সূরা আন’আমের ১২৬ ও ১২৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَهَذَا صِرَاطُ رَبِّكَ مُسْتَقِيمًا قَدْ فَصَّلْنَا الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَذَّكَّرُونَ (126) لَهُمْ دَارُ السَّلَامِ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَهُوَ وَلِيُّهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“আর এটাই আপনার পালনকর্তার সরল পথ। আমি উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্যে আয়াতগুলো বিশদভাবে বর্ননা করেছি।” (৬:১২৬)
“তাদের জন্যেই তাদের প্রতিপালকের কাছে নিরাপত্তার গৃহ রয়েছে এবং তিনি তাদের বন্ধু তাদের কর্মের প্রতিদান-স্বরূপ।” (৬:১২৭)
গত পর্বে আমরা খোদায়ী নিদর্শনের সঙ্গে মুমিন ও কাফেরদের আচরণ সম্পর্কিত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। যারা ইসলামকে সত্য ধর্ম হিসেবে মেনে নেন তাদের অন্তর পবিত্র এবং তাদের মন ও আত্মা সত্যকে গ্রহণের জন্য প্রস্তুত বলে উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহ। এ আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন, ইসলামের পথ সরল পথ ছাড়া অন্য কিছু নয়। মানুষের সৌভাগ্য ও পূর্ণতার জন্য আল্লাহই এ পথ নির্ধারণ করেছেন। যারা বিশ্বাস ও আচরণে ইসলামকে মেনে নিয়েছেন তারা আসলে এই লক্ষ্য-পানে এগিয়ে গেছেন। এই পথই হচ্ছে সরল পথ। দুটি বিন্দুর মধ্যে সংযোগের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথই হচ্ছে সরল পথ। স্বাভাবিকভাবেই এ পথের পথিকরা ইহকালে আল্লাহর পথে এগিয়ে যান এবং পরকালেও সব ধরনের বিপদ ও শাস্তি থেকে মুক্ত থাকবেন ও বেহেশতের অধিকারী হবেন। বেহেশত শান্তি ও নিরাপত্তার স্থান বলে এ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় ক’টি দিক হল:
এক. আল্লাহর দেখানো পথই একমাত্র সরল পথ। এ ছাড়া অন্য সব পথ বিচ্যুতির পথ বা বিভ্রান্তির পথ।
দুই. সরল পথে অবিচল থাকার জন্য সব সময় সচেতন থাকা ও সতর্ক করা জরুরি। কারণ, মুহূর্তের অসতর্কতা মানুষকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে।
তিন. বেহেশতে কোনো ধরনের মৃত্যু, জরা-ব্যাধি, দারিদ্র, কষ্ট, সহিংসতা, হিংসা, অনুতাপ, অপবাদ-এসবের কোনো অবকাশই নেই।
সূরা আন’আমের ১২৮ ও ১২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ قَدِ اسْتَكْثَرْتُمْ مِنَ الْإِنْسِ وَقَالَ أَوْلِيَاؤُهُمْ مِنَ الْإِنْسِ رَبَّنَا اسْتَمْتَعَ بَعْضُنَا بِبَعْضٍ وَبَلَغْنَا أَجَلَنَا الَّذِي أَجَّلْتَ لَنَا قَالَ النَّارُ مَثْوَاكُمْ خَالِدِينَ فِيهَا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٌ (128) وَكَذَلِكَ نُوَلِّي بَعْضَ الظَّالِمِينَ بَعْضًا بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
“যেদিন (বিচার দিবসে) আল্লাহ সবাইকে একত্রিত করবেন,(সেদিন তিনি বলবেন,) হে জিন সম্প্রদায়, তোমরা মানুষদের মধ্যে অনেককে অনুগামী করে নিয়েছ। তাদের মানব বন্ধুরা বলবেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা একে-অপরকে ব্যবহার করেছি। আপনি আমাদের জন্যে যে পরিণতি নির্ধারণ করেছিলেন, আমরা তাতে উপনীত হয়েছি। তাদের বলা হবে: আগুন হল তোমাদের বাসস্থান। সেখানে তোমরা চিরকাল থাকবে; যদি না আল্লাহ (তোমাদের একদলকে ক্ষমার) ইচ্ছা করেন। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তা প্রজ্ঞাময়, মহাজ্ঞানী।” (৬:১২৮)
“এমনিভাবে আমি পাপীদের একদলকে অন্য দলের ওপর কর্তৃত্বশীল করে দেব তাদের কাজকর্মের শাস্তি হিসেবে।” (৬:১২৯)
এ দুই আয়াতে পুনরুত্থান বা পারলৌকিক প্রতিদানের দিনে পথভ্রষ্ট বা বিভ্রান্তদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে, শয়তান তথা পথভ্রষ্ট লোকদের গুরু এবং মানুষের মধ্যে তার অনুসারী-উভয় গ্রুপকেই কৈফিয়ত দিতে বলা হবে। এ সময় তারা তাদের ভুল স্বীকার করলেও ইহলোকে ফিরে আসার ও ভুলের ক্ষতি পূরণের কোনো সুযোগ থাকবে না।
শয়তান ও তার দলবল কুমন্ত্রণা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার পরিবেশ সৃষ্টি করে, কিন্তু পাপীদের আনন্দ-ফুর্তি স্বল্পস্থায়ী হয়। বুদ্ধিমান মানুষেরা এই স্বল্পস্থায়ী আনন্দের জন্য প্রবৃত্তিকে লাগামহীন হতে দেন না এবং এ ধরনের আনন্দের জন্য চিরস্থায়ী বেহশতকে বিসর্জন দেন না।
আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হচ্ছে, তোমরা পৃথিবীতে পাপাচারে মগ্ন ছিলে, আর সেইসব পাপেরই ফসল হিসেবে তোমরা অর্জন করবে দোযখের আগুন, যা তোমাদের এমনভাবে ঘিরে রাখবে যে পালানোর কোনো পথ থাকবে না। অবশ্য আল্লাহ চাইলে তোমাদের একদলকে ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু আল্লাহ বিনা কারণে কাউকে ক্ষমা করবেন না, ঠিক যেমনিভাবে তিনি বিনা কারণে কাউকে শাস্তি দেবেন না।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখার মত কয়েকটি দিক হল:
এক. বিচার দিবসে শয়তান ও তার অনুসারী মানুষরা একই স্থানে থাকবে। সেদিন তাদের সবার কাছে তাদের কৃত পাপের কৈফিয়ত চাওয়া হবে।
দুই. আমাদের কাজকর্মের পরিণতি সম্পর্কে ভাবা উচিত এবং এমন নেতৃবৃন্দের অনুসরণ করা উচিত যারা কিয়ামতে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।
তিন. পাপী ও বিচ্যুতদের সবার শাস্তি একই মাত্রার হবে না। কারা কতদিন দোযখে থাকবে তা মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল।
চার. শয়তানের অনুসরণ রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর জালেমদের কর্তৃত্বের পথ সুগম করে।
সূরা আন’আমের ১৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِنْكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ آَيَاتِي وَيُنْذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا قَالُوا شَهِدْنَا عَلَى أَنْفُسِنَا وَغَرَّتْهُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَشَهِدُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَنَّهُمْ كَانُوا كَافِرِينَ
“হে জ্বিন ও মানব সম্প্রদায়, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে পয়গম্বরগণ আসেননি? যাঁরা তোমাদের কাছে আমার আয়াত বা বিধানগুলো বর্ণনা করতেন এবং তোমাদেরকে আজকের এ দিনের সাক্ষাতের ভয় দেখাতেন? তারা বলবেঃ আমরা স্বীয় গোনাহ স্বীকার করে নিলাম, তথা নিজেদের বিরুদ্ধে এ সাক্ষ্য দিচ্ছি যে (নবী-রাসূলগণ এসেছিলেন এবং তাঁরা সতর্কও করেছিলেন, কিন্তু আমরা তাদের কথায় কান দেইনি) পার্থিব জীবন আমাদেরকে প্রতারিত করেছে। এভাবে তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য হয়েছে যে, তারা কাফের ছিল।” (৬:১৩০)
আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, আল্লাহ বিচার দিবসে কাফেরদেরকে শাস্তি দেয়ার আগে তাদের কাছ থেকেই স্বীকারোক্তি আদায় করবেন যে, তারা সত্যকে বুঝে শুনেও গ্রহণ করেনি। নবী-রাসূল বা ধর্মীয় নেতারা তাদের সুপথ দেখানো সত্ত্বেও তারা বিচ্যুতির পথ বেছে নিয়েছিল। বিচার-দিবসের কথাও তারা শুনেছিল, কিন্তু দুনিয়ার জীবন তাদেরকে এতটা ব্যস্ত ও মোহগ্রস্ত করে রেখেছিল যে তারা পরকালের ব্যাপারে অসচেতন ছিল। ফলে তারা আল্লাহ ও তাঁর নেয়ামতগুলোর প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়েছিল এবং এর পরিণতিতে দোযখের জ্বালানি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় ক’টি দিক হল:
এক. মানুষ ও জিন উভয়ই সঠিক পথে চলার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাদের সবার পথ প্রদর্শনের জন্য নবী-রাসূল এসেছিলেন।
দুই. বিচার দিবসে কোনো পাপ ঢেকে রাখার সুযোগ থাকবে না। এমনকি পাপীরাও সেদিন নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।
তিন. দুনিয়া ও এর চাকচিক্য বা আরাম-আয়েশের প্রতি মোহ-ই মানুষের বিচ্যুতির এবং নবী-রাসূলগণের আহ্বান অস্বীকার করার প্রধান চালিকা-শক্তি।