সূরা ইব্রাহীম;(৮ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা ইব্রাহীম;(৮ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 2:33:2 3-10-1403

সূরা ইব্রাহীম; আয়াত ২৮-৩১

সূরা ইব্রাহীমের ২৮ ও ২৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ بَدَّلُوا نِعْمَةَ اللَّهِ كُفْرًا وَأَحَلُّوا قَوْمَهُمْ دَارَ الْبَوَارِ (28) جَهَنَّمَ يَصْلَوْنَهَا وَبِئْسَ الْقَرَارُ

"তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা আল্লাহর নেয়ামতকে কুফরে পরিণত করেছে এবং স্বজাতিকে ধ্বংসালয়ের সম্মুখীন করেছে।” (১৪:২৮)

“জাহান্নামে, যার মধ্যে তারা প্রবেশ করবে, কত নিকৃষ্ট এই বাসস্থান।" (১৪:২৯)

এই আয়াতে অত্যাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যারা কুফরি বা আল্লাহর নাফরমানীর মাধ্যমে সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তারা একত্ববাদের পরিবর্তে কুফরি ও শেরকের (অংশীবাদ) প্রচলন ঘটাতে চায়। পূর্ব পুরুষদেরকে অনুসরণের নামে তারা অতীতের ভুল রীতি-নীতি প্রচলনের মাধ্যমে গোটা সমাজকেই বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দেয়। সাধারণ মানুষের মন-মানসিকতা বৈষয়িক চিন্তার দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়ে থাকে। আর বৈষয়িক দিক থেকে সমাজের দুর্নীতিপরায়ণ অসাধু ব্যক্তিদের অবস্থা খুব সংহত হয়ে থাকে। ফলে সাধারণ মানুষ সৎ, নীতিবান ও ধার্মিকদের পেছনে না গিয়ে এসব দুর্নীতিবাজদের পেছনে ছুটতে থাকে। ফলে এ ধরনের সমাজ ইহকালে যেমন অবক্ষয়ের শিকার হয় তেমনি পরকালেও তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী।

এই আয়াত থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ঐশী বাণীতে যে কোন ধরনের প্রক্ষেপ, পরিবর্তন বা বিকৃতিই কুফরি। তা ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে করা হলেও একই কথা। আর কুফরি দুনিয়ায় যেমন একটি সমাজকে ধ্বংসের অতলে নিয়ে যায় তেমনি আখেরাতও বরবাদ করে দেয়।

এই সূরার ৩০ নম্বর বলা হয়েছে,

وَجَعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا لِيُضِلُّوا عَنْ سَبِيلِهِ قُلْ تَمَتَّعُوا فَإِنَّ مَصِيرَكُمْ إِلَى النَّارِ

“তারা মানুষকে আল্লাহর পথ হতে বিভ্রান্ত করার জন্য তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করায়, বলুন, ভোগ করে নাও, পরিণামে অগ্নিই তোমাদের প্রত্যাবর্তনের স্থল।" (১৪:৩০)

আগের আয়াতে বলা হয়েছে, সমাজের পথভ্রষ্ট নেতারা আল্লাহর নেয়ামতকে কুফরিতে রূপান্তর করে এবং সমাজকে বিভ্রান্তিতে নিপতিত করে। এই আয়াতে এর একটি উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, এই সব নেতারা মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের কথা না বলে নিজেদেরকে অন্ধভাবে অনুসরণের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে। এই সব নেতারা বৈষয়িক স্বার্থের জন্য প্রকৃতপক্ষে আনুগত্যের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে আল্লাহর শরীকে পরিণত করেছে। এদেরকে দুনিয়ায় বাহ্যতঃ সফল মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা সফল নয় আর আখেরাতে তো তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে।

আল্লাহর বিধান উপেক্ষা করে মানুষ যদি নিজ থেকে অনুরূপ বিধান রচনা করে সেটাই হবে শিরক। এ ধরনের মানব রচিত বিধান মানুষের কল্যাণে তো আসেই না বরং এর মাধ্যমে গোটা সমাজ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

সূরা ইব্রাহীমের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

قُلْ لِعِبَادِيَ الَّذِينَ آَمَنُوا يُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلَانِيَةً مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لَا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خِلَالٌ

“আমার বান্দাদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী তাদেরকে বলে দিন যথাযথভাবে নামাজ কায়েম করতে এবং আমি যা দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করতে- সে দিনের পূর্বে যে দিন লেনদেন ও বন্ধুত্ব থাকবে না।" (১৪:৩১)

আগের আয়াতে বিভ্রান্ত ও অসৎ নেতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পরিণতির কথা বলার পর এই আয়াতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ঈমানদারদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন, তাদেরকে বলে দিন তারা যেন যথাযথভাবে নামাজ পড়ে এবং জাকাত ও দান-খয়রাত করে। খোদাদ্রোহীরা যদি মানুষকে তাদের আনুগত্যের কথা বলে তাহলে আপনি মানুষকে তাদের প্রতিপালকের আনুগত্যের দিকে আহ্বান করুন। ঈমানদারদেরকে এটা স্মরণ করিয়ে দিন যে, নামাজ এবং যাকাত আমার আনুগত্যের প্রতীক।

পৃথিবীতে বন্ধুত্বের খাতিরে কিংবা উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে অনেক কাজ সমাধান করা সম্ভব হয় কিন্তু পরকালে এসব কোন কাজেই আসবে না, সেখানে মানুষের সৎকর্মই হবে ভাগ্য নির্ধারণের একমাত্র উপাদান। সৎকর্ম বা দান-খয়রাত যদি প্রকাশ্যে করতে হয় তাহলে লক্ষ্য রাখতে হবে তা যেন রিয়া বা লোক দেখানের কারণে হয়ে না যায়। অনেক সময় সন্তান বা অন্যদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য এসব কাজ প্রকাশ্যে আঞ্জাম দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে রিয়া বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্য যেন মনে স্থান না পায় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

এই আয়াতে প্রকাশ্যে ও গোপনে দান করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে মুফাসসিরদের অনেকেই বলেছেন, যাকাত ও খোমস্ প্রকাশ্যে দেয়া উচিত যাতে সমাজে এ ব্যাপারে কারো সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ তৈরী না হয় । আর অন্যান্য মুস্তাহাব দান-খয়রাত গোপনে করা উচিত যাতে দানকারীর এখলাসের মানসিকতার উন্নতি সাধিত হয়।

ঈমানদারদের কাছে আল্লাহর আনুগত্যই গর্বের বিষয়, কারণ এর ফলে একজন ঈমানদার মানুষের দাসত্ব ও বস্তুজগতের মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। এই আয়াতে ইসলামের সামাজিক দায়িত্ব বোধের বিষয়টিও ফুঠে উঠেছে, এখানে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ববান হওয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।