সূরা আন'আম;(২১তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(২১তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 5:5:5 3-10-1403

সূরা আন'আম; আয়াত ৯১-৯৩

সূরা আন'আমের ৯১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ إِذْ قَالُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ عَلَى بَشَرٍ مِنْ شَيْءٍ قُلْ مَنْ أَنْزَلَ الْكِتَابَ الَّذِي جَاءَ بِهِ مُوسَى نُورًا وَهُدًى لِلنَّاسِ تَجْعَلُونَهُ قَرَاطِيسَ تُبْدُونَهَا وَتُخْفُونَ كَثِيرًا وَعُلِّمْتُمْ مَا لَمْ تَعْلَمُوا أَنْتُمْ وَلَا آَبَاؤُكُمْ قُلِ اللَّهُ ثُمَّ ذَرْهُمْ فِي خَوْضِهِمْ يَلْعَبُونَ

"কাফেররা আল্লাহকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারেনি। এ কারণে তারা বললো : আল্লাহ কোন মানুষের প্রতি কোন কিছু অবতীর্ণ করেননি। আপনি জিজ্ঞাসা করুন: ওই গ্রন্থ কে নাযিল করেছে, যা মুসা নিয়ে এসেছিল? যা জ্যোতিবিশেষ এবং মানবজাতির জন্য হেদায়তাস্বরূপ, যা তোমরা বিক্ষিপ্তপত্রে রেখে লোকদের জন্য প্রকাশ করেছো এবং বহুলাংশে গোপন করছো। তোমাদেরকে (তাওরাতের মাধ্যমে) এমন অনেক বিষয় শিক্ষা দেয়া হয়েছে যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা জানতে না। আপনি বলে দিন : আল্লাহ নাযিল করেছেন। এরপর তাদেরকে তাদের ক্রীড়াসুলভ বৃত্তিতে ব্যাপৃত থাকতে দিন।" (৬:৯১)

ইহুদিদের একটি দল হযরত মুসা (আ.)-এর প্রতি তাওরাত নাযিল হওয়ার বিষয়টিতে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও বিশ্বনবী (সা.)-এর ওপর কুরআন নাযিল হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে চাইল না। তারা বললো : আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি ওহী বা কিতাব নাযিল হওয়া সম্ভব নয়। পবিত্র কুরআনে ইহুদিদের এ ধরনের একরোখা মনোভাবের জবাব দিতে গিয়ে বলা হয়েছে : তোমরা হযরত মুসা’র ওপর তাওরাত নাযিল হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করছো; অথচ এটি স্বীকার করছো না যে, কুরআন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর নাযিল হয়েছে! তোমাদের পূর্বপুরুষদের পাশাপাশি তোমাদের যতটুকু ধর্মীয় জ্ঞান আছে তা তাওরাত কেন্দ্রীক। অবশ্য তাওরাতের যেসব বিষয় তোমাদের স্বার্থের বিপক্ষে গেছে, সেগুলো এরইমধ্যে তোমরা গোপন করে ফেলেছো এবং সেগুলো অস্বীকার করছো। কিন্তু তারপরও তোমরা সব সময় একথা স্বীকার করে এসেছো যে, এ কিতাবটি হযরত মুসার ওপর নাযিল হয়েছিল।

আয়াতের শেষাংশে ইসলামের নবীকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে : হে নবী, আপনি তাদের জবাব দিয়ে দিন। তবে তারা ঈমান আনছে না দেখে আপনি হতাশ হবেন না। আপনি আল্লাহর ওপর ভরসা করুন; কারণ তিনিই আপনার জন্য যথেষ্ট। যারা আপনার নবুওয়াতে বিশ্বাস করছে না তাদেরকে তাদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিন। আল্লাহই তাদের বিচার করবেন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. নবী-রাসূলদের প্রতি অবিশ্বাসের অর্থ হচ্ছে আল্লাহর অসংখ্য অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কারণ, আল্লাহ তার অনুগ্রহের বিষয়টি মানুষকে জানানোর জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন।

দুই. মানুষকে আল্লাহর পথে আসার দাওয়াত দেয়া হচ্ছে নবী-রাসূলদের কাজ। কাউকে জোর করে ধর্মের পথে আনা তাদের দায়িত্ব নয়। যারা সত্য অস্বীকার করে, তাদেরকে তাদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।

সূরা আন’আমের ৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَهَذَا كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ مُبَارَكٌ مُصَدِّقُ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَلِتُنْذِرَ أُمَّ الْقُرَى وَمَنْ حَوْلَهَا وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْآَخِرَةِ يُؤْمِنُونَ بِهِ وَهُمْ عَلَى صَلَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ

"এ কুরআন এমন গ্রন্থ যা আমি অবতীর্ণ করেছি পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যতা প্রমাণকারী হিসেবে এবং যাতে আপনি মক্কাবাসী ও পার্শ্ববর্তীদের ভয় প্রদর্শণ করেন। যারা পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করে তারা এর প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তারা স্বীয় নামাজ সংরক্ষণ করে।" (৬:৯২)

আগের আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)-এর সঙ্গে ইহুদিদের একরোখা আচরণ ও গোঁয়ার্তুমির বর্ণনা দেয়ার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে : তোমরা অর্থাত তাওরাতের অনুসারীরা পবিত্র কুরআনকে অস্বীকার করলেও কুরআন তোমাদের তাওরাতকে স্বীকার করছে। পবিত্র কুরআন ঘোষণা করছে, তাওরাত আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত মুসা (আ.)-এর প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল। আয়াতের পরবর্তী অংশে রাসূলুল্লাহ’কে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলছেন : প্রথমে মক্কা এবং এরপর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিয়ে তাদেরকে হেদায়াতের উদ্দেশ্যে আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি। কিন্তু আপনি জেনে রাখুন, সব মানুষ আপনি ও আপনার কিতাবের প্রতি ঈমান আনবে না। যারা বিশ্ব চরাচরকে এ বস্তুজগতের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করে না তারাই আপনার প্রতি ঈমান আনবে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে পার্থিব জীবন শেষে আরেকটি জীবন আসবে যেখানে এ পৃথিবীর কাজকর্মের হিসাব দিতে হবে। এ ধরনের মানুষ আপনার দাওয়াতের বাণী গ্রহণ করে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হবে এবং নামাজ আদায় করবে।

এ আয়াত থেকে আমরা যা শিখলাম তা হলো :

এক. পূর্ববর্তী আসমানি ধর্মগুলো স্থগিত করে দেয়ার অর্থ সেগুলোকে অস্বীকার করা নয় বরং এর অর্থ হচ্ছে, সেসবের কার্যকারিতা শেষ হয়ে যাওয়া। ইসলাম ও কুরআন পূর্ববর্তী সব ধর্ম ও আসমানি কিতাবের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছে।

দুই. একজন মুসলমানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নামাজ আদায় করা। যিনি নামাজ পড়েন না তার পক্ষ থেকে ঈমানদার হওয়ার দাবি করা অনুচিত।

সূরা আন’আমের ৯৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ قَالَ أُوحِيَ إِلَيَّ وَلَمْ يُوحَ إِلَيْهِ شَيْءٌ وَمَنْ قَالَ سَأُنْزِلُ مِثْلَ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَوْ تَرَى إِذِ الظَّالِمُونَ فِي غَمَرَاتِ الْمَوْتِ وَالْمَلَائِكَةُ بَاسِطُو أَيْدِيهِمْ أَخْرِجُوا أَنْفُسَكُمُ الْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ الْهُونِ بِمَا كُنْتُمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ غَيْرَ الْحَقِّ وَكُنْتُمْ عَنْ آَيَاتِهِ تَسْتَكْبِرُونَ

"ওই ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম কে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে অথবা বলে: আমার প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। অথচ তার প্রতি কোন ওহী আসেনি এবং সেইসঙ্গে যে দাবি করে যে, আমিও নাযিল করে দেখাচ্ছি যেমন আল্লাহ নাযিল করেছেন। (হে রাসূল) যদি আপনি দেখেন জালেমরা যখন মৃত্যু-যন্ত্রণায় থাকে এবং ফেরেশতারা নিজেদের হাত বাড়িয়ে বলে, বের করো তোমার আত্মা! আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি প্রদান করা হবে। কারণ, তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে অসত্য বলতে এবং তাঁর আয়াতগুলো মেনে নিতে অস্বীকার করতে।" (৬:৯৩)

ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বহু মানুষ মিথ্যা নবুওয়তের দাবি করেছে। তারা নিজেদের পক্ষ থেকে কিছু বক্তব্য তৈরি করে তা আল্লাহর নামে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। বিস্ময়ের ব্যাপারে হচ্ছে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় একদল লোক নিজেদেরকে পয়গম্বর দাবি করেছে। এ ধরনের এক ব্যক্তির নাম ছিল আব্দ বিন সা’দ। প্রথমে সে বিশ্বনবী’র সঙ্গে থেকে তাঁর প্রতি অবতীর্ণ ওহী লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করতো। কিন্তু রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করায় তিনি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সে মক্কার কাফিরদের সমবেত করে বলতে লাগলো : আমিও কুরআনের আয়াতের মতো আয়াত তোমাদের কাছে নিয়ে আসতে পারি। মুসায়লামা নামের অপর এক ব্যক্তি রাসূলের শেষ জীবনে নবুওয়াতের দাবি করে বসে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের কাউকেই নবী হিসেবে মেনে নেয়নি। এ আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে : এ ধরনের মিথ্যাচার সমাজের প্রতি চরম অবিচারের শামিল। এ ধরনের মিথ্যাচারী ব্যক্তিরা মৃত্যুর সময় কঠিনতম আযাবের সম্মুখীন হবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :

এক. মানুষের প্রতি যত ধরনের অবিচার করা যায় তার মধ্যে সাংস্কৃতিক অবিচার সবচেয়ে জঘন্য। কারণ, এর মাধ্যমে কোন জাতি বিপথগামী হয়ে গেলে তার রেশ যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে।

দুই. মিথ্যা আরোপকারীদের ব্যাপারে আমাদের সারাক্ষণ সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, এ ধরনের মানুষ কখনো কখনো ধার্মিক ব্যক্তির বেশ ধরে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালায়