সূরা ইব্রাহীম;(৬ষ্ঠ পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা ইব্রাহীম;(৬ষ্ঠ পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 2:35:14 3-10-1403

সূরা ইব্রাহীম; আয়াত ১৯-২২

সূরা ইব্রাহীমের ১৯ ও ২০ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيدٍ (19) وَمَا ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ بِعَزِيزٍ

“তুমি কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী যথাবিধি সৃষ্টি করেছেন? তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের অস্তিত্ব বিলোপ করতে পারেন এবং এক নতুন সৃষ্টি অস্তিত্বে আনতে পারেন।” (১৪:১৯)

“আর এটা আল্লাহর জন্য কঠিন কিছু নয়।" (১৪:২০)

এর আগের কয়েকটি আয়াতে নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণের বিভিন্ন উদাহরণ এবং তাদের পরিণতির বিষয়ে বলা হয়েছে যা আমরা আগের পর্বে আলোচনা করেছি। এই আয়াতে অবিশ্বাসী কাফের এবং মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে যে,কেউ যেন এই ধারণা না করে যে আকাশ,পৃথিবী এবং মানুষ এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে এবং বিশ্ব-প্রকৃতি সৃষ্টির পেছনে কোন পরিকল্পনা ছিল না! বরং বিশ্বজগত এবং এতে যা কিছু আছে সবই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ইচ্ছা এবং তাঁরই পরিকল্পনায় অস্তিত্ব লাভ করেছে। কাজেই আল্লাহ যদি চায় তাহলে তিনি মানব প্রজাতির বিলোপ সাধন করে এর পরিবর্তে অন্য কোন সৃষ্টি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।

এই অস্তিত্বমান বিশ্বজগতের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। জগতের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা এবং উত্থান-পতন এমনিতেই ঘটে চলছে না। তোমরা মনে করো না এর কোন নিয়ন্তা নেই ফলে যে যার মত চলবে এবং ভোগ করবে! সৃষ্টিকর্তার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ মনে করা উচিত হবে না।

এই আয়াতের লক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ মানুষের অস্তিত্বের মুখাপেক্ষি নন। মানুষের প্রার্থনা বা এবাদত-বন্দেগী যে তাঁর খুব দরকার এমনটিও নয়। কাজেই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে দম্ভ করা বোকামী ছাড়া কিছু নয়। মহাবিশ্বে আল্লাহর ক্ষমতার কোন তুলনা নেই। তিনি ইচ্ছা করলে দুনিয়ার বুক থেকে মানব জাতিকে বিলুপ্ত করে এর স্থানে অন্য কোন সৃষ্টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।

এই সূরার ২১ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَبَرَزُوا لِلَّهِ جَمِيعًا فَقَالَ الضُّعَفَاءُ لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا إِنَّا كُنَّا لَكُمْ تَبَعًا فَهَلْ أَنْتُمْ مُغْنُونَ عَنَّا مِنْ عَذَابِ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ قَالُوا لَوْ هَدَانَا اللَّهُ لَهَدَيْنَاكُمْ سَوَاءٌ عَلَيْنَا أَجَزِعْنَا أَمْ صَبَرْنَا مَا لَنَا مِنْ مَحِيصٍ

"(কেয়ামতের দিন) সকলেই আল্লাহর নিকট উপস্থিত হবেই। তখন দুর্বলরা (দুনিয়ার) অহংকারীদেরকে বলবে, আমরা তো তোমাদের অনুসারী ছিলাম, এখন তোমরা আল্লাহর শাস্তি হতে আমাদের কি কিছুমাত্র রক্ষা করতে পারবে? তারা বলবে আল্লাহ আমাদেরকে সৎ পথে পরিচালিত করলে আমরাও তোমাদেরকে সৎ পথে পরিচালিত করতাম। এখন আমাদের জন্য ধৈর্যচ্যুত হওয়া অথবা ধৈর্যশীল হওয়া একই কথা। আমাদের কোন নিষ্কৃতি নেই।" (১৪:২১)

সব দেশে এবং সব সমাজেই দেখা যায় সাধারণ মানুষ সমাজের বা রাষ্ট্রের প্রভাবশালী, ক্ষমতাবানদেরকেই অনুসরণ করে চলে। কাজেই এটা খুবই স্বাভাবিক যে, রাষ্ট্র যন্ত্র বা ক্ষমতাবানরা যদি অযোগ্য এবং পথভ্রষ্ট হয় তাহলে গোটা সমাজই অনাচার ও পথভ্রষ্টতার অন্ধকারে তলিয়ে যায়। তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে,সৃষ্টিকর্তা চান না কোন মানুষ অন্য কোন মানুষের দাসত্ব করুক কিংবা আল্লাহ এবং তাঁর মনোনিত ব্যাক্তিদের ছাড়া অন্য কারো অন্ধ অনুসরণ করুক। এমনকি পিতা-মাতাকেও অন্ধভাবে অনুসরণ করা যায় না। এ বিষয়ে কেয়ামতের দিন কোন ধরণের কৈফিয়ত গ্রহণ যোগ্য হবে না। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, ইহকালে যদি কেউ কোন ব্যাক্তি বা শাসককে অন্ধভাবে অনুসরণ করে তাহলে পরকালে তাদের সাথেই তার পুনরুত্থান হবে এবং তাদেরও মুক্তির কোন পথ থাকবে না।

ইহকালে যে সব দাম্ভিক ব্যাক্তি পয়গম্বর বা তাঁদের প্রতিনিধিদেরকে বলতো তোমরা আমাদেরকে নসিহত কর আর নাই কর কোন পার্থক্য নেই, আমরা আমাদের পথেই চলবো। পরকালে এরাই তাদের অনুসারিদেরকে বলবে,ধৈর্য ধারণ করা আর অস্থির হয়ে পড়া আমাদের জন্য একই কথা। কারণ আমাদের মুক্তির কোন পথ নেই।

এই আয়াতে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে,জনগণের মঙ্গল-অমঙ্গলের বিষয়টি সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদের চিন্তা-চেতনা এবং মনমানসিকতার উপর অনেকটা নির্ভরশীল। যারা এই দুনিয়ায় দম্ভ এবং অহংকারের কারণে নিজেকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে মনে করেছে তারা পরকালে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে নিজেদের অক্ষমতার কথা স্বীকার করবে।

এ সূরার ২২ নং আয়াতে বলা হয়েছে,

وَقَالَ الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الْأَمْرُ إِنَّ اللَّهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدْتُكُمْ فَأَخْلَفْتُكُمْ وَمَا كَانَ لِي عَلَيْكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا أَنْ دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي فَلَا تَلُومُونِي وَلُومُوا أَنْفُسَكُمْ مَا أَنَا بِمُصْرِخِكُمْ وَمَا أَنْتُمْ بِمُصْرِخِيَّ إِنِّي كَفَرْتُ بِمَا أَشْرَكْتُمُونِ مِنْ قَبْلُ إِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“যখন (কেয়ামতের ময়দানে) সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে তখন শয়তান বলবে, তোমাদেরকে আল্লাহ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা সত্য, আমিও তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম,কিন্তু আমি আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। আমার তো তোমাদের ওপর কোন আধিপত্য ছিল না। আমি কেবল তোমাদেরকে আহ্বান করেছিলাম এবং তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলে। সুতরাং তোমরা আমার প্রতি দোষারোপ করো না। তোমরা নিজেদেরকেই দোষারোপ কর। আমি তোমাদেরকে উদ্ধার করতে সক্ষম নই এবং তোমরাও আমার মুক্তিতে সাহায্য করতে সক্ষম নও। তোমরা এর আগে আমাকে আল্লাহর অংশী করেছিলে, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। অত্যাচারিদের জন্য রয়েছে মর্মান্তিক শাস্তি।” (১৪:২২)

এই আয়াতের ভাষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কেয়ামতের দিন দূরাচারী-পাপিষ্ঠ ব্যক্তিরা নিজেদের পাপ ও অপরাধের সাফাই দেয়ার জন্য অজুহাত খুঁজতে থাকবে। এবং নিজেদের পথভ্রষ্টতার জন্য একেকবার একেক জনকে দোষারোপ করতে থাকবে। আগের আয়াতে বলা হয়েছে, পাপাচারী ব্যাক্তিরা কেয়ামতের দিন সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদের এবং শাসক শ্রেণীকে তাদের বিভ্রান্তির জন্য দায়ী করবে। সেদিন তারা বলবে, আমরা যে ভুল পথে চলেছি-এজন্য এরাই দায়ী। এই আয়াতে শয়তানের কথা বলা হচ্ছে। সেদিন পাপিষ্ঠদের অনেকেই শয়তানকে দায়ী করবে। কিন্তু শয়তান তাদের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলবে, আমি যদি তোমাদেরকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়েই থাকি তাহলে আল্লাহও তো এধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কেন তোমরা আল্লাহর প্রতিশ্রুতিকে আমলে নাওনি? কেন পয়গম্বরদের আহ্বানে সাড়া দাওনি?

এছাড়া, আমি তো তোমাদেরকে পাপ কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য করি নি। আমি শুধু তোমাদেরকে প্ররোচিত করেছি, তোমরা জ্ঞান বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছ। এখন কেন তোমরা আমার ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছো?

শয়তান আরো বলবে, আজ হাশরের ময়দানে আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আমি নিজেই আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। আমার অনুশোচনা হয়, তোমরাই বা কেন আমাকে অনুসরণ করেছিলে?

এই আয়াত থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, নানা কুমন্ত্রণার মাধ্যমে পাপ কাজের প্রতি অনুপ্রাণিত করা শয়তানের কাজ। শয়তান কখনো মানুষকে পাপে লিপ্ত হতে বাধ্য করতে পারে না। কাজেই কেয়ামতের আদালতে পাপচারের জন্য শয়তানকে দায়ী করে পার পাওয়া যাবে না।