সূরা আন'আম;(৩২তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(৩২তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 7:28:0 3-10-1403

সূরা আন'আম; আয়াত ১৩৭-১৪০

সূরা আন’আমের ১৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَكَذَلِكَ زَيَّنَ لِكَثِيرٍ مِنَ الْمُشْرِكِينَ قَتْلَ أَوْلَادِهِمْ شُرَكَاؤُهُمْ لِيُرْدُوهُمْ وَلِيَلْبِسُوا عَلَيْهِمْ دِينَهُمْ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ

"এমনিভাবে অনেক মুশরিকের দৃষ্টিতে তাদের উপাস্যরা সন্তান হত্যাকে সুশোভিত করে দিয়েছে যেন তারা তাদেরকে বিনষ্ট করে দেয় এবং তাদের ধর্মমতকে তাদের কাছে বিভ্রান্ত করে দেয়। যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে তারা এ কাজ করতো না। অতএব (হে রাসুল) আপনি তাদেরকে এবং তাদের মনগড়া বুলিকে পরিত্যাগ করুন।" (৬:১৩৭)

গত পর্বে আমরা বলেছিলাম, মক্কার মুশরিকরা তাদের কৃষিপণ্য ও গবাদিপশুর একটি অংশ তাদের মূর্তিদের জন্য রেখে দিত। আজকের আয়াতে তাদের আরেকটি জঘন্য কুসংস্কারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা তাদের মূর্তিদের জন্য শুধুমাত্র তাদের সম্পদের একটি অংশই বরাদ্দ রাখতো না-সেইসঙ্গে অনেক সময় তাদের এসব উপাস্যর সামনে নিজেদের সন্তানদেরও বলি দিত। মূর্তির সামনে নরবলীকে তারা উপাসনা মনে করতো। পৌত্তলিকরা মূর্তিপুজা করতে করতে এত নীচে নেমে গিয়েছিল যে, মূর্তির সামনে মানুষের গলা কেটে ফেলা তাদের কাছে একটি মনোরম দৃশ্যে পরিণত হয়েছিল। এমনকি নিজেদের সন্তানদের বলি দিয়ে তারা গর্ববোধও করতো।

আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, এ ধরনের অন্যায় আচার-আচরণের কারণে মক্কার মুশরিক সমাজ থেকে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর প্রদর্শিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো হারিয়ে গিয়েছিল। মুশরিকরা মনে করতো, তারা যা করছে সেটাই ধর্ম। অথচ তারা বুঝতে চেষ্টা করতো না, নিজ হাতে সন্তান বধ করলে তাদের প্রজন্ম বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন বিশ্বনবী (সা.)কে উদ্দেশ করে বলছে : তারা তাদের কুতসিত কাজের জন্য আল্লাহর দোহাই দেয়; অথচ আপনার সত্যবাণী মেনে নেয় না। কাজেই এর চেয়ে বেশি কষ্ট করার প্রয়োজন আপনার নেই। আপনি তাদেরকে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে দিন। কারণ, আল্লাহও চান না তারা বাধ্য হয়ে সত্য পথে ফিরে আসুক। আল্লাহ চাইলে তিনি অতি সহজে তাদেরকে এ কুসংস্কার থেকে বিরত রাখতে পারতেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. পাপকাজ করার চেয়ে ওই কাজ করে গর্বিত হওয়া বেশি অপরাধ। কারণ, এর ফলে মানবতার মৃত্যু ঘটে। এ ছাড়া, এর মাধ্যমে মানুষের সত্যপথে ফিরে আসার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়।

দুই. নবী-রাসুলদের কাজ মানুষকে সত্যপথে আসার দাওয়াত দেয়া; তাদেরকে বাধ্য করা নয়। এ কারণে মানুষ তাদের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলে তারা হতাশ হতেন না।

সূরা আন’আমের ১৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَقَالُوا هَذِهِ أَنْعَامٌ وَحَرْثٌ حِجْرٌ لَا يَطْعَمُهَا إِلَّا مَنْ نَشَاءُ بِزَعْمِهِمْ وَأَنْعَامٌ حُرِّمَتْ ظُهُورُهَا وَأَنْعَامٌ لَا يَذْكُرُونَ اسْمَ اللَّهِ عَلَيْهَا افْتِرَاءً عَلَيْهِ سَيَجْزِيهِمْ بِمَا كَانُوا يَفْتَرُونَ

"মুশরিকরা বলে : চতুস্পদ জন্তু ও শস্যক্ষেত্রের এই অংশটি (উপাস্যদের জন্য নির্ধারিত এবং তা সাধারণ মানুষের জন্য) নিষিদ্ধ। আমরা যাকে দিতে চাই, সে ছাড়া এগুলো কেউ খেতে পারবে না। আর  (তাদের ধারণা অনুসারে) কিছু সংখ্যক চতুষ্পদ জন্তুর পিঠে আরোহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কিছুসংখ্যক চতুষ্পদ জন্তু (জবেহ করার সময়) তারা ভ্রান্ত ধারণাবশতঃ আল্লাহ নাম উচ্চারণ করে না। আল্লাহ তাদের মনগড়া বুলির কারণে অচিরেই তাদেরকে শাস্তি দেবেন।" (৬:১৩৮)

গত পর্বে আলোচনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এ আয়াতে বলা হচ্ছে, মক্কার মুশরিকরা কিছু চতুস্পদ জন্তুকে বাছাই করে আলাদা রেখে দিত। এসব জন্তুর গোশত ও দুধ খাওয়াকে নিজেদের জন্য হারাম মনে করতো। শুধুমাত্র মন্দিরের পরিচারকদেরকে এসব জন্তুর পিঠে চড়ার অনুমতি দিত। তারা মনে করতো, মূর্তিদের জন্য এসব জন্তু আলাদা করে রাখা হয়েছে বলে মন্দিরের পরিচারকদের তা ব্যবহারে বাধা নেই। এরপর তাদের কল্পিত উপাসকদের সামনে এসব জন্তু জবেহ করার সময় তারা আল্লাহর নাম নেয়ার পরিবর্তে মূর্তিদের নাম উচ্চারণ করতো। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, তাদের এসব আচরণ জঘন্য হলেও এর চেয়ে বেশি জঘন্য হচ্ছে, ধর্মের নামে এ ধরনের কুতসিত কাজ করা। আল্লাহ তাদের এ জঘন্য কাজের শাস্তিস্বরূপ তাদের অন্তরে মোহর মেরে কাফের করে দিয়েছেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :

এক. কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা- বিশেষ করে যেসব নোংরা কাজ আল্লাহর নামে চালিয়ে দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ছিল নবী-রাসুলদের অন্যতম কাজ।

দুই. শুধুমাত্র আল্লাহর নির্দেশিত হালালকে হারাম করা নয় সেইসঙ্গে হারামকে হালাল হিসেবে গণ্য করাও বিদআত। এর ফলে আল্লাহর ওপর চরম অপবাদ আরোপ করা হয়।

সূরা আন’আমের ১৩৯ ও ১৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَقَالُوا مَا فِي بُطُونِ هَذِهِ الْأَنْعَامِ خَالِصَةٌ لِذُكُورِنَا وَمُحَرَّمٌ عَلَى أَزْوَاجِنَا وَإِنْ يَكُنْ مَيْتَةً فَهُمْ فِيهِ شُرَكَاءُ سَيَجْزِيهِمْ وَصْفَهُمْ إِنَّهُ حَكِيمٌ عَلِيمٌ (139) قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ قَتَلُوا أَوْلَادَهُمْ سَفَهًا بِغَيْرِ عِلْمٍ وَحَرَّمُوا مَا رَزَقَهُمُ اللَّهُ افْتِرَاءً عَلَى اللَّهِ قَدْ ضَلُّوا وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ

"এবং (মুশরিকরা তাদের ভ্রান্ত ধারণা অনুযায়ী আরো) বলতো : এসব চতুষ্পদ জন্তুর পেটে যা আছে, (তা যদি জীবিত প্রসব হয়, তাহলে তা) শুধুমাত্র পুরুষদের প্রাপ্য এবং নারীদের জন্য তা নিষিদ্ধ। আর তা যদি মৃত হয়, তবে তার প্রাপক হিসাবে (নারী ও পুরষ) সবাই সমান। অচিরেই আল্লাহ তাদেরকে তাদের এ ভ্রান্ত রীতির কারণে শাস্তি দেবেন। তিনি প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী।" (৬:১৩৯)

"নিশ্চয়ই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যারা নিজ সন্তানদেরকে নির্বুদ্ধিতাবশতঃ কোন প্রমাণ ছাড়াই হত্যা করেছে এবং আল্লাহ তাদেরকে যেসব দিয়েছিলেন, সেগুলোকে আল্লাহর প্রতি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে হারাম করে নিয়েছে। তারা নিশ্চিতভাবে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং সুপথ পায়নি।" (৬:১৪০)

এ দুই আয়াতেও জাহিলিয়াতের যুগে মুশরিকদের আরেকটি কুসংস্কারমূলক ও বৈষম্যপূর্ণ আচরণের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে : তারা শুধু জীবিত পশুদেরকে তাদের মূর্তির জন্য উতসর্গ করতো না, সেইসঙ্গে এসব জন্তুর গর্ভস্থ ভ্রুণ সম্পর্কেও সংস্কারপূর্ণ কথাবার্তা বলতো। তারা ঘোষণা করতো, এ পশুর গর্ভস্থ ভ্রুণটি যদি জীবিত প্রসব হয়, তাহলে তার গোশত শুধুমাত্র পুরুষদের মধ্যে বন্টন করা হবে। আর যদি জন্তুটি মৃত শাবক প্রসব করে তাহলে তার গোশত নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হবে। তারা এমন সময় মৃত পশুর গোশত খাওয়াকে বৈধ মনে করতো যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে মৃত প্রাণীর গোশত ভক্ষণ সম্পূর্ণ হারাম করা হয়েছে এবং এ ধরনের গোশত শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকরও বটে।

এ দুই আয়াতের শেষাংশে আবারো নিজ সন্তানদের মূর্তির সামনে বলি দেয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে : পথভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতা তাদেরকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে দান করা সন্তানদের হত্যা করার মতো জঘন্য ও কুতসিত কাজকে তারা ইবাদত মনে করতো। ভাবতো, এর ফলে আল্লাহ খুশি হবেন। এ ধরনের একটি জঘন্য সমাজে এ ধরনের বিকৃত চিন্তাধারার অধিকারী লোকজনের মধ্যে ধর্মের বাণী শোনানোর জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি এসব মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বাণী ছড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে সতপথে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।

এ দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে :

এক. আল্লাহর দেয়া নেয়ামত উপভোগের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করা চরম অজ্ঞতার পরিচায়ক এবং এ ধরনের অনুমতি ইসলাম কাউকে দেয়নি।

দুই. কুসংস্কারাচ্ছন্ন আচরণকে ধর্মের নামে চালিয়ে দেয়ার মতো জঘন্য কাজ আর হতে পারে না। এর সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই এবং এর পরিণতিতে মানুষ কাফের হয়ে যেতে পারে।