সূরা ইব্রাহীম;(১২তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা ইব্রাহীম;(১২তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 2:13:18 3-10-1403

সূরা ইব্রাহীম; আয়াত ৪৬-৫২

সূরা ইব্রাহিমের ৪৬ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَقَدْ مَكَرُوا مَكْرَهُمْ وَعِنْدَ اللَّهِ مَكْرُهُمْ وَإِنْ كَانَ مَكْرُهُمْ لِتَزُولَ مِنْهُ الْجِبَالُ (46) فَلَا تَحْسَبَنَّ اللَّهَ مُخْلِفَ وَعْدِهِ رُسُلَهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ ذُو انْتِقَامٍ

"ওরা ওদের সাধ্যমত চক্রান্ত করেছিল, কিন্তু ওদের চক্রান্ত আল্লাহর কাছে (স্পষ্ট)। তাদের ষড়যন্ত্র পাহাড় টলিয়ে দেয়ার মতো হবে না।” (১৪:৪৬)

“তুমি কখনো মনে কর না যে, আল্লাহ তার রাসূলগণের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী দণ্ডদাতা।" (১৪:৪৭)

আগের আয়াতগুলোতে কেয়ামতের দিন সীমা লংঘনকারী ব্যক্তিদের পরিণতি এবং তাদের মনের আকাঙ্ক্ষাগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা পূর্বসূরিদের পরিণতি থেকে শিক্ষা না দিয়ে বিপদগামী হয়েছে এবং সঠিক পথে ফিরে আসার কোন প্রবণতা তাদের মধ্যে নেই। এই আয়াতে বলা হচ্ছে : সীমা লংঘনকারী নেতৃবৃন্দ ও শাসকগণ যত ষড়যন্ত্রই করুক না কেন, আল্লাহ তা জানেন এবং সেসব নস্যাত করে দেয়ারও ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। সীমালংঘনকারীরা যদি পাহাড় ধ্বংস করে ফেলতে বা পাহাড়ের অবস্থান এদিক সেদিক করে দিতেও সক্ষম হয়, তারপরও তারা যেন না ভাবে তারা আল্লাহর অধীনত্ব থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। তারা যেন এটাও না ভাবে, আল্লাহ সত্যের বিজয় ও অসত্যের বিনাস সম্পর্কে তাঁর নবী-রাসূলদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়িত হবে না। কারণ, মহান আল্লাহর মোকাবিলা করা কোন শক্তির পক্ষেই সম্ভব নয়। আল্লাহ ইচ্ছে করলে তার কঠোর শাস্তি থেকে কেউই রেহাই পাবে না।

এই দুই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়, মুমিন বিশ্বাসীদের প্রতি আল্লাহর সাহায্য আসতে দেরী হলে আল্লাহ ও তার সর্বময় ক্ষমতার ব্যাপারে সন্দিহান হওয়া উচিত নয়। এছাড়া অবিশ্বাসী কাফের ও সীমালংঘনকারীদের আল্লাহ যে সময় ও সুযোগ দেন তা তাঁর প্রজ্ঞা অনুযায়ী দেয়া হয়। এ থেকে এটা ধারণা করার কোন অবকাশ নেই যে, আল্লাহ অবাধ্যচারীদের ব্যাপারে উদাসীন ও তাদের খোঁজ খবর নিতে ভুলে গেছেন।

সূরা ইব্রাহিমের ৪৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمَاوَاتُ وَبَرَزُوا لِلَّهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ

"যেদিন এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবীতে পরিণত হবে এবং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হবে।" (১৪:৪৮)

কেয়ামতের দিনের অন্যতম নিদর্শন হবে এই যে, সেদিন আকাশমণ্ডলী ও ভূপৃষ্ঠের বর্তমান রূপ আমূল বদলে যাবে। পবিত্র কুরআনের বহু আয়াতে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে পাহাড়-পর্বতগুলো তাদের স্থান থেকে বিচ্যূত হয়ে বাতাসে উড়তে থাকবে। সূর্যের আলো নিভে যাবে, তারকারাজি পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে এবং বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার অবসান ঘটবে। এরপর নতুন বিশ্বজগৎ গড়ে উঠবে, মৃতরা জীবিত হবে এবং নিজেদের কৃতকর্মের পুরস্কার বা শাস্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর আদালতে উপস্থিত হবে। ঐ আদালতের বিচারপতি থাকবেন স্বয়ং মহাপ্রভূ আল্লাহ এবং সে আদালতের সর্বময় ক্ষমতা তাঁরই হাতে থাকবে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, অবাধ্য ও সীমালংঘনকারীরা এই পৃথিবীতে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি না পেলেও কেয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতের কাঠগড়ায় তাদের ঠিকই দাঁড়াতে হবে। তাদের পালিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। কেয়ামতের দিন কাফের, মুশরিক ও সীমালংঘনকারীদের প্রতি কোন রকম অনুকম্পা প্রদর্শন করা হবে না, বরং সেদিন তারা আল্লাহর চরম ক্রোধের সম্মুখীন হবে।

সূরা ইব্রাহিমের ৪৯ ও ৫০ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন :

وَتَرَى الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ مُقَرَّنِينَ فِي الْأَصْفَادِ (49) سَرَابِيلُهُمْ مِنْ قَطِرَانٍ وَتَغْشَى وُجُوهَهُمُ النَّارُ

"সেদিন তুমি অপরাধীগণকে দেখবে হাত-পা বাধা অবস্থায়।” (১৪:৪৯)

“ওদের পোশাক হবে আলকাতরার তৈরি এবং অগ্নি ওদের মুখমণ্ডল আচ্ছন্ন করবে।" (১৪:৫০)

এই আয়াতে কেয়ামতের দিন অপরাধী ব্যক্তিরা যে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। সেদিন তীব্র আযাবের ফলে সীমালংঘনকারীদের কী অবস্থা হবে তা বর্ণনা করা হয়েছে। হাত, পা ও গলায় বেরি পরানো হলে তার যেমন শারীরিক কষ্ট রয়েছে, তেমনি তা মানসিকভাবেও অস্বস্তিকর। সেইসঙ্গে অন্যান্য অপরাধীর সামনে এসব শাস্তি দেয়া হবে যা আরো বেশী কষ্টকর। জাহান্নামবাসীর পোশাক হবে আলকাতরার মতো দুর্গন্ধযুক্ত ও দাহ্য পদার্থ দিয়ে যা আগুনের প্রজ্জ্বলন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে। পবিত্র কুরআন কেয়ামতের দিবসকে এমনভাবে তুলে ধরেছে যেন আমরা তা স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। কোন কোন মুফাসসির মনে করেন, এই পার্থিব জীবনে সীমা লংঘনকারীরা যেসব পোশাক পরে নিজের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলে মানুষের মনে কামনা বাসনাকে জাগ্রত করে কিংবা দম্ভ প্রকাশ করে, সেইসব পোশাকই কেয়ামতের দিন তাদের আযাবের হাতিয়ারে পরিণত হবে।

সূরা ইব্রাহিমের ৫১ ও ৫২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন :

لِيَجْزِيَ اللَّهُ كُلَّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ (51) هَذَا بَلَاغٌ لِلنَّاسِ وَلِيُنْذَرُوا بِهِ وَلِيَعْلَمُوا أَنَّمَا هُوَ إِلَهٌ وَاحِدٌ وَلِيَذَّكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ

"(কেয়ামতের দিন আসবে) যাতে আল্লাহ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের প্রতিদান দিতে পারেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যন্ত তড়িৎ হিসাব গ্রহণ করেন।” (১৪:৫১)

“এই কিতাব মানুষের জন্য এক বার্তা যাতে এ দ্বারা ওরা সতর্ক হয় এবং জানতে পারে যে, তিনি (আল্লাহ) একমাত্র উপাস্য এবং যাতে বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে।" (১৪:৫২)

এই সূরার শেষাংশে বলা হচ্ছে, ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে মানুষের ভালো ও মন্দ কাজের প্রতিদান হিসেবে পুরস্কার ও শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে কেয়ামতের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেখানকার বিচারপতি থাকবেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ। নবী রাসূলগণ যে শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাদের প্রতি যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তাতে বিজ্ঞজনদের জন্য রয়েছে শিক্ষণীয় বিষয় এবং অপরাধী ও সীমা লংঘনকারীদের জন্য রয়েছে সতর্কবার্তা। নবী রাসূলগণ না আসলে মানুষ অজ্ঞতায় ডুবে যেতো এবং যে কোন পাপাচার ও ভ্রান্তির দিকে পা বাড়ানোর পথে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকতো না। এই দুই আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়, পার্থিব জীবনের কোন কাজই প্রতিদানবিহীন থাকবে না এবং সকল কাজের হিসাব আল্লাহর কাছে রয়েছে। এছাড়া এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোন তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়াই যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে সতর্কবার্তারও প্রয়োজন রয়েছে। কোন বিষয় শুধুমাত্র জানা থাকা যথেষ্ট নয় সেই সাথে বারবার স্মরণ করারও প্রয়োজন রয়েছে।

(সূরা ইব্রাহিম সমাপ্ত)