড়া করে যখন ওই রাস্তা দিয়ে নীল নদের মাঝামাঝি পৌঁছে তখন তারা নিমজ্জিত হয়। আল্লাহ তায়ালা ভবিষ্যতে মানুষের জন্য নিদর্শনস্বরূপ ফেরাউনের মৃতদেহ গহীন নদী থেকে তুলে আনার ব্যবস্থা করেন।

লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এই ঘটনার সময় হযরত মুসা (আ.)-এর ধারণাই সত্য প্রমাণিত হয়। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ফেরাউন বলে ওঠে, আমি মুসার রবের প্রতি ঈমান আনলাম। কিন্তু আওয়াজ হলো, মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে কেন তওবা করছো?

এই আয়াত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা বজায় রাখা উচিত। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় বান্দাকে কখনও নিঃসঙ্গ অবস্থায় ছেড়ে দেবেন না। ঈমানদাররা যদি আল্লাহর রাস্তায় দৃঢ় ও অবিচল থাকতে পারে তাহলে জয় তাদের জন্য অনিবার্য।