সূরা রা’দ; (১৩তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা রা’দ; (১৩তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 2:26:1 3-10-1403

সূরা রা’দ; আয়াত ৩৯-৪১

সূরা রা’দের ৩৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

يَمْحُوا اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ

“আল্লাহ যা ইচ্ছা তা বাতিল করেন এবং যা ইচ্ছা তা বহাল রাখেন এবং মূল গ্রন্থ তাঁর কাছেই আছে।” (১৩:৩৯)

অনেক মানুষের ধারণা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন ঠিকই, তবে তা সৃষ্টি করার পর এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিজের হাতে রাখেন নি। তারা মনে করেন, এই বিশ্ব জগত নির্দিষ্ট এক নিয়মে আবর্তিত হচ্ছে,এতে কারো হাত নেই এমনকি এ ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তারও কোন ভূমিকা নেই। ইসলাম এই ধারণাকে বাতিল বলে গণ্য করে। ইসলামের দৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করে এর জন্য একটি নিয়ম সাব্যস্ত করেছেন। জগত বা প্রকৃতির জন্য নিয়ম সাব্যস্ত করার অর্থ এই নয় যে এর ওপর আল্লাহর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই এবং প্রকৃতির নিয়মে কোন পরিবর্তন আনা যাবে না।

এই আয়াতে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর সাথে সৃষ্টজগতের নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বে বিদ্যমান প্রাণীকূল, জড় বস্তু তথা সমগ্র সৃষ্টির সঞ্চালক হলেন মহান আল্লাহ। সব কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণ ও ভাগ্যলিপির অধিনে রয়েছে। তবে সৃষ্টি জগত ও জীবন বিধান সম্পর্কিত মূল গ্রন্থ আল্লাহর কাছেই সংরক্ষিত। আমাদের কাছে আজ যা স্থায়ী বা অপরিবর্তনশীল মনে হয় কালের পরিক্রমায় তা পরিবর্তন যোগ্য মনে হতে পারে। সূরা রাহমানে যেমন বলা হয়েছে, "তিনি প্রতি মুহূর্তে তাঁর পরিকল্পনা রূপায়নে রত রয়েছেন।" কাজেই কোন কোন বিধান স্থগিত বা পরিবর্তন হতে পারে, কারন অনেক বিধান আছে যা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এই সময়ের বিষয়টি সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ সবচেয়ে ভালো জানেন। এখানে উদাহরণ হিসেবে মুসলমানদের কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে কাবা শরীফের দিকে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি কিংবা তুর পাহাড়ে হযরত মুসা (আ.)-এর অবস্থানের মেয়াদ ত্রিশ থেকে চল্লিশ দিনে পরিবর্তিত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঐশী পুরস্কার কিংবা শাস্তির ক্ষেত্রেও একই ধরনের পরিবর্তনের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। যেমন হযরত ইউনুস (আ.) এর সম্প্রদায়ের জন্য এই দুনিয়াতেই ঐশী শাস্তি একেবারেই অনিবার্য ছিল কিন্তু আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার কারণে তাদের ওপর থেকে ঐশী শাস্তির খড়গ অপসারিত হয়ে যায়।

এই আয়াতে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ হচ্ছেন সর্বশক্তিমান এবং জগতের নিয়ন্তা। কাজেই জীবন বিধানে তিনি যেমন পরিবর্তন আনতে পারেন তেমনি প্রকৃতির নিয়মেও পরিবর্তন সাধন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব। এছাড়া সৃষ্টি জগতের জন্য যে গাইড বুক রয়েছে তা একমাত্র আল্লাহর কাছেই সংরক্ষিত।

এই সূরার ৪০নং আয়াতে বলা হয়েছে,

وَإِنْ مَا نُرِيَنَّكَ بَعْضَ الَّذِي نَعِدُهُمْ أَوْ نَتَوَفَّيَنَّكَ فَإِنَّمَا عَلَيْكَ الْبَلَاغُ وَعَلَيْنَا الْحِسَابُ

“(হে রাসূল) আমি কাফেরদের ব্যাপারে যে প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করেছি তার কোন একটি যদি আপনাকে দেখিয়ে দেই কিংবা ( তা সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই) আপনাকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেই; (জেনে রাখুন! আমার প্রতিশ্রুতি অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে) আপনার কর্তব্য তো প্রচার করা এবং হিসাব-নিকাশ তো আমার কাজ।" (১৩:৪০)

অবিশ্বাসী কাফেরদের হঠকারিতা এবং ঔদ্ধত্য আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াতে আল্লাহপাক তাঁর রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, আপনি নিশ্চিত থাকুন, তাদের হঠকারিতা এবং সত্য প্রত্যাখ্যানের জবাব তারা পাবেই। সেটা আপনার জীবদ্দশায় কিংবা আপনার মৃত্যুর পরও হতে পারে।

এছাড়া, এই আয়াতে আল্লাহ তাঁর রাসূলের দায়িত্ব নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছেন, আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য শুধু আল্লাহর বাণী প্রচার করা। আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করুন বাকীটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিন।

এই আয়াতের একটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মুবাল্লিগ বা ধর্ম প্রচারকদের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের কাছে সত্যের দাওয়াত পৌছে দেয়া। কার পরিণতি কী হবে তা নির্ধারণ করা আল্লাহর কাজ। এটা মানুষের কাজ নয়।

সূরা রা’দের ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا نَأْتِي الْأَرْضَ نَنْقُصُهَا مِنْ أَطْرَافِهَا وَاللَّهُ يَحْكُمُ لَا مُعَقِّبَ لِحُكْمِهِ وَهُوَ سَرِيعُ الْحِسَابِ

“তারা কি দেখে না যে, আমি তাদের দেশকে চতুর্দিক থেকে সমানে সঙ্কুচিত করে আসছি? আল্লাহ আদেশ করেন, তাঁর আদেশ রদ করার কেউ নেই এবং তিনি হিসাব গ্রহণে তৎপর।” (১৩:৪১)

আগের আয়াতে ঐশী শাস্তির প্রসঙ্গে বলার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, অবিশ্বাসীরা অতীত ইতিহাস থেকে কেন শিক্ষা গ্রহণ করে না? তারা কি দেখে নি যে ঐশী শাস্তির কারণে অনেক জাতি বা সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে? ঐশী শাস্তি প্রতিহত করার মত এমন কোন শক্তি কি আছে যার ওপর নির্ভর করে অবিশ্বাসী কাফেররা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করছে! তাদের পরিণামের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকা উচিত নয়। জগতের সকল কিছু আল্লাহর অধীনে। তার নির্দেশ অমান্য করার শক্তি কারো নেই।

যে কারো স্বাভাবিক মৃত্যুও আল্লাহর নির্দেশেই সংঘটিত হয়। মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ কারো নেই। জগতের সকল কিছুই নশ্বর ও ক্ষণস্থায়ী। একমাত্র আল্লাহর সত্ত্বাই অবিনশ্বর। তাঁর কোন শেষ নেই। তিনি চিরঞ্জীব সর্বব্যাপী মহান এক সত্ত্বা।