সূরা আন'আম;(২৭তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(২৭তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 5:24:1 3-10-1403

সূরা আন'আম; আয়াত ১১৫-১১৯

পবিত্র কুরআনের সূরা আন’আমের ১১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

"আপনার প্রতিপালকের বাক্য পূর্ণ সত্য ও ন্যায়পূর্ণ। তাঁর বাক্যের কোন পরিবর্তনকারী নেই। তিনিই শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী।" (৬:১১৫)

গত পর্বে সূরা আন’আমের ১১৪ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা বলেছি, বিশ্বনবী’র প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময়ে কিছু কিছু ইহুদি ও খ্রিস্টান পণ্ডিত মদীনায় উপস্থিত ছিলেন। তারা জানতেন, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর কুরআন অবতীর্ণ হবে। কিন্তু হিংসা ও জেদের বশবর্তী হয়ে তারা এ সত্য মেনে নেননি। এ আয়াতে বিশ্বনবীকে উদ্দেশ করে মহান আল্লাহ বলছেন : তারা আপনার নবুওয়াতের স্বাক্ষ্য দিচ্ছে না বলে মন খারাপ করবেন না। কারণ, আল্লাহ নিজে সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী আপনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে এতে পূর্ণাঙ্গ দিক-নির্দেশনা  রয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে :

এক. পবিত্র কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। এরপর আর কোন কিতাব অবতীর্ণ হবে না।

দুই. সত্য ও ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে কুরআনের প্রতিটি নির্দেশ ও বিধিবিধান বর্ণনা করা হয়েছে।

সূরা আন’আমের ১১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ

“আর যদি আপনি পৃথিবীর বেশিরভাগ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমানভিত্তিক কথাবার্তা বলে থাকে।” (৬:১১৬)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের উদ্দেশ করে বলা হয়েছে : আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার ওপর সত্যবাণী অবতীর্ণ হওয়ার পর এখন আর মানুষের মতামত গ্রহণ করার সুযোগ নেই। তাদের সংখ্যা যদি অনেক বেশিও হয় তারপরও তা করা যাবে না। কারণ সংখ্যায় বেশি হওয়ার বিষয়টি সত্য প্রমাণের মাপকাঠি নয়। বিশেষ করে যে সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যুক্তি-বুদ্ধি মেনে কাজ করে না তাদের ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রযোজ্য। এরা তাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া ভ্রান্ত-বিশ্বাস ও কুসংস্কারের ভিত্তিতে নিজেদের জীবন পরিচালনা করছে।

সাধারণতঃ নবী-রাসূলরা তাদের সমাজে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা বিপরীতে দাওয়াতি কাজ করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামত যদি সঠিক হতো তাহলে পৃথিবীতে কোন নবী-রাসূল পাঠানোর প্রয়োজন হতো না। অবশ্য আজকের যুগে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমরা বেশিরভাগ মানুষের ভোটে জনপ্রতিনিধি-এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তিকেও নির্বাচন করি। এর অর্থ মোটেই এ নয় যে, দেশের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে মানুষ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। কারণ, পরবর্তী নির্বাচনে দেখা যায়, জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে কিংবা পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা হচ্ছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, কোন চিন্তাধারা কিংবা মতাদর্শ সত্যনির্ভর কিনা তা জানার মাপকাঠি জনগণের গ্রহণ কিংবা প্রত্যাখ্যান নয়। সমাজের প্রতিটি মানুষ ধুমপান করলেও কোনদিন এ বিষয়টি প্রমাণিত হবে না যে ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। পক্ষান্তরে সমাজের সব মানুষ মিথ্যাবাদী হয়ে গেলেও সবাই একথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, মিথ্যা বলা ভালো নয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক.  মানুষের প্রকৃত মুক্তি নির্ভর করছে পবিত্র কুরআন ও সত্যের বাণী গ্রহণের ওপর; সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ওপর নয়।

দুই. সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামত নেয়া যেতে পারে; তবে সেক্ষেত্রেও বেশিরভাগ মানুষের ভোটে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না, বরং এটি সাময়িকভাবে নেতৃত্বের সংকট নিরসন করে মাত্র।

সূরা আন’আমের ১১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ مَنْ يَضِلُّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ

“আপনার প্রতিপালক তাদের সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবহিত- যারা তাঁর পথ থেকে বিপথগামী হয় এবং তিনি তাদেরকেও খুব ভালো করে জানেন, যারা তাঁর পথে চলে।" (৬:১১৭)

যখন প্রমাণিত হলো বেশিরভাগ মানুষের মতামত সত্য নির্ধারণের মাপকাঠি নয়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো বাণীকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সত্য ও মিথ্যাকে সনাক্ত করা তারই পক্ষে সম্ভব যিনি অতীত ও ভবিষ্যত সম্পর্কে অবহিত। আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভবিষ্যত সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। তিনি সঠিক পথপ্রাপ্তদের পাশাপাশি কারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে- সে সম্পর্কেও অবহিত। অবশ্য এটিও ঠিক যে, মানুষ তার সীমিত জ্ঞান দিয়েও অনেক ক্ষেত্রে সত্যকে চিনতে পারে। কিন্তু এ কথাটি মনে রাখতে হবে, আমাদের জ্ঞান সীমিত এবং আল্লাহর জ্ঞান অসীম।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. মানুষের বিচার-বুদ্ধি থাকলেও মহান আল্লাহর জ্ঞানের তুলনায় তা অত্যন্ত সীমিত। সেই সীমিত জ্ঞান মানুষকে আল্লাহর মহাজ্ঞানের কাছে আত্মসমর্পনের পরামর্শ দেয়।

দুই. কূটকৌশল অবলম্বন করে আমরা অন্য মানুষকে ধোঁকা দিতে পারলেও আল্লাহকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব নয়। তিনি মানুষের মনের খবর জানেন এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের চিনতে তার বিন্দুমাত্র ভুল হয় না।

সূরা আন’আমের ১১৮ ও ১১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَكُلُوا مِمَّا ذُكِرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ إِنْ كُنْتُمْ بِآَيَاتِهِ مُؤْمِنِينَ (118) وَمَا لَكُمْ أَلَّا تَأْكُلُوا مِمَّا ذُكِرَ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ وَإِنَّ كَثِيرًا لَيُضِلُّونَ بِأَهْوَائِهِمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِالْمُعْتَدِينَ

"অতঃপর যে জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়, তা থেকে ভক্ষণ করো যদি তোমরা তাঁর বিধানসমূহে বিশ্বাসী হও।" ৬:১১৮)

"কোন্‌ কারণে তোমরা এমন জন্তু থেকে ভক্ষণ করবে না, যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়। অথচ আল্লাহ তোমাদের জন্য যেসব জন্তু হারাম করেছেন, সেগুলোর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন; কিন্তু সেগুলোও তোমাদের জন্য হালাল, যখন তোমরা নিরুপায় হয়ে যাও। অনেক লোক স্বীয় ভ্রান্ত প্রবৃত্তি দ্বারা না জেনে অন্যদেরকে বিপথগামী করতে থাকে। আপনার প্রতিপালক সীমা লঙ্ঘনকারীদের যথার্থই জানেন।"(৬:১১৯)

আগের আয়াতগুলোতে শিরক ও একত্ববাদের বিভিন্ন লক্ষণের কথা উল্লেখের পর এ দু’আয়াতে শিরকের কিছু জ্বলজ্যান্ত উদাহরণের কথা তুলে ধরে বলা হচ্ছে : আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে গেলে মানুষ পথভ্রষ্ট হয় এবং নিষিদ্ধ বস্তু খেতেও দ্বিধা করে না। কিছু মানুষ নির্বিচারে যে কোন ধরনের পশু বধ করে খেতে থাকে- এক্ষেত্রে তারা কোন নিয়ম-কানুন মেনে চলে না। অন্যদিকে পৃথিবীতে কিছু নিরামিষভোজী দেখা যায় যারা জীব হত্যার বিরোধী হওয়ার কারণে কোন ধরনের পশুর গোশত খায় না। পবিত্র কুরআন এ ধরনের উগ্র আচরণের জবাব দিতে গিয়ে বলেছে : তোমরা যে দু’টি পথ বেছে নিয়েছ তার কোনটিই ঠিক নয়। বরং, সঠিক পথ হচ্ছে, আল্লাহর নামে হালাল পশু জবাই করে খাও। জেনে রেখো, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন পশুর জীবননাশ করার অধিকার তোমাদের নেই। কারণ, সব পশুর প্রকৃত মালিক হচ্ছেন আল্লাহ।

এ ছাড়া, পশু জবাই করার সময় আল্লাহ’র নাম উচ্চারণ করার অর্থ হচ্ছে তার অনুমতি গ্রহণ করা। যে কোন গোশত বিশুদ্ধ থাকলে তা যেমন তোমাদের শরীর গঠনে সহায়তা করে তেমনি আল্লাহর নামে জবাই করা গোশত তোমাদের মানসিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং তোমাদেরকে পূর্ণতায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। এ দুই আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, আল্লাহ চান, যেসব বস্তু নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা থেকে মানুষ দূরে থাকুক এবং যেসব বস্তু খাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে তা ভক্ষণ করুক। হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করার ধৃষ্ঠতা দেখানো উচিত নয়।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক.  মুমিন ব্যক্তি পানাহারের ক্ষেত্রেও আল্লাহর নির্দেশাবলী অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।

দুই.  জরুরী প্রয়োজনে জীবন বাঁচানোর জন্য হারাম বস্তু খাওয়ার অনুমতি ইসলামে দেয়া হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, মুক্তি ও কল্যাণের এ ধর্মে সব সমস্যার সমাধান রয়েছে।