সূরা আন'আম; আয়াত ১-৩
পবিত্র মক্কায় নাজেল হওয়া সূরা আন'আমের আয়াত সংখ্যা ১৬৫। শির্ক বা অংশীবাদিতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও তাওহীদ বা একত্ববাদের দিকে আহ্বান এই সূরার মূল বিষয়বস্তু। সূরা আন’আমের বেশিরভাগ আয়াতে মূর্তিপূজারী ও মুশরিকদের নানা কুসংস্কার এবং ভুল ধারণা তুলে ধরা হয়েছে। কারণ, তারা এ ধরনের অলীক ধারণার বশে কোনো কোনো পশুকে নিজেদের জন্য হারাম করত। এসব পশুর গোশত তারা খেত না, এমনকি ওই পশুগুলোর ওপর তারা সওয়ারও হত না। চতুস্পদ জন্তু বা পশুদের সম্পর্কে মহান আল্লাহর বক্তব্য এসেছে বলেই এই সূরার নাম হয়েছে আন’আম।
সূরা আন’আমের প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ
“সব প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা একমাত্র আল্লাহরই জন্য যিনি নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং (এ দুইয়ের মধ্যে) অন্ধকার ও আলোর উদ্ভব করেছেন। তবুও কাফেররা নিজ পরওয়ারদেগার বা পালনকর্তার সঙ্গে (অন্য অনেক জীবিত বা জড় বস্তুকে) সমতুল্য স্থির করে।”(৬:১)
এ আয়াতে মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, তিনিই হচ্ছেন আল্লাহ যিনি সৃষ্টি করেছেন সবগুলো আকাশ ও জমিন, আর তোমরা যাদের পূজা বা উপাসনা করছ তাদের কি কোনো কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা রয়েছে? তিনিই সূর্যসহ অন্য অনেক নক্ষত্র সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টিকূলের জন্য আলো ও উষ্ণতার যোগান দিতে। পৃথিবী ঘুরছে বলে কখনও এর এক পিঠে থাকে আলো ও অন্য পিঠে থাকে অন্ধকার তথা রাত ও দিন। রাতে মানুষ ও সৃষ্টিকূল সুযোগ পায় বিশ্রাম নেয়ার। তোমাদের উপাস্যগুলোর এরকম ক্ষমতা আছে? নিশ্চয়ই এ রকম ক্ষমতা আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই নেই। তাই তোমরা একমাত্র আল্লাহরই এবাদত কর এবং তাঁরই কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর যিনি এইসব বিশাল-ব্যবস্থা ও সৃষ্টি-জগত মানুষের জন্য তৈরি করেছেন।
এ আয়াত জড়বাদীদের ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করছে যারা মনে করে সৃষ্টির উৎসমূল তথা সূচনাকারী বা স্রস্টা প্রভু বলে কারো অস্তিত্ব নেই। একইসাথে এ আয়াত আলো ও অন্ধকারের পৃথক দুই স্রস্টা বা দুই খোদায় বিশ্বাসী জরাথ্রুস্তদের ধারণা এবং আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার থাকার ধারণায় বিশ্বাসী মুশরিকদের ধারণাকেও নাকচ করে দিচ্ছে।
উল্লেখ্য পুরো কুরআনেই নূর শব্দটি সব সময়ই এক বচনে ব্যবহৃত হয়েছে, অন্যদিকে জুলমাত বা অন্ধকার শব্দটি বহুবচন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ, সত্যের বা আলোর পথ একটির বেশি নয়। কিন্তু মিথ্যার পথ বা ভুল পথ অনেক ও বিচিত্রময়। অন্য কথায় নূর বা আলো ঐক্যের প্রতীক এবং জুলমাত বা অন্ধকার বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্যের প্রতীক।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. আল্লাহই সব সৃষ্টির স্রস্টা ও সেসবের বিকাশ এবং পূর্ণতারও ব্যবস্থা রয়েছে তাঁরই হাতে। সৃষ্টিকূলকে সৃষ্টি করা বা অস্তিত্ব দান ও তাদের টিকিয়ে রাখার ক্ষমতাও আল্লাহরই হাতে রয়েছে।
দুই. শির্ক করার অর্থ আল্লাহর ক্ষমতাকে অস্বীকার করা। অর্থাৎ আল্লাহ যে একাই বিশ্বজগত পরিচালনা করছেন তা অস্বীকার করার শামিল। তাই শির্ক ও কুফরি সমার্থক।
সূরা আন’আমের দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে-
هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ طِينٍ ثُمَّ قَضَى أَجَلًا وَأَجَلٌ مُسَمًّى عِنْدَهُ ثُمَّ أَنْتُمْ تَمْتَرُونَ
“তিনিই তোমাদেরকে মাটি হতে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর (প্রত্যেক সৃষ্টির জন্য) নির্দিষ্টকাল বা আয়ু নির্ধারণ করেছেন। আর অন্য এক নির্দিষ্টকাল রয়েছে আল্লাহর কাছে। তবুও তোমরা সন্দেহ কর।” (৬:২)
আগের আয়াতে মহান আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে বহু আকাশ ও জমিন সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। এ আয়াতে নিষ্প্রাণ ও নির্জীব মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টির ক্ষমতার দিকে ইশারা করে বলা হয়েছে, তোমাদের জীবন ও মৃত্যু তো আল্লাহরই হাতে। তাই তোমরা কিভাবে আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস করছ? এ আয়াত থেকে মানুষের দুই ধরনের জীবনকাল বা আয়ুর কথা জানা যায়। একটি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট আয়ু বা জীবনের মেয়াদ যা কেবল আল্লাহই জানেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে পরিবর্তনযোগ্য আয়ু যা ব্যক্তির কর্ম ও পারিপার্শ্বিক আচরণের ওপর নির্ভর করে। দ্বিতীয় ধরনের আয়ুকে তেলের বাতির সাথে তুলনা করা যায়। যখন তেল ফুরিয়ে যায় তখন বাতিও নিভে যায়। অর্থাৎ যতক্ষণ তেল আছে ততক্ষণ বাতি জ্বলবে বলে মনে করা যায়, কিন্তু কখনও কখনও প্রবল বাতাস তেল থাকা সত্ত্বেও বাতি বা চেরাগ নিভিয়ে দিতে পারে। একইভাবে মানুষও অসুস্থতা, বদ অভ্যাস ও দূর্ঘটনার কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই বা অকালে মারা যায়।
ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী পানাহারের ক্ষেত্রে সংযম ও স্বাস্থ্য-বিধি মেনে চলার বিষয় ছাড়াও কিছু কিছু সৎ কাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা মানুষের হায়াত বা আয়ুকে দীর্ঘায়িত করে। যেমন, বেশি বেশি সদকা দেয়া ও দান-খয়রাত করা, রক্তের সম্পর্ক রক্ষা করে চলা বা আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাত করা ইত্যাদি।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. আমরা নিজ ইচ্ছায় জন্ম গ্রহণ করিনি বলে নিজ ইচ্ছায় ইহলোকও ত্যাগ করতে পারি না। আমাদের জীবনের শুরু ও শেষ আল্লাহরই হাতে রয়েছে। তাই স্রস্টা ও পরকালকে অস্বীকার করার কি কোনো যুক্তি রয়েছে?
দুই. আমরা যে বিশ্বে বসবাস করছি তাতে রয়েছে শৃঙ্খলা ও নিয়মের রাজত্ব বা সুনির্দিষ্ট ও স্থায়ী বিধান। প্রত্যেক জীব কত দিন বা কত সময় বাঁচবে তা নির্ধারিত রয়েছে। আর মহান আল্লাহই এসব বিধান ও ব্যবস্থার স্রস্টা।
সূরা আন’আমের তৃতীয় আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَهُوَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَفِي الْأَرْضِ يَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَجَهْرَكُمْ وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُونَ
“তিনিই আল্লাহ সব আকাশ ও সব জমিনে (তথা অস্তিত্বের জগতে কেবল এক আল্লাহই সৃষ্টিকূলের একমাত্র স্রস্টা)। তিনি তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় জানেন এবং তোমরা যা কর (ও অর্জন কর) তাও অবগত।” (৬:৩)
আগের দুই আয়াতে সব আকাশ ও জমিন সৃষ্টির ক্ষমতাসহ মহান আল্লাহর কিছু ক্ষমতার কথা তুলে ধরার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে সব আকাশ ও জমিনে তথা গোটা অস্তিত্বের জগতে কেবল একজন আল্লাহরই কর্তৃত্ব রয়েছে এবং সৃষ্টি জগতের সব কিছু তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই যারা মনে করে সব কিছুর আলাদা আলাদা স্রস্টা বা খোদা রয়েছে তাদের ধারণা সঠিক নয়।
মানুষের গোপন ও প্রকাশ্য কাজসহ তাদের সব বিষয়ই যে আল্লাহ জানেন এ আয়াতে তাও বলা হয়েছে। এর অর্থ মানুষ যেন এটা মনে না করে যে তিনি কেবলই সৃষ্টিজগতের স্রস্টা এবং সৃষ্টির পর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন, বরং তিনি মানুষের সব অবস্থা জানেন ও দেখছেন।
এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকার:
এক. আমরা যদি এটা মনে রাখি ও বিশ্বাস করি আল্লাহ সব কিছু ও সবার সব অবস্থা সম্পর্কে জানেন, তাহলে আমরা আমাদের কাজের ব্যাপারে সতর্ক থাকব। এই বিশ্বাস আমাদেরকে মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখবে এবং সৎ কাজ করতে উৎসাহ যোগাবে।
দুই.আকাশ ও জমিনে যা কিছু আছে এবং যা কিছু প্রকাশ্য ও গোপন তা আমাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মনে হয়, কিন্তু মহান আল্লাহর কাছে গোপন ও প্রকাশ্যের কোনো পার্থক্য নেই, নেই দূরের বা কাছের কিংবা দৃশ্য ও অদৃশ্যের পার্থক্য।