সূরা আন'আম; আয়াত ৫৩-৫৬
সূরা আন’আমের ৫৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَكَذَلِكَ فَتَنَّا بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لِيَقُولُوا أَهَؤُلَاءِ مَنَّ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنْ بَيْنِنَا أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِالشَّاكِرِينَ
"আমি এভাবে তাদের একদলকে অন্যদলের মাধ্যমে পরীক্ষা করেছি যেন তারা বলে,‘আমাদের মধ্যে কি এদের (এই গরীব সম্প্রদায়ের) প্রতিই আল্লাহ্ অনুগ্রহ করলেন?’ আল্লাহ্ কি কৃতজ্ঞ লোকদের বিষয়ে সর্বাধিক অবহিত নন?" (৬:৫৩)
এর আগের আয়াত নিয়ে আলোচনার সময় আমরা বলেছি, বেশিরভাগ মানুষই আশা করেছিলেন যে, রাসূল হবেন ফেরেশতাদের মধ্য থেকে। নবী-রাসূলরা ফেরেশতাদের মধ্য থেকে না হলেও ফেরেশতাদের কিছু বৈশিষ্ট্য তাদের মাঝে থাকবে। সে যুগের মানুষ এও ভেবেছিলেন যে, রাসূল (সা.) অবশ্যই গণক হবেন এবং তিনি অতীত ও ভবিষ্যত বলে দিতে পারবেন। এ আয়াতেও সে যুগের মানুষদের আরেকটি প্রত্যাশার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সমাজের কোনো কোনো ব্যক্তি সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান। তারা যখন রাসূলকে সাধারণ জীবনযাপন করতে দেখতেন, তখন তারা বিস্ময়ের সঙ্গে বলতেন-আল্লাহ তায়ালা আমাদের বাদ দিয়ে এ ধরনের সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত একজন ব্যক্তির ওপর ওহি নাজিল করলেন? যদি ওহি নাজিল করতে হয় তাহলে আমাদের ওপর নাজিল করা হোক।
পবিত্র কুরআন এ ধরনের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গীর জবাবে বলছে, ওহি পাওয়ার যোগ্যতা কখনোই অর্থ-সম্পদ ও পদমর্যাদার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না বরং ওহি পাওয়ার জন্য শর্ত হলো, স্বয়ং আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান ও যোগ্য হওয়া। আর আল্লাহই তার বান্দাদের অবস্থা সম্পর্কে ভালো জানেন। পৃথিবীতে অর্থ-সম্পদের অধিকারী হওয়া আল্লাহর কাছে পছন্দীয় ও যোগ্য হওয়ার মাপকাঠি নয়।
সূরা আন’আমের ৫৪ ও ৫৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَإِذَا جَاءَكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِآَيَاتِنَا فَقُلْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ كَتَبَ رَبُّكُمْ عَلَى نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ أَنَّهُ مَنْ عَمِلَ مِنْكُمْ سُوءًا بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابَ مِنْ بَعْدِهِ وَأَصْلَحَ فَأَنَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ (54) وَكَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآَيَاتِ وَلِتَسْتَبِينَ سَبِيلُ الْمُجْرِمِينَ
"আর যারা আমার আয়াতসমূহে ঈমান এনেছে তারা যখন আপনার কাছে আসে তখন আপনি তাদেরকে বলুনঃ ‘সালামুন আলাইকুম’ তোমাদের প্রতিপালক রহমত করাকে তাঁর নিজের দায়িত্ব বলে নির্ধারণ করে নিয়েছেন যে, তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অজ্ঞতাবশতঃ মন্দ কাজ করে বসে,অতঃপর তওবা করে ও সৎ হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ্ (তার প্রতি) ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। " (৬:৫৪)
"আর এভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিতরূপে বর্ণনা করি, যেন অপরাধীদের পথ সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।" (৬:৫৫)
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সা.) কে এ বার্তা দিচ্ছেন যে, ঈমানদার ব্যক্তি অনেক পাপ করলেও তাকে বিতাড়িত করা যাবে না বরং তাকে কাছে টেনে নিয়ে তওবা করতে বলতে হবে ও আল্লাহর ক্ষমাশীলতার কথা শুনাতে হবে।
মুসলমানদের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক হতে হবে আন্তরিকতা, ঘনিষ্ঠতা ও ভালোবাসাপূর্ণ। শুধু নিজেদের মধ্যে নয় নেতার সঙ্গেও একই ধরনের স্বচ্ছ ও আন্তরিক সম্পর্ক থাকবে। মুসলিম সমাজের সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, দয়া ও সহনশীলতার। যেমনিভাবে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তার সব বান্দার ক্ষেত্রে অনুগ্রহ করার নীতি গ্রহণ করেছে। তিনি পাপী ব্যক্তিদেরকেও ক্ষমা করার সুসংবাদ দিয়েছেন। কেউ তার পাপ কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। এ কারণে আল্লাহতায়ালা মানুষের ওপর সালাম ও দরুদ পাঠানোর জন্য রাসূলকে দায়িত্ব দিয়েছেন। যেমনিভাবে অন্য সব মানুষেরও দায়িত্ব হচ্ছে, রাসূলের ওপর দরুদ ও সালাম পাঠানো এবং রাসূলের প্রশংসা করা।
কোন দেশ ও সমাজের নেতা ও জনসাধারণের মধ্যে যদি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও আন্তরিক সম্পর্ক থাকে তাহলে সে সমাজ ও দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি অবশ্যম্ভাবী। সে সমাজে বিরাজ করে সুষ্ঠু ও সুন্দর সম্পর্ক। আল্লাহ যেমনিভাবে মানুষের প্রতি অফুরন্ত অনুগ্রহ করে থাকেন, মানুষেরও উচিত পরস্পরের বিষয়ে সেরকম অনুগ্রহশীল হওয়া। আল্লাহতায়ালা পাপাচারীদেরকে বিতাড়িত ও শাস্তির সম্মুখীন না করে তওবা ও ভালো মানুষ হওয়ার সুযোগ দেন। অবশ্য পাপেরও ধরণ রয়েছে। যেসব পাপী ব্যক্তি অজ্ঞতা ও সাধারণ লোভ-লালসার কারণে পাপ করে পরে আল্লাহর কাছে তওবা করে। আল্লাহ সহজেই তাদের তওবা কবুল করেন। কিন্তু যারা জেনেশুনে ইচ্ছাকৃতভাবে সব সময় পাপ করে যায় এবং অন্যদেরকেও উৎসাহিত করে তাদের পাপ ক্ষমারযোগ্য নয়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. অতীত ভুল সংশোধন করে তওবা করা হলে তাতে আল্লাহ বেশি খুশি হন এবং ওই তওবা কবুল করেন।
দুই. আল্লাহর সব মানুষকেই অনুগ্রহ করে থাকেন এবং কিন্তু আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ পেতে হলে মানুষকে পাপাচার থেকে দূরে থাকতে হবে ও তওবা করতে হবে।
সূরা আন’আমের ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ إِنِّي نُهِيتُ أَنْ أَعْبُدَ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ قُلْ لَا أَتَّبِعُ أَهْوَاءَكُمْ قَدْ ضَلَلْتُ إِذًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُهْتَدِينَ
"বলুন (হে মুহাম্মদ সা.)! তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া যাদেরকে ডাকো তাদের ইবাদত করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। বলুন, আমি তোমাদের খেয়াল-খুশির অনুসরন করি না;তাহলে আমি বিপথগামী হয়ে যাবো এবং হেদায়েতপ্রাপ্তদের অর্ন্তভূক্ত থাকবো না।" (৬:৫৬)
মুশরিকরা একত্ববাদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে রাসূল (সা.)কে মূর্তিপুজা করার জন্য আহ্বান জানাতো। তারা বলতো, কুরাইশ বংশের বিশিষ্টজনেরা যে পথে চলেছেন, আপনি সে পথে ফিরে আসুন এবং একত্ববাদের পথ পরিহার করুন। এ আয়াতে রাসূল (সা.) কে এ ঘোষণা দিতে বলা হয়েছে যে, তিনি কখনোই মুশরিকদের পথ অনুসরণ করবেন না এবং বিভ্রান্তদের মাধ্যমে প্রভাবিত হবেন না। রাসূল (সা.) কখনোই পুজা করবেন না, কারণ এর অর্থ হলো সঠিক পথ থেকে দূরে সরা এবং ভ্রান্তিতে ডুবে যাওয়া। পবিত্র কুরআন এই আয়াতে মূর্তিপুজাকে এক ধরনের খেয়ালিপনা হিসেবে ঘোষণা করেছে। কারণ মূর্তিপুজা করার পেছনে কোনো যুক্তি নেই এবং তা সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটা একেবারেই অর্থহীন যে, মানুষ নিজেই কোনো মূর্তি তৈরি করে সেটার প্রার্থণা ও পুজা করবে। জড় পদার্থ দিয়ে তৈরি কোনো বস্তুর কাছে নিজেকে সমর্পন করা মানুষের মর্যাদার জন্য অবমাননাকর। কারণ কোনো জড় বস্তুর সম্মান মানুষের চেয়ে বেশি হতে পারে না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. সব ধরনের অযৌক্তিক দাবিকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং যারা অযৌক্তিক দাবি করে, প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে, যাতে সমঝোতার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়।
দুই.বিধর্মীদেরকে ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করার স্বার্থেও কোনো অযৌক্তিক দাবি মেনে নেয়া যাবে না।