সূরা আন'আম;(১০ম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন'আম;(১০ম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 0:47:10 3-10-1403

সূরা আন'আম; আয়াত ৪০-৪৫

সূরা আন’আমের ৪০ ও ৪১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ أَرَأَيْتَكُمْ إِنْ أَتَاكُمْ عَذَابُ اللَّهِ أَوْ أَتَتْكُمُ السَّاعَةُ أَغَيْرَ اللَّهِ تَدْعُونَ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (40) بَلْ إِيَّاهُ تَدْعُونَ فَيَكْشِفُ مَا تَدْعُونَ إِلَيْهِ إِنْ شَاءَ وَتَنْسَوْنَ مَا تُشْرِكُونَ

"বলুন,‘তোমরা ভেবে দেখ যে,যদি আল্লাহর শাস্তি তোমাদের উপর আপতিত হয় অথবা তোমাদের কাছে কিয়ামত উপস্থিত হয়,তোমরা কি (তখন) আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকবে,(এ প্রশ্নের উত্তর দাও!) যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।" (৬:৪০)

"বরং তোমরা শুধু তাকেই ডাকবে; অতঃপর: যে বিপদের জন্য তাকে ডাকবে, তিনি ইচ্ছে করলে তা দূরও করে দেন। যাদেরকে অংশীদার করছো,তখন তাদেরকে ভুলে যাবে।" (৬:৪১)

এর আগের আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস, ধর্মহীনতা এবং সত্যকে অস্বীকারের মূলে রয়েছে হিংসা, জেদ ও গোঁড়ামি। আল্লাহকে অস্বীকার করার মতো কোনো যুক্তি কাফিরদের কাছে নেই। কিন্তু এরপরও তারা মুমিনদের যুক্তি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে সচেতন ও সজাগ করে তোলার ওপর এ আয়াতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ আয়াতে কাফির ও মুশরিকদের উদ্দেশে বলা হচ্ছে, তোমরাতো আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করছো এবং তাদেরকে অনেক ক্ষমতাবান ও শক্তিশালী ভাবছো, কিন্তু যদি ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে তাহলে তোমরা কার কাছে আশ্রয় নেবে?

তোমরা যাদের আনুগত্য করছো, সে সময় কি তাদের কাছেই আশ্রয় নেবে। আসলেই কী তারা এ ধরনের পরিস্থিতিতে তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে? তারা কি তোমাদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে? কখনো কী এটা ভেবে দেখেছ যে, যদি বিচার দিবস সত্য হয় তাহলে সেদিন তোমরা কার কাছে আশ্রয় নেবে? এ আয়াতে এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে বলা হচ্ছে, এটাই সত্য যে-এ ধরনের মুহুর্তে তোমরা কেবল আল্লাহকেই ডাকো এবং অন্য সবাইকে‌ই ভুলে যাও। বাস্তবতা হলো আল্লাহই কেবল মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারেন। অবশ্য তিনি তা চাইবেন কিনা, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাও আল্লাহরই হাতে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. জন্মগতভাবে আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ববাদকে মেনে নেয়ার প্রবণতা মানুষের মধ্যে থাকে। কাজেই মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই আল্লাহপ্রেমী। কিন্তু পার্থিব বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ ও ঝোঁক প্রবণতার কারণে মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যগুলো লোপ পায়। এ ছাড়া, অনেক সময় দুঃখ-কষ্ট মানুষকে উদাসীনতা ও ভ্রান্তির পথ থেকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনে।

দুই.আল্লাহ না চাইলে কেউই বিপদ ও সংকট থেকে মুক্তি পাবে না। পৃথিবীর সব কিছুরই আল্লাহর কাছে আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন হবে।

সূরা আন’আমের ৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَى أُمَمٍ مِنْ قَبْلِكَ فَأَخَذْنَاهُمْ بِالْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ لَعَلَّهُمْ يَتَضَرَّعُونَ

"আপনার আগেও তো আমি বহু জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি;এরপর তাদেরকে দারিদ্র-দুর্ভিক্ষ,দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন করেছি,যেন তারা বিনম্র-নত হয়।" (৬:৪২)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য নবী-রাসূল পাঠানোর পাশাপাশি মানুষকে দুঃখ-কষ্টেরও সম্মুখীন করেন, যাতে তারা ভুল পথ বাদ দিয়ে চূড়ান্ত কল্যাণের পথ বেছে নেয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কখনো কখনো চাপ ও কঠোরতার প্রয়োজন হয়। অনেক সময় মানুষ সমস্যায় পড়ে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারে এবং আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার বিষয়টি বুঝতে পারে।

দুই.আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি ও আহাজারি করার ফলে মানুষের মন নরম হয়। এতে সত্যকে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রও তৈরি হয়।

সূরা আন’আমের ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَلَوْلَا إِذْ جَاءَهُمْ بَأْسُنَا تَضَرَّعُوا وَلَكِنْ قَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

"যখন আমার আজাব তাদের উপর পৌঁছুল তখন কেন তারা বিনীত হলো না? বরং তাদের হৃদয়গুলো কঠিন হয়ে গেল। তারা যা (অবাধ্যতা) করে যাচ্ছিল শয়তান তা তাদের দৃষ্টিতে সুশোভিত করে দেখিয়েছিল।" (৬:৪৩)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে বলা হচ্ছে, কাফির ও মুশরিকরা দু'টি কারণে সজাগ ও সচেতন হয়নি এবং উপদেশ গ্রহণ করেনি। প্রথমত: তারা নিষ্ঠুর ও কঠোর হৃদয়ের মানুষে পরিণত হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে যে স্বচ্ছ মন ও হৃদয় দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন, তা ক্রমান্বয়ে ঘোলাটে ও অস্বচ্ছ হয়ে গেছে। পাপাচারে জড়িয়ে পড়ার কারণেই এমনটি হয়েছে। দ্বিতীয়ত: তাদের কাছে খারাপ ও মন্দ বিষয়গুলোও ভালো বলে মনে হয়। নিজেদের খারাপ কাজগুলোকেও তারা ভালো বলে মনে করে। শয়তানের ধোঁকায় পড়ার কারণে তারা অন্যায়কে সঠিক ও যথোপযুক্ত হিসেবে ধরে নেয়।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. গোঁড়া ও জেদি মানুষ কখনো কোনো সৎ উপদেশ গ্রহণ করে না। কারণ তারা নিজেরা যা বুঝে সেটাকেই সঠিক বলে ধরে নেয়। অন্য কিছু মেনে নেয়ারও ইচ্ছে তাদের নেই। মানুষ নিজে থেকে না চাইলে সত্যকে বুঝতে ও মানতে পারে না।

দুই. মানুষ জন্মগতভাবেই সৌন্দর্যপ্রিয়। আর শয়তান মানুষের এই স্বভাবকে অপব্যবহার করে এবং কুতসিত বিষয়কেও তার সামনে সুন্দর ও যৌক্তিক হিসেবে তুলে ধরে।

সূরা আন’আমের ৪৪ ও ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَلَمَّا نَسُوا مَا ذُكِّرُوا بِهِ فَتَحْنَا عَلَيْهِمْ أَبْوَابَ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى إِذَا فَرِحُوا بِمَا أُوتُوا أَخَذْنَاهُمْ بَغْتَةً فَإِذَا هُمْ مُبْلِسُونَ (44) فَقُطِعَ دَابِرُ الْقَوْمِ الَّذِينَ ظَلَمُوا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

"অতঃপর তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা ভুলে গেলো। তখন আমি তাদের জন্য সব কিছুর  দরজা খুলে দিলাম। তারা যখন ওই সব পেয়ে  অহংকারী হয়ে পড়লো তখন অকস্ম্যাৎ তাদেরকে পাকড়াও করলাম;ফলে সহসাই তারা গভীর দুঃসহ-হতাশাগ্রস্ত হলো।" (৬:৪৪)

"সুতরাং যারা জুলুম করেছিল তাদের মুলোচ্ছেদ করা হলো। আর সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি বিশ্বজাহানের প্রতিপালক।" (৬:৪৫)

মানুষ যাতে সৎ পথে চলে, সেজন্য আল্লাহতায়ালা মানুষের সামনে বিভিন্ন সুযোগ ও পন্থা হাজির করেন। এ জন্য তিনি নবী-রাসূলদের পাঠিয়েছেন। উপদেশ ও দিকনির্দেশনায় কাজ না হলে তিনি মানুষকে দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন করেন এবং তার বিবেককে জাগিয়ে তোলার সুযোগ দেন। দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পড়ে অনেকেই উদাসীনতার ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ভালোভাবে দাওয়াত দিয়ে বুঝিয়ে এবং এরপর শাস্তি দিয়েও যখন কাজ হয় না তখন আল্লাহ ওই ধরনের মানুষকে তার নিজের সিদ্ধান্ত ও ইচ্ছের ওপর ছেড়ে দেন। এ অবস্থায় তাকে পার্থিব সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ধারা অব্যাহত থাকে। কারণ আল্লাহর নীতি হচ্ছে, সব মানুষই পার্থিব সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করবে। তবে তা স্থায়ী নয়। যখনি এ ধরনের বিভ্রান্ত লোকের পাপ ও দূর্নীতি চরম মাত্রায় পৌঁছে যায়, তখন তাদের ওপর আল্লাহর কঠোর শাস্তি নেমে আসে এবং তাদেরকে ধ্বংস করা হয়।  রাসূল (সা.) বলেছেন, যদি দেখো যে পৃথিবীতে পাপীরা ভালো অবস্থায় রয়েছে,তাহলে হতাশ হবে না। কারণ এর মাধ্যমেই তাদের ধ্বংসের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. পৃথিবীর সুখ-সমৃদ্ধি মানুষের জন্য ভালো-মন্দ দুই ধরনের পরিণতিই বয়ে আনতে পারে। যদি কেউ ঈমান ও তাকওয়ার পথে থাকে তাহলে আল্লাহর নেয়ামতগুলো তার জন্য মঙ্গলজনক হবে। অন্যথায় ওই নেয়ামতগুলোই তার জন্য চরম পরিণতি বয়ে আনতে পারে। কাজেই পৃথিবীর সুখ ও সমৃদ্ধি কখনোই আল্লাহর সন্তুষ্টির নিদর্শন নয়। কখনো কখনো তা শাস্তির ক্ষেত্রও বটে।

দুই.পৃথিবীতে জুলুম-নির্যাতন এবং সুখ-সমৃদ্ধি, এর কোনোটিই স্থায়ী নয়। আর নির্যাতনকারীদের ধ্বংস অনিবার্য।