সূরা আন'আম; আয়াত ৩৭-৩৯
সূরা আন'আমের ৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَقَالُوا لَوْلَا نُزِّلَ عَلَيْهِ آَيَةٌ مِنْ رَبِّهِ قُلْ إِنَّ اللَّهَ قَادِرٌ عَلَى أَنْ يُنَزِّلَ آَيَةً وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
"(মুশরিকরা) বলে : তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তার ওপর কোন নিদর্শন (বা অলৌকিক ঘটনা) অবতীর্ণ হয়নি কেন? (হে রাসূল আপনি তাদের) বলে দিন : আল্লাহ নিদর্শন নাযিল করতে পূর্ণ সক্ষম; কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না।" (৬:৩৭)
ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, কুরাইশ বংশের মুশরিক নেতারা পবিত্র কুরআনের ভাষার কাছে হার মানতে বাধ্য হওয়ার পর রাসূলুল্লাহকে উদ্দেশ করে বললো : কুরআন তো কোন মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারছে না। তোমার কথা যদি সত্যি হয় তবে হযরত মুসা ও হযরত ঈসার মতো কোন মুজেযা নিয়ে এসো যা দেখে আমরা তোমার ধর্ম গ্রহণ করতে পারি।
কুরাইশ নেতাদের বক্তব্যে এ কথা পরিস্কার যে, তারা আসলে সত্যের পূজারি ছিল না। বরং আল্লাহ'র রাসূলকে ধোঁকা দেয়া এবং কুরআনের বাণী গ্রহণ না করার অজুহাত হিসেবে তারা এসব কথা বলতো। বিশ্বনবী যদি অতীত নবী-রাসূলদের মতো কোন অলৌকিক ঘটনা দেখাতেন, তবে তারা নতুন কোন অজুহাতে সত্য প্রত্যাখ্যান করতো। এমনকি অতীত নবীদের উম্মতের মতো এসব অলৌকিক ঘটনাকে যাদুমন্ত্র বলে প্রত্যাখ্যান এবং আল্লাহর রাসূলকে যাদুকর হিসেবে অভিহিত করতো। সত্য গ্রহণের ক্ষেত্রে দু'ধরনের মানুষ রয়েছে। একদল সত্যের বাণী শোনার সঙ্গে সঙ্গে গাফিলতির ঘুম থেকে জেগে উঠে সঠিক পথে ফিরে আসে। কিন্তু অপর দল ঘুমের ভান করে সত্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। তাদেরকে আল্লাহ'র পথে আনার জন্য যত চেষ্টাই করা হোক না কেন তারা সত্য গ্রহণ করবে না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :
এক. একজন নবীর নবুওয়াতের বিষয়টি সর্বসাধারণের সামনে প্রমাণ করার একটি মাধ্যম হচ্ছে মুজিযা। গোঁড়া ব্যক্তিদের অপূরণীয় চাহিদা মেটানোর কোন হাতিয়ার নয়।
দুই. মহান আল্লাহ'র পক্ষে যে কোন কাজ করা সম্ভব। কিন্তু তিনি মহাজ্ঞানী হওয়ার কারণে অবিবেচনাসুলভ কোন কাজ করেন না। একগুঁয়ে মানুষকে মুজিযা দেখিয়ে সত্যের পথে আনা সম্ভব নয়।
সূরা আন'আমের ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا طَائِرٍ يَطِيرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلَّا أُمَمٌ أَمْثَالُكُمْ مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ يُحْشَرُونَ
"আর যত প্রকার প্রাণী পৃথিবীতে বিচরণ করে এবং যত প্রকার পাখী ডানার সাহায্যে উড়ে বেড়ায় তারা সবাই তোমাদের মতই উম্মতেরই অংশ। আমি (আমার কিতাব বা কুরআনে) কোন কিছুই লিখতে ছাড়িনি। অতঃপর সবাই স্বীয় প্রতিপালকের কাছে সমবেত হবে।" (৬:৩৮)
এ আয়াতে মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, তারা যেন না ভাবে মানুষ ছাড়া অন্য সৃষ্টিগুলোর অনুভূতি শক্তি নেই; বরং, সব ধরনের প্রাণী- সেটি ভূপৃষ্ঠের প্রাণী হোক কিংবা আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখী- তাদের সবারই মানুষের মতো অনুভূতি ও জ্ঞান রয়েছে। পবিত্র কুরআনে যেমনটি হযরত সোলাইমান (আঃ)'র যুগে পিঁপড়া ও হুদহুদ পাখীর সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের কথা উল্লেখ রয়েছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে মানুষের সমান জ্ঞান-বুদ্ধি পশু-পাখীকে দেয়া হয়নি। মানুষের মধ্যেও যেমন সবার জ্ঞান একরকম নয়। এক বছর বয়সী একটি শিশুর জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। কথ্য ভাষায় আমরা বলি যে, এ ধরনের বাচ্চার কোন বিচার-বুদ্ধিই নেই।
আয়াতের পরের অংশে পশু-পাখীর পরকালের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন তারাও আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনায় বলা হয়েছে, পশু-পাখীও নিজেদের মধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবিচার করে এবং এজন্য পরকালে তাদের কাছ থেকে হিসাব নেয়া হবে। তবে পশু-পাখীর জ্ঞান-বুদ্ধি এত কম যে, তাদের জন্য মানুষের মতো কোন বাধ্যতামূলক কর্তব্য নির্ধারণ করা হয়নি। বরং, এ আয়াতে বলা হয়েছে, তাদেরকে নিজ বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ীই জবাবদিহী করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক/দুই বছরের একটি শিশু যদি কখনো কাউকে হত্যা করে বসে, তবে পৃথিবীর সব দেশের আইনেই তাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শাস্তি পেতে হয়। তবে সে শাস্তি পূর্ণ বয়স্ক খুনির সমান নয়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
এক. সামাজিক জীবন শুধুমাত্র মানুষের জন্য নির্ধারিত নয়, বরং পশু-পাখীও সমাজের অন্তর্ভূক্ত।
দুই. পশু-পাখীর সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা যাবে না। কারণ, তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে।
তিন. মহান আল্লাহ থেকে সৃষ্টির শুরু এবং একদিন তারই কাছে সবাইকে ফিরে যেতে হবে। এটি আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার একটি সামান্য নিদর্শন।
সূরা আন'আমের ৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا صُمٌّ وَبُكْمٌ فِي الظُّلُمَاتِ مَنْ يَشَأِ اللَّهُ يُضْلِلْهُ وَمَنْ يَشَأْ يَجْعَلْهُ عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
"যারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা বলে, তারা অন্ধকারের মধ্যে মূক ও বধির। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।" (৬:৩৯)
এ আয়াতে বলা হচ্ছে, যারা গোঁয়ার ও একরোখা স্বভাবের তারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী দেখতে ও শুনতে পায় না। এখানে আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনার কারণ হিসেবে গোঁয়ার্তুমির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বার্থপরতা তাদেরকে এত নীচে নামিয়ে দিয়েছে যে, তারা সত্য উপলব্ধি করতে পারে না। আয়াতের পরের অংশে বলা হচ্ছে, সঠিক পথ প্রদর্শন এবং পথভ্রষ্ট করার মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। তবে এখানে এ কথাটি উল্লেখ করা দরকার যে, সব মানুষের কাছে আল্লাহ নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া, আল্লাহ মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন যার মাধ্যমে সে তার বাণী উপলব্ধি এবং সঠিক পথে চলতে পারে। যে ব্যক্তি একবার সত্য গ্রহণ করে না, তার জন্য পরবর্তীতে সঠিক পথে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। আল্লাহর অবাধ্যতাকে যারা অভ্যাসে পরিণত করে, আল্লাহ তাদেরকে সঠিক পথ দেখান না।
অন্য কথায় খারাপ কাজ করার পর তার ওপর অটল থাকলে মানুষের পক্ষে সঠিক পথে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। অপরদিকে সৎকাজের অভ্যাস মানুষকে সরল ও সঠিক পথে পরিচালিত হতে সাহায্য করে। এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :
এক. অবাধ্যতা ও স্বেচ্ছাচারিতা হচ্ছে অন্ধকার ও জুলুমের সমতূল্য। এগুলো করার মাধ্যমে মানুষ হিদায়াত থেকে বঞ্চিত হয়।
দুই. পৃথিবীতে আল্লাহর বাণী অস্বীকারকারীর শাস্তি হচ্ছে পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়া। আল্লাহ নিজেও তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করেন না।