সূরা আন'আম; আয়াত ১০৩-১০৬
সূরা আন’আমের ১০৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ
"কোনো দৃষ্টি তাকে অবধারণ করতে পারে না কিন্তু তিনি সব দৃষ্টিকে অবধারণ করে আছেন। আর তিনিই সুক্ষ্মদর্শী,সুবিজ্ঞ।" (৬:১০৩)
গত পর্বে আমরা আল্লাহর গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করেছি। এ আয়াতে আল্লাহর আরেকটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, মানুষের দৃষ্টিশক্তি দিয়ে আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়। মানুষ কেবল আল্লাহর অস্তিত্ব ও তার গুণাবলীকে উপলব্ধি করতে পারে। যদিও মানুষের খুঁটিনাটি সব বিষয়েই আল্লাহ অবহিত। মানুষের কথাবার্তাই শুধু নয় বরং তার দৃষ্টি সম্পর্কেও আল্লাহ পুরোপুরি জানেন। তিনি সব কিছু সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং লোকচক্ষু দিয়ে তাকে দেখা যায় না। তবে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব কিছু সম্পর্কেই আল্লাহ ভালোভাবে জানেন।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. আল্লাহর সত্তাগত রহস্য জানা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই এ নিয়ে চিন্তা করলে বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
দুই. আল্লাহ আমাদের খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানার পরও আমাদেরকে অনুগ্রহ করেন। তিনি সব জেনেও আমাদের জন্য তার নেয়ামতগুলো বন্ধ করে দেন না। কারণ তিনি মানুষের কল্যাণ চান। আল্লাহ এর মাধ্যমে মানুষকে সৎ পথে ফিরে আসার সুযোগ দেন।
সূরা আন'আমের ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قَدْ جَاءَكُمْ بَصَائِرُ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ أَبْصَرَ فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ عَمِيَ فَعَلَيْهَا وَمَا أَنَا عَلَيْكُمْ بِحَفِيظٍ
"তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে নিদর্শনাবলী এসে গেছে। অতএব,যে প্রত্যক্ষ করবে,সে নিজেরই উপকার করবে এবং যে তা দেখবে না, সে নিজেরই ক্ষতি করবে। আমি তোমাদের ঈমানের জামিনদার নই।" (৬:১০৪)
এ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলছেন,যেসব বিষয় বলার ছিল তা বলে দেয়া হয়েছে এবং সত্যকে স্পষ্ট করা হয়েছে। সত্যকে সঠিকভাবে চেনার জন্য যা যা প্রয়োজন ছিল, তার সবই যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু কাউকে তা গ্রহণ করতে বাধ্য করা হবে না। কেউ যদি সত্যকে গ্রহণ করে তাহলে সেটা তার জন্যই মঙ্গলজনক হবে। সত্য মেনে চলার বিষয়ে কাউকে জোর-জবরদস্তি করা হয়নি। কারণ আল্লাহই চেয়েছেন, ঈমান অথবা কুফরির পথ বেছে নেয়ার বিষয়টি থাকবে ঐচ্ছিক। যে যার ইচ্ছে মতো তার পথ বেছে নেবে এবং পরিণতি ভোগ করবে।
সূরা আন'আমের ১০৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَكَذَلِكَ نُصَرِّفُ الْآَيَاتِ وَلِيَقُولُوا دَرَسْتَ وَلِنُبَيِّنَهُ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
"এভাবেই আমি বিভিন্নভাবে আমার আয়াতগুলোকে বর্ণনা করি। কিন্তু (কাফিররা ঈমান না এনে) বলে, তুমি (অন্যদের কাছ থেকে)পড়ে এসেছ। (তাদেরকে বলতে দাও)আমি জ্ঞানীদের জন্য সত্যকে বর্ণনা করি।" (৬:১০৫)
কাফির ও মুশরিকরা রাসূল (সা.)কে যেসব অপবাদ দিতো তার মধ্যে একটি হলো, রাসূল (সা.) ইহুদি মনীষীদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয় শিখে এসে ওই সব কথাই তাদের কাছে উপস্থাপন করতেন। তারা কুরআনের বাণীকে অস্বীকার করতো। আল্লাহতায়ালা এ পরিস্থিতিতে রাসূল (সা.)কে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, এ ধরনের অপবাদে দুঃখ পাবেন না, কারণ জ্ঞানীরা এমন অপবাদে কান দেবে না। এর মাধ্যমে কাফির ও মুশরিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা তাদের পক্ষে কোন যুক্তি-প্রমাণ তুলে ধরতে পারে না। কারণ তাদের কাছে কোন যুক্তি-প্রমাণই নেই। কারণ রাসূল (সা.) কখনোই পড়ালেখার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে যাননি।
সূরা আন'আমের ১০৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
اتَّبِعْ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
"আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার কাছে যে ওহী আসে, আপনি তারই অনুসরণ করুন,তিনি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই এবং মুশরিকদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন।" (৬:১০৬)
কাফিরদের অপবাদের জবাবে আল্লাহতায়ালা রাসূল (সা.)কে বলছেন, কাফির ও মুশরিকদের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবলি আল্লাহর ওহীর প্রতি মনোযোগী হোন ও সে অনুযায়ী কাজ করুন। আল্লাহ আপনার সঙ্গে রয়েছেন। কাফির ও মুশরিকদের কাছে সত্য পৌঁছে দেয়াটাই দায়িত্ব। তাদেরকে সত্য মেনে নিতে বাধ্য করার দরকার নেই। সত্যকে গ্রহণ না করলে আমি তাদেরকে তাদের মতো ছেড়ে দেবো।
তাদেরকে অনুনয়-বিনয় করে সত্যের দিকে আহ্বানের প্রয়োজন নেই,কারণ এমনটি করা হলে তারা ভাববে, তাদের ঈমান আল্লাহর জন্য খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কাফির ও মুশরিকদেরকে সৎ পথে আনার জন্য প্রথমে তাদের সঙ্গে নম্রভাবে যুক্তি দিয়ে কথা বলতে হবে। এরপরও তারা ঈমান না আনলে তাদেরকে এ জন্য জোর- জবরদস্তি করার দরকার নেই। মানুষ ঈমান এনে উপকৃত হোক আল্লাহ তাই চান। কিন্তু কেউ ঈমান না আনলে আল্লাহ কোন ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হন না। যে ঈমান আনলো না, সেই-ই ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো:
এক. সত্য পথে থাকলে বিপথগামীরা নানা অপবাদ দেবে। তবে এসব অপবাদে প্রভাবিত না হয়ে সত্যের পথে অটল থাকতে হবে।
দুই. আল্লাহ রাসূল (সা.)এর ওপর যেসব নির্দেশ দিয়েছেন তিনি সেসব নির্দেশকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেছেন।