সূরা আন'আম;(৩৪তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(৩৪তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 6:48:30 3-10-1403

সূরা আন'আম;(৩৪তম পর্ব)

সূরা আন'আম; আয়াত ১৪৫-১৪৯

সূরা আন’আমের ১৪৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ بَاغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ رَبَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

“(হে নবী!) আপনি বলে দিনঃ যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তার মধ্যে আমি কোন হারাম বা নিষিদ্ধ খাদ্য পাইনি, কিন্তু মৃত পশু বা জন্তু অথবা শরীর থেকে বেরিয়ে পড়া রক্ত অথবা শুকরের মাংস যা অপবিত্র বা অবৈধ; এ ছাড়াও যবেহ করা জন্তু যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়। অতপর যে  নিরুপায় হয়ে (বা ক্ষুধায় কাতর হয়ে) নাফরমানি করার ও উপভোগের উদ্দেশ্য ছাড়াই এ ধরনের খাবার খেতে বাধ্য হয় এবং সীমালঙ্ঘন করে না,(তার জন্য তা পাপ হবে না) নিশ্চয়ই আপনার পালনকর্তা ক্ষমাশীল দয়ালু।” (৬:১৪৫)

ইব্রাহিমী ধর্মগুলোর অনুসারী অধ্যুষিত অঞ্চলে কুসংস্কার ও কুপ্রথায় বিশ্বাসী মুশরিকরা কোনো কোনো খাদ্যকে হারাম বলে মনে করত। তারা তাদের এ কুসংস্কারকে খোদায়ী বিধান বলে দাবি করত। এ আয়াতে নিষিদ্ধ খাদ্যগুলোর তালিকা জানিয়ে দিতে বিশ্বনবী (সা.)-কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যাতে সত্য ও মিথ্যা স্পষ্ট হয়। খোদায়ী বিধানে নিষিদ্ধ খাদ্যের সংখ্যা খুবই কম। এ আয়াতে যেসব খাদ্যকে অপবিত্র অথবা দূষিত ও পাপযুক্ত বলা হয়েছে সেগুলো হল, মৃত পশু বা জন্তুর গোশত, শুকরের মাংস, জীব-জন্তুর রক্ত। দূষিত ও অপবিত্র জিনিসকে ঘৃণা করা সুস্থ ও স্বাভাবিক প্রকৃতির লক্ষণ। কারণ, দূষিত ও অপবিত্র জিনিস নানা ধরনের রোগের উৎস। তাই মানুষের উচিত পবিত্র ও পছন্দনীয় খাদ্য খাওয়া। আর এ জন্যই সূরা বাকারার ৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: পবিত্র ও রুচিকর খাবার খাও।

অপবিত্র ও দূষিত জিনিস ছাড়াও আল্লাহর অবাধ্যতা বা নাফরমানির প্রকাশ ঘটিয়ে যেসব খাদ্য প্রস্তুত করা হয় সেগুলো খাওয়াও হারাম। যেমন, গরু-ছাগল বা মুরগি ইত্যাদি যদি কোনো মূর্তির নামে জবাই করা হয় তাহলে তা খাওয়া জায়েজ নয়। মানুষের খাদ্যগুলো অবশ্যই আল্লাহর নাম নিয়ে ও আল্লাহর পথে ব্যবহার করা উচিত। অবশ্য যা যা খাওয়া নিষিদ্ধ তা জরুরি অবস্থায় খাওয়া বৈধ। এটি এক সাধারণ খোদায়ী বিধান। যেমন, যদি খাদ্যের অভাবে কারো জীবনহানির আশঙ্কা থাকে, তাহলে জীবন বাঁচানোর জন্য যতটা দরকার ঠিক ততটা হারাম খাদ্য খাওয়া যায়। তবে শর্ত হল, এ ধরনের জরুরি অবস্থা ইচ্ছে করে সৃষ্টি করা যাবে না।

এ আয়াতের শিক্ষা হল:

এক. ইসলাম যেসব জিনিসকে হারাম করেছে সেসব জিনিস মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

দুই. ইসলামে কোনো অচলাবস্থা নেই। জরুরি অবস্থায় নিষিদ্ধ খাদ্য খেয়ে জীবন বাঁচানোর কাজকে ইসলাম পাপ বলে মনে করে না।

সূরা আন’আমের ১৪৬ ও ১৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 

وَعَلَى الَّذِينَ هَادُوا حَرَّمْنَا كُلَّ ذِي ظُفُرٍ وَمِنَ الْبَقَرِ وَالْغَنَمِ حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ شُحُومَهُمَا إِلَّا مَا حَمَلَتْ ظُهُورُهُمَا أَوِ الْحَوَايَا أَوْ مَا اخْتَلَطَ بِعَظْمٍ ذَلِكَ جَزَيْنَاهُمْ بِبَغْيِهِمْ وَإِنَّا لَصَادِقُونَ (146) فَإِنْ كَذَّبُوكَ فَقُلْ رَبُّكُمْ ذُو رَحْمَةٍ وَاسِعَةٍ وَلَا يُرَدُّ بَأْسُهُ عَنِ الْقَوْمِ الْمُجْرِمِينَ

 

“ইহুদীদের জন্যে আমি প্রত্যেক নখবিশিষ্ট জন্তু এবং ছাগল ও গরু থেকে এতদুভয়ের চর্বি আমি তাদের জন্যে হারাম করেছিলাম, কিন্তু ঐ চর্বি, যা পিঠে কিংবা অন্ত্রে সংযুক্ত থাকে অথবা অস্থির সাথে মিলিত থাকে তা হারাম করিনি। তাদের অবাধ্যতার কারণে আমি তাদেরকে এ শাস্তি দিয়েছিলাম। আর আমি অবশ্যই সত্যবাদী।” (৬:১৪৬)

“(হে নবী!) যদি তারা আপনাকে মিথ্যবাদী বলে (ও এই বাস্তবতা মেনে না নেয়), তবে বলে দিনঃ তোমার প্রতিপালক সুপ্রশস্ত করুণার মালিক। (কিন্তু) তাঁর শাস্তি অপরাধীদের উপর থেকে টলবে না।” (৬:১৪৭)

মহান আল্লাহ এ আয়াতে ইহুদি ধর্মের বিধানও উল্লেখ করেছেন যাতে এটা স্পষ্ট হয় যে মুশরিকদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসগুলো শুধু ইসলামী বিধানেরই খেলাপ নয়, একইসঙ্গে ইহুদি ও খ্রিস্টিয় বিধানেরও খেলাপ। কারণ, খ্রিস্ট ধর্মের বিধানগুলো সাধারণত: ইহুদিদের বিধানেরই অনুরূপ। ইহুদিদের বিধানে যেসব খাদ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেগুলোর কিছু কিছু ইসলামী বিধানে নিষিদ্ধ নয়। অবশ্য এই নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রথম থেকেই ইহুদিদের জন্য আরোপিত ছিল না। তাদের কিছু পাপের শাস্তি হিসেবেই এইসব বাড়তি নিষেধাজ্ঞার শিকার হয় তারা।

খোদায়ী এই শাস্তির বিধান অনুযায়ী নখ বা ক্ষুরযুক্ত সব পশুপাখির গোশত ইহুদিদের জন্য হারাম করা হয়।

বর্তমান যুগে প্রচলিত ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থেও দেখা যায়,  আল্লাহ  পাপের শাস্তি হিসেবে কিছু হালাল খাদ্য ইহুদিদের জন্য হারাম করেছেন। অবশ্য হযরত ঈসা (আ.)’র আগমনের ফলে তাদের ওপর ওইসব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন আল্লাহ।  এ থেকে বোঝা যায় ব্যক্তি ও সমাজের তৎপরতার ধরণ আল্লাহর নেয়ামতের সংখ্যা ও পরিমাণকে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিতে পারে।

কোরআনের  কোনো কোনো আয়াতে দেখা যায় সমাজের দরিদ্র ও এতিমদের প্রতি মানুষের অবহেলার শাস্তি হিসেবে তাদেরকে আল্লাহর অনেক নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করা হয়।  অন্যদিকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সৎ কাজের কারণে মানুষের জন্য খোদায়ী রহমত, বরকত ও নেয়ামত বাড়িয়ে দেয়া হয়।

পরবর্তী আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)কে আল্লাহ বলছেন, ইহুদি ও মুশরিকরা যদি আপনাকে মিথ্যাবাদী বলে তবে আপনি তাদের বলুন, আল্লাহর রহমত তার বান্দাদের জন্য ব্যাপক বিস্তৃত হলেও সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পাপের শাস্তি থেকে রেহাই দেয়া হবে না। আল্লাহ মুমিন ও মুসলমান বান্দাদেরকে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করেন না, বরং তিনি তাদেরকে সময় দিতে চান যাতে তারা তওবার সুযোগ পায়।

এ দুই আয়াতের শিক্ষা হল:

এক.  আমাদেরকে কাজ-কর্মের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। খোদায়ী শাস্তি হিসেবে ইহকালেই মানুষকে অনেক নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করা হয়।

দুই. বিরোধীদের মোকাবেলায় আল্লাহর রহমতের কথাও মনে রাখতে হবে এবং তাদেরকে খোদায়ী শাস্তির ব্যাপারেও সতর্ক করতে হবে।

সূরা আন’আমের ১৪৮ ও ১৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 

سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلَا آَبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلَّا تَخْرُصُونَ (148) قُلْ فَلِلَّهِ الْحُجَّةُ الْبَالِغَةُ فَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ

“(হে নবী!) মুশরিকরা  শিগগিরই বলবেঃ যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তবে  আমরা ও আমাদের বাপ দাদারা শিরক করতাম না এবং আমরা কোন বস্তুকেও হারাম করতাম না। তাদের পূর্ববর্তীরাও এভাবেই মিথ্যারোপ করেছিল, ফলে তারা আমার শাস্তি আস্বাদন করেছে। (হে নবী!) আপনি বলুনঃ তোমাদের কাছে কি কোন প্রমাণ আছে যা আমাদেরকে দেখাতে পার। তোমরা শুধুমাত্র ভিত্তিহীন অনুমানের অনুসরণ কর এবং তোমরা শুধু অলীক বা মিথ্যা কথা বল।” (৬:১৪৮)

“(হে নবী!) আপনি বলে দিনঃ অতএব, পরিপূর্ণ যুক্তি-প্রমাণ আল্লাহরই। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে পথ প্রদর্শন করতেন।” (৬:১৪৯)

আল্লাহ এ দুই আয়াতে মহানবী (সা.)-কে জানিয়ে দিয়েছেন যে, শিগগিরই মুশরিকরা তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসের পক্ষে সাফাই দেয়ার জন্য বাধ্য-বাধ্যকতার অজুহাত দেখাবে। তারা বলবে: আল্লাহ তো জানেন যে আমরা এইসব বিশ্বাস অনুযায়ী কাজকর্ম করব, তাই তিনি চাইলে তো আমাদেরকে এবং আমাদের বাপ-দাদাকেও শির্ক থেকে বিরত রাখতে পারতেন। ফলে আমরা নিজেরাই কোনো কোনো খাদ্যকে হারাম করতাম না। অর্থাৎ আল্লাহ চেয়েছেন বলেই আমরা এমন হয়েছি এবং অমুক কাজগুলো করছি। জবাবে আল্লাহ বলছেন, আল্লাহ নবী-রাসূল পাঠিয়ে ও তাঁদের কাছে খোদায়ী বিধান উল্লেখ করে এইসব কুসংস্কারের বিরোধিতা করেছেন। তবে আল্লাহ সত্য গ্রহণে কাউকে বাধ্য করেন না। বরং তিনি সঠিক ও ভুল পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন। ফলে তোমাদের এ কথা বলার সুযোগ নেই যে তোমরা সঠিক পথ কোনটি তা জানতে না। আল্লাহ আরও বলছেন, কেবল এ যুগের মুশরিকরাই নয়, বরং সব যুগের মুশরিকরাই এ ধরনের অজুহাত দেখিয়েছে। আল্লাহ কি চেয়েছিলেন বা চাননি সে সম্পর্কে তাদের এ ধরনের দাবি  যুক্তি বা জ্ঞান-ভিত্তিক নয়,  বরং অনুমানভিত্তিক, যার কোনো মূল্য নেই।

এ দুই আয়াতের শিক্ষা হল:

এক.  পাপের চেয়েও পাপের পক্ষে সাফাই দেয়া নিকৃষ্টতর। এ ধরনের সাফাই আল্লাহকে অপবাদ দেয়ার শামিল।

দুই. ঈমান আনা বা না আনা মানুষের স্বাধীনতার বিষয়। তাই কাউকে সত্য গ্রহণে বাধ্য করার অধিকার নবী-রাসূলেরও নেই।