সূরা আন'আম; আয়াত ১২৩-১২৫ (পর্ব-২৯)
সূরা আন’আমের ১২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا فِي كُلِّ قَرْيَةٍ أَكَابِرَ مُجْرِمِيهَا لِيَمْكُرُوا فِيهَا وَمَا يَمْكُرُونَ إِلَّا بِأَنْفُسِهِمْ وَمَا يَشْعُرُونَ
“আর এমনিভাবে আমি প্রত্যেক জনপদে অপরাধীদের জন্য কিছু সর্দার নিয়োগ করেছি-যেন তারা সেখানে চক্রান্ত করে। তাদের সে চক্রান্ত তাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই; কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না।” (৬:১২৩)
গত পর্বের আলোচনায় আমরা বলেছি আবু জাহলের মত মক্কার মুশরিক বা কাফের নেতারা সব সময়ই ইসলামের নবী (সা.) ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করত যাতে মুসলমানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়তে না পারে।
এই আয়াতে মহান আল্লাহ বিশ্বনবী (সা.) ও মুমিনদের বলছেন, আবু জাহলদের উপস্থিতি নতুন কোনো ঘটনা নয়। বরং সব যুগেই এ ধরনের লোকদের অস্তিত্ব ছিল যারা সত্যের আহ্বানের বিরোধিতা করেছে এবং সত্য-পন্থীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে।
মানুষ ভাল ও মন্দ যে কাজই করুক না কেন-তারা আল্লাহর কর্তৃত্বের আওতার মধ্যেই রয়েছে। আল্লাহর দেয়া শক্তি ছাড়া মানুষ কিছুই করতে পারে না। তাই এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, যেসব অপরাধী আল্লাহর বিধান বা সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তারা যেন এটা না ভাবে যে, আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করতে অক্ষম, কিংবা তারা আল্লাহর কর্তৃত্বের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
বরং আল্লাহ তাদেরকে যে চিন্তাশক্তি বা বোঝার ক্ষমতা দিয়েছেন তা যে কোনো সময় কেড়ে নিতে পারেন তিনি। অথচ খোদা-প্রদত্ত চিন্তাশক্তি ও উপলব্ধি ব্যবহার করেই তারা সত্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে মশগুল রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ এ বিধান দিয়েছেন যে, পার্থিব জগতে মানুষ তার ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করেই কাজ করবে। মানুষ যে পথ বেছে নেবে আল্লাহ তাকে ঠিক সেই পথেই সহায়তা করবেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হল:
এক. সমাজে অশান্তি ও দুর্নীতির মূল উৎস হল দুর্নীতিবাজ বা অসৎ নেতা এবং অর্থনৈতিক ও চিন্তাগত দিক থেকে অসৎ পথে ব্যবহৃত লোকেরা।
দুই. যে অন্যের জন্য গর্ত বা কুয়া খুঁড়ে সে নিজেই এর তলায় থাকে, অর্থাৎ যে অন্যকে ধোঁকা দেয়া সে নিজেই ধোঁকার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হয়।
সূরা আন’আমের ১২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَإِذَا جَاءَتْهُمْ آَيَةٌ قَالُوا لَنْ نُؤْمِنَ حَتَّى نُؤْتَى مِثْلَ مَا أُوتِيَ رُسُلُ اللَّهِ اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ سَيُصِيبُ الَّذِينَ أَجْرَمُوا صَغَارٌ عِنْدَ اللَّهِ وَعَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا كَانُوا يَمْكُرُونَ
“যখন তাদের কাছে কোন আয়াত বা ঐশী নিদর্শন পৌঁছে, তখন বলে, আমরা কখনই মানব না যে পর্যন্ত না আমাদেরও তা দেয়া হয়, যা আল্লাহর রসূলদের দেয়া হয়েছে। (হে নবী! আপনি তাদের বলুন) আল্লাহই সবার চেয়ে ভাল জানেন যে, কোথায় নিজের পয়গাম বা রেসালাত পাঠাতে হবে। যারা অপরাধ করছে, তারা শিগগিরই আল্লাহর কাছ থেকে লাঞ্ছনা ও কঠোর শাস্তি পাবে, তাদের চক্রান্তের কারণে।” (৬:১২৪)
আগের আয়াতে ইসলামের নবী (সা.)’র বিরোধীদের নানা ষড়যন্ত্র ও ধোঁকার কথা তুলে ধরার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে: মক্কার মুশরিকরা এ অজুহাতও দেখাত যে, আমাদের সম্পদ ও মান-মর্যাদা তাঁর চেয়ে বেশি যে দাবি করছে যে আল্লাহ তাঁকে মানুষের পথ প্রদর্শক হিসেবে নিয়োগ করেছেন। আল্লাহ কাউকে নবী হিসেবে নিয়োগ করতে চাইলে ধন-সম্পদ ও নেতৃত্বের মর্যাদার কারণে আমাদেরকেই এ পদে নিয়োগ দিতেন। অন্তত: মুহাম্মাদ (সা.)’র কাছে যে রকম ওহী বা ঐশী প্রত্যাদেশ নাজেল হয়েছে আমাদের কাছেও সেরকম কিছু নাজেল হত। এখন যেহেতু সেরকম কিছু হয়নি তাই আমরা কখনও মুহাম্মাদের প্রতি ঈমান আনব না ও তাঁকে নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেব না।
তাদের এ ধরনের অজুহাতকামীতার জবাবে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, কারা নবী-রাসূল হওয়ার যোগ্য তা আল্লাহই অন্য সবার চেয়ে ভাল জানেন। পার্থিব পদ-মর্যাদা ও ধন-সম্পদ যোগ্যতার লক্ষণ নয়। মানুষকে হেদায়াত বা সুপথ দেখানোর জন্য এমন কিছু যোগ্যতা দরকার যা দুনিয়া-পূজারি ও পদ-পূজারিদের মধ্যে থাকে না।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে বড় মনে করা ও বড় পদের অধিকার দাবী করা নবী-রাসূলদের দাওয়াত অমান্য করার অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। এ ধরনের মানসিকতা সত্যের মোকাবেলায় মানুষের মধ্যে দম্ভ সৃষ্টি করে।
দুই. মহান আল্লাহ দাম্ভিকদেরকে এ পৃথিবীতেই অপদস্ত করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন যাতে অন্যরা শিক্ষা নেয়।
সূরা আন’আমের ১২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
فَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يَهدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ وَمَنْ يُرِدْ أَنْ يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ كَذَلِكَ يَجْعَلُ اللَّهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ
“অতঃপর আল্লাহ যাকে হেদায়াত বা পথ দেখাতে চান,তার বুককে ইসলামের জন্যে খুলে দেন এবং (অসৎ স্বভাব ও কাজের জন্য) যাকে বিপথগামী করতে চান, তার বুককে (ঈমানের বরাবরে) বন্ধ ও অত্যধিক সংকীর্ণ করে দেন-যেন সে সবেগে আকাশে আরোহণ করছে। এমনি ভাবে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে না, আল্লাহ তাদেরকে কলুষতায় নিমগ্ন করেন।” (৬:১২৫)
এই আয়াতে আগের কয়েকটি আয়াতের বক্তব্যের উপসংহার টেনে বলা হয়েছে: মানুষের কুফরি ও ঈমানের চিহ্ন কেবল বাহ্যিক কিছু আচার-আচরণেই বোঝা যায় না, মানুষের মনের অবস্থাই ঈমান ও কুফরির পরিমাপদণ্ড। ঈমান হচ্ছে সত্যকে তথা আল্লাহ ও তাঁর বিধানকে মনে-প্রাণে মেনে নেয়া। অন্যদিকে কুফর হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত। তাই এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, যাদের মন সুস্থ, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন কেবল তারাই সত্যকে তথা আল্লাহ ও তাঁর বিধানকে মনে-প্রাণে মেনে নেয়। অন্যদিকে অসুস্থ আত্মা অসুস্থ দেহের মতই সবচেয়ে ভাল খাবারও গ্রহণ করতে পারে না।
এই আয়াতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বিষয়টি হল যারা সত্যকে মেনে নিতে চায় না তাদের অবস্থা হচ্ছে সেইসব মানুষের মত যারা আকাশের দিকে উঠতে চায়, কিন্তু অক্সিজেনের অভাবে তাদের শ্বাসযন্ত্র বন্ধ হয়ে আসে।
এ আয়াতের দু'টি শিক্ষণীয় দিক হল:
এক. সত্যকে মেনে নেয়ার জন্য মানসিক যোগ্যতা অর্জন জরুরি। যাদের মন সত্যকে মেনে নেয় তাদের মন ক্রমেই বড় হতে থাকে। মুমিনদের জন্য এটাও মহান আল্লাহর এক বড় অনুগ্রহ।
দুই. বিভ্রান্ত বা পথহারা ব্যক্তিরা বাহ্যিক দিক থেকে যত আরাম-আয়েশ বা বিত্ত-বৈভবের অধিকারীই হোক না কেন, বাস্তব সুখ তাদের নেই। তারা নানা রকম মানসিক চাপ ও অশান্তির শিকার।