সূরা ইব্রাহীম;(১০ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা ইব্রাহীম;(১০ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 2:0:5 3-10-1403

সূরা ইব্রাহীম; আয়াত ৩৬-৩৯

সূরা ইব্রাহিমের ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

"হে আমার প্রতিপালক! এসব প্রতিমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সেই আমার দলভুক্ত। কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে তুমি নিশ্চয়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।" (১৪:৩৬)

আগের পর্বে আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর দোয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহিম নিজে তাঁর বংশধরদের মুর্তিপূজা থেকে বিরত রাখতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। আজকের আয়াতে ওই দোয়ার পরবর্তী অংশে তিনি বলছেন : কাঠ, মাটি ও পাথরের তৈরি মুর্তিগুলোর সৌন্দর্য এবং মানুষের নির্বুদ্ধিতার ফলে তারা একক, অদ্বিতীয় ও সর্বশক্তিমান সত্ত্বা- আল্লাহ থেকে দূরে সরে গেছে। মানুষ নবী-রাসূলদের শিক্ষা অনুসরণ করার পরিবর্তে নিজেদের তৈরি মুর্তির সামনে মাথানত করছে এবং তাদের জন্য মানত করাকে গর্বের কাজ বলে মনে করছে। অথচ নবী-রাসূলদের দেখানো পথই ছিল তাদের জন্য উত্তম। এ কারণে হযরত ইব্রাহিম (আ.) মুর্তিগুলো ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি এত উঁচু মর্যাদার অধিকারী ছিলেন যে, তার পক্ষে মুর্তিপূজকদের ওপর অভিসম্পাত করা সম্ভব হয় নি। তাদের ওপর আসমানী শাস্তি নামিয়ে আনার দোয়াও তিনি করেননি বরং, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।

এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়, ধর্মীয় সম্পর্ক পারিবারিক সম্পর্কের উর্ধ্বে। নবী রাসূলদের সাথে মুমিন ব্যক্তির রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তাদেরকে নবী-রাসূলদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে উল্লেখ করা যায়। অন্যদিকে কাফের যদি নবীর সন্তানও হয় তাকে নবী-রাসূলদের বংশধর বলা যায় না, যেমনটি হয়েছিল হযরত নুহ (আ.) এর ক্ষেত্রে। এছাড়া শিল্প যদি পথভ্রষ্ট লোকদের সেবায় নিয়োজিত থাকে, তবে তা অন্য সকলকে বিপথে পরিচালিত করে। মুর্তি প্রস্তুতকারকরা নানা রংয়ের সুসজ্জিত মুর্তি তৈরি করে মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে সরিয়ে পথভ্রষ্ট করতো।

সূরা ইব্রাহিমের ৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :

رَبَّنَا إِنِّي أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِنَ النَّاسِ تَهْوِي إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُمْ مِنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ

"হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার এক সন্তানকে পানি ও তৃনহীন ভূমিতে তোমার পবিত্র গৃহের নিকট বসবাসের জন্য রেখে গেলাম। হে প্রভূ! (আমি এমনটি করেছি) যাতে তারা যথাযথভাবে নামাজ আদায় করে। এখন তুমি কিছু লোকের অন্তর ওদের প্রতি অনুরাগী করে দাও এবং ফলফলাদি দ্বারা ওদের জীবিকার ব্যবস্থা করো। হয়তো ওরা (তোমার প্রতি) কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে।" (১৪:৩৭)

আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর স্ত্রী ও দুধের শিশু ইসমাইলকে মক্কায় রেখে শামদেশে ফিরে যান। সে সময় মক্কা ছিল ধু ধু মরুভূমি এবং সেখানে কোন পানি বা ঘাষ, লতাগুল্ম ছিল না। তিনি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন যেন তাদের ওপর আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত বর্ষিত হয় এবং মরুভূমির বাসিন্দারা তাদের সাথে উত্তম আচরণ করে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলার জন্য অনেক সময় নিজ আবাসভূমি ত্যাগ করে নির্বাসিত জীবনও বেছে নিতে হয়। সে অবস্থায় অনেক সামাজিক সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত হয়ে চরম কষ্টে দিনাতিপাতের প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া মানুষের মনের নিয়ন্ত্রণ আল্লাহর হাতে রয়েছে। কাজেই মানুষের মনে নিজের স্থান করে নিতে চাইলে আল্লাহর সহযোগিতা কামনা করতে হবে। অন্যায় ও অসৎ উপায়ে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করা উচিত নয়।

সূরা ইব্রাহীমের ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

رَبَّنَا إِنَّكَ تَعْلَمُ مَا نُخْفِي وَمَا نُعْلِنُ وَمَا يَخْفَى عَلَى اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ

"হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা যা প্রকাশ করি অথবা গোপন রাখি, তার সবই তুমি জানো। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর কোন কিছুই আল্লাহর কাছে গোপন থাকে না।" (১৪:৩৮)

হযরত ইব্রাহিম (আ.) মক্কার লোকদের রিজক বা রুজি বৃদ্ধি এবং তাদের মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে এই আয়াতে বললেন : হে আল্লাহ! তুমি তো সর্বজ্ঞ এবং তোমার অগোচরে কিছুই নেই। মানুষের মনের কথা ও কাজ কিংবা তোমার তৈরি বিশ্বপ্রকৃতি এবং আকাশমণ্ডলী ও ভূপৃষ্ঠের সব বিষয়ে তুমি সম্যক অবহিত। সূরা ইব্রাহিমের এই আয়াতে সৃষ্টজগতের ওপর আল্লাহর একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহর কাছে ছোট-বড়, মানুষ, আকাশ বা প্রকাশ্য ও গোপন বস্তু- সব কিছুই সমান। এছাড়া ভালো কোন কাজ করলে সেজন্য অহঙ্কার করা উচিত নয়। মনে মনেও অহঙ্কার করা উচিত নয়, কারণ, আল্লাহ মনের খবরও জানেন।

সূরা ইব্রাহিমের ৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِنَّ رَبِّي لَسَمِيعُ الدُّعَاءِ

“প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য, যিনি আমাকে আমার বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক প্রার্থনা শোনেন (এবং তা কবুল করেন)।" (১৪:৩৯)

হযরত ইব্রাহিম (আ.) তার সন্তানদের জন্য দোয়া করার পাশাপাশি তাদেরকে দান করার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। কারণ, মহান আল্লাহ হযরত ইব্রাহিমের অনুরোধে সাড়া দিয়ে বৃদ্ধ বয়সে হযরত ইসমাঈলকে দান করেছিলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, হযরত ইব্রাহিমের দুই সন্তান অর্থাৎ ইসমাঈল ও ইসহাক উভয়েরই বংশধারা থেকে পরবর্তী নবী রাসূলগণ ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছেন। তবে ঐ দুই জনের একজনের মা ছিলেন ক্রীতদাসী এবং অপরজন ছিলেন সাধারণ নারী। কিন্তু তারা দুজনই আল্লাহর খাঁটি বান্দা ছিলেন বলে পরবর্তী নবী রাসূলগণ তাদের গর্ভস্থ সন্তানদের মাধ্যমে পৃথিবীতে এসেছেন।

মুফাসসিরগণের মতে, সন্তান আল্লাহর দান। কাজেই এই দানের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে সন্তানদের আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার জন্য তাঁর সাহায্য কামনা করা উচিত।