সূরা আন'আম;(৩১তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(৩১তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 7:10:55 3-10-1403

সূরা আন'আম; আয়াত ১৩১-১৩৬

সূরা আন'আমের ১৩১ ও ১৩২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

 ذَلِكَ أَنْ لَمْ يَكُنْ رَبُّكَ مُهْلِكَ الْقُرَى بِظُلْمٍ وَأَهْلُهَا غَافِلُونَ (131) وَلِكُلٍّ دَرَجَاتٌ مِمَّا عَمِلُوا وَمَا رَبُّكَ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ

"এটা এ জন্যে যে, আপনার প্রতিপালক কোনো জনপদের অধিবাসীদেরকে জুলুমের কারণে ধ্বংস করেন না। যদি সেখানকার অধিবাসীরা অজ্ঞ থাকে।" (৬:১৩১)

"প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদা তার আমল অনুযায়ী হবে, এবং তারা যা করে, সে সমন্ধে আপনার প্রতিপালক অনবহিত নন।" (৬:১৩২)

জ্বিন ও মানব সমপ্রদায়ের কাছে আল্লাহর বাণী নিয়ে যে নবী-রাসূল এসেছেন, সে কথা এর আগের আয়াতে বলা হয়েছে। এরপর সূরা আন'আমের ১৩১ ও ১৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা সব মানুষকে সচেতন করে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অর্থাত পৃথিবীর সব মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিতে হবে, যাতে তারা সৎ পথ পেতে পারে। কিন্তু সত্য পথের সন্ধান পাওয়ার পরও যদি কেউ তা গ্রহণ না করে তাহলে সেই ব্যক্তি ও জাতি শাস্তি ভোগ করবে। এটাই আল্লাহর রীতি। আল্লাহতায়ালা কুরআনের অন্য এক সূরায় বলেছেন, নবী না পাঠিয়ে আমি কাউকেই শাস্তি দেই না। এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলোর মধ্যে একটি হলো, কাউকে কোন বিষয় সম্পর্কে অবহিত না করে শাস্তি দেয়া অন্যায় এবং আল্লাহ এমনটি করেন না।

সূরা আন'আমের ১৩৩ ও ১৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَرَبُّكَ الْغَنِيُّ ذُو الرَّحْمَةِ إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَسْتَخْلِفْ مِنْ بَعْدِكُمْ مَا يَشَاءُ كَمَا أَنْشَأَكُمْ مِنْ ذُرِّيَّةِ قَوْمٍ آَخَرِينَ (133) إِنَّ مَا تُوعَدُونَ لَآَتٍ وَمَا أَنْتُمْ بِمُعْجِزِينَ

"আপনার প্রতিপালক (সর্বপ্রকার) অভাবমুক্ত,দয়াশীল। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদেরকে অপসারণ করতে এবং তোমাদের পরে যাকে ইচ্ছা স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন,যেমন তিনি তোমাদেরকে অন্য বংশ থেকে সৃষ্টি করেছেন।" (৬:১৩৩)

"তোমাদের সাথে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়,তা অবশ্যই আসবে। তোমরা (আল্লাহকে) অক্ষম করতে পারবে না।" (৬:১৩৪)

আল্লাহ যে কখনোই তার বান্দারের ওপর জুলুম করেন না, আগের আয়াতে সে বিষয়টি উল্লেখ করার পর এ দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, বান্দাদের ওপর আল্লাহর জুলুম করার কোনো যুক্তি নেই। কেউ অভাবগ্রস্ত ও হিংস্র হলে অন্যের ওপর জুলুম করে। কিন্তু আল্লাহ পুরোপুরি অভাবমুক্ত ও অমুখাপেক্ষি। পাশাপাশি তিনি অত্যন্ত দয়ালু। তবে আল্লাহর মহানুভবতাকে কেউ যাতে অপব্যবহার না করে, সে বিষয়েও সৃষ্টিকর্তা সতর্ক করে দিয়েছেন। কারণ আল্লাহতায়ালা এ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, তিনি মানুষকে ইচ্ছে করলে ধ্বংস করতে পারেন এবং অন্য মানুষকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন। বিচার দিবসেও এ ধরনের মানুষকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করার কেউ থাকবে না এবং আল্লাহর মোকাবেলায় কেউ দাঁড়াতে পারবে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করে মানুষই উপকৃত হয়। এসবের কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই। যেমনিভাবে মানুষের অস্তিত্বও আল্লাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়।

দুই. আল্লাহ অসীম দয়ালু। তবে মানুষ সীমা লংঘন করলে তাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে।

সূরা আন'আমের ১৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ يَا قَوْمِ اعْمَلُوا عَلَى مَكَانَتِكُمْ إِنِّي عَامِلٌ فَسَوْفَ تَعْلَمُونَ مَنْ تَكُونُ لَهُ عَاقِبَةُ الدَّارِ إِنَّهُ لَا يُفْلِحُ الظَّالِمُونَ

"(হে মুহাম্মদ সা.!) বলুন, ‘হে আমার জাতি! তোমরা (যদি আমার কথা না মান, তবে) তোমরা তোমাদের পন্থায় কাজ করতে থাক; আমিও (আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী) আমার কাজ করছি। অতপর তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে- কার পরিণাম কল্যাণকর। নিশ্চিত যে জালিমরা কখনো সফলকাম হবে না।" (৬:১৩৫)

আল্লাহ ও রাসূলের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে স্বেচ্ছাচারী তৎপরতা চালাতে থাকলে মানুষ যে সফল হতে পারবে না, সে বিষয়টি এ আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. কোনো কিছুর সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠি হলো,সেটার চূড়ান্ত পরিণাম। কাজেই যার চূড়ান্ত পরিণাম ভালো,সেই-ই সফলকাম।

দুই. বেশিরভাগ মানুষও যদি আল্লাহর পথ থেকে সরে যায়,তারপরও ঈমানদারের দায়িত্ব হলো-আল্লাহ নির্দেশিত কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং মিথ্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান বজায় রাখা।

সূরা আন'আমের ১৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَجَعَلُوا لِلَّهِ مِمَّا ذَرَأَ مِنَ الْحَرْثِ وَالْأَنْعَامِ نَصِيبًا فَقَالُوا هَذَا لِلَّهِ بِزَعْمِهِمْ وَهَذَا لِشُرَكَائِنَا فَمَا كَانَ لِشُرَكَائِهِمْ فَلَا يَصِلُ إِلَى اللَّهِ وَمَا كَانَ لِلَّهِ فَهُوَ يَصِلُ إِلَى شُرَكَائِهِمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ

"আল্লাহ্ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন তা থেকে তারা আল্লাহর জন্য এক অংশ নির্ধারন করে এবং নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে,‘এটা আল্লাহর জন্য এবং এটা আমাদের দেবতাদের জন্য।'যা তাদের দেবতাদের অংশ তা আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না এবং যা আল্লাহর অংশ তা তাদের দেবতাদের কাছে পৌঁছে,তারা যে ফয়সালা করে তা নিকৃষ্ট!" (৬:১৩৬)

এ আয়াতে মক্কার মুশরিকদের আরেকটি ভ্রান্ত বিশ্বাস ও কুসংস্কারের কথা তুলে ধরা হয়েছে। ইতিহাসেও এসেছে, সে সময় মুশরিকরা তাদের শস্য ও গবাদি পশু থেকে আল্লাহর জন্য একটা অংশ নির্ধারণ করতো এবং আরেক অংশ রাখতো মূর্তিগুলোর জন্য। আল্লাহর জন্য যে অংশ নির্ধারণ করতো, তা তারা দরিদ্র মানুষ ও অতিথিদের মাঝে বিলি করতো। আর মূর্তিদের জন্য নির্ধারিত অংশ তারা সেগুলোর তত্ত্বাবধায়কদেরকে দিতো অথবা পশু জবাইয়ের অনুষ্ঠানে ব্যয় করতো। এ অবস্থায় মূতিদের জন্য নির্ধারিত অংশে ঘাটতি দেখা দিলে তারা আল্লাহর জন্য নির্ধারিত অংশ থেকে তা পূরণ করতো। কখনোই তারা মূর্তিদের অংশ থেকে নিয়ে আল্লাহর অংশ পূরণ করতো না। এমনকি কখনো কোনো কারণে মূর্তির অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তখন তারা  বলতো, আল্লাহতো অভাবমুক্ত। তারতো এসবের প্রয়োজন নেই। বরং মূর্তিদের প্রয়োজন বেশি। এ কারণে আল্লাহর অংশ মূর্তিদের তত্ত্বাবধায়কদের দিয়ে দিতো।

আল্লাহতায়ালা মুশরিকদের এ ধরনের রীতির কঠোর নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, মুশরিকদের ফয়সালা এতটাই নিকৃষ্ট যে, তারা শির্‌ক করার পাশাপাশি আল্লাহকে মূর্তির চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। যদিও আল্লাহই সব কিছুর মালিক এবং সব কিছু বন্টনের অধিকার একমাত্র তারই। কিন্তু তারা সব কিছুর মালিক আল্লাহর জন্য অংশ নির্ধারণ করে এবং নিজেরাই সেই অংশ কম-বেশি করে। আল্লাহ ও মূর্তির জন্য শস্য ও গবাদি পশু থেকে অংশ নির্ধারণ মুশরিকদের কুসংস্কার হলেও এ ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, মুশরিকরাও তাদের সম্পদের একটা অংশ দরিদ্র মানুষদের মাঝে বিলি করার বিষয়টি স্বীকার করতেন। আর এ থেকে প্রমাণিত হয়, অতীতে তারা কোনো একটি ঐশি ধর্মেরই অনুসারি ছিল, তবে সময়ের পরিক্রমায় তারা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. আল্লাহই হচ্ছেন সৃষ্টিজগতের সবকিছুর পালনকর্তা। বীজের অংকুরোদগম থেকে শুরু করে শস্যের বেড়ে উঠা ও ফলবান হওয়া পর্যন্ত-সব কিছুই ঘটে আল্লাহর মহিমায়।

দুই. নবী-রাসূলদের একটি বড় দায়িত্ব ছিলো-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা।