সূরা আন'আম; আয়াত ২৫-২৮
সূরা আন’আমের ২৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمِنْهُمْ مَنْ يَسْتَمِعُ إِلَيْكَ وَجَعَلْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ أَكِنَّةً أَنْ يَفْقَهُوهُ وَفِي آَذَانِهِمْ وَقْرًا وَإِنْ يَرَوْا كُلَّ آَيَةٍ لَا يُؤْمِنُوا بِهَا حَتَّى إِذَا جَاءُوكَ يُجَادِلُونَكَ يَقُولُ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَذَا إِلَّا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ
"(হে রাসূল!) মুশরিকদের মধ্যে কেউ কেউ আপনার দিকে কান পেতে রাখে, কিন্তু (তাদের অবাধ্যতা ও পাপের কারণে) আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ ফেলে রেখেছি,সুতরাং তারা তা উপলব্ধি করতে পারে না। তাদের কানে বোঝা ভরে দিয়েছি (যাতে শুনতে না পারে)। যদি তারা সব নিদর্শনও দেখতে পারে তবুও তারা ঈমান আনবে না। এমনকি যখন তারা আপনার কাছে উপস্থিত হয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তখন কাফিররা বলে,‘এতো পূর্ববর্তীদের উপকথা ব্যতীত আর কিছুই নয়।" (৬:২৫)
এ আয়াতে কিছু জেদি ও একগুঁয়ে লোকের মন-মানসিকতা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এসব ব্যক্তি এতটাই গোঁড়া যে,তারা তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের ব্যাপারে বিন্দু পরিমাণ চিন্তা করতেও প্রস্তুত নয়। তারা সত্যকে মেনে নেয়াতো দূরের কথা এ সংক্রান্ত কথা শুনতেও রাজি নয়। তারা তাদের ভ্রান্ত চিন্তা ও বিশ্বাসের বিষয়ে এতটাই অনড় যে, তারা ইসলামের শাশ্বত বাণীকে গ্রহণ না করে বরং উল্টো পবিত্র কুরআনের বিরুদ্ধে শত্রুতা করে। তারা দাবি করে, কুরআনের বক্তব্য কাল্পনিক ও পৌরাণিক গল্প ছাড়া আর কিছু নয়। এ আয়াতে সত্যকে চেনা ও বোঝার বিষয়টিকে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কিত করা হলেও মূলত: মানুষের কাজের বৈশিষ্ট্য তথা কুপ্রবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের প্রবণতা তাদের বিবেক-বুদ্ধির ওপর এতোটাই আধিপত্য বিস্তার করে যে, তাদের প্রকৃত অনুভূতি, বুদ্ধি ও শ্রবণ শক্তি লোপ পেয়ে যায়।
আল্লাহ তায়ালা মানুষের চিন্তা ও বিচার-বিশ্লেষণের ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও চকচকে আয়নার মতো করে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তারা সত্যকে যেমন আছে তেমনিভাবে উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু তাদের কুপ্রবৃত্তি, অসদাচরণ, বিপথগামিতা ও হতাশার মতো খারাপ গুণগুলো মানুষকে পাপাচার ও নোংরামির দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে সেই স্বচ্ছ আয়নায় ধূলার মোটা আস্তর পড়ে যায়। এ কারণে সেই স্বচ্ছ আয়না এমন রূপ ধারণ করে যে, তাতে সব কিছুই বাঁকা ও বিকৃত দেখা যায়। এ অবস্থায় পাপাচারি মানুষ সত্যকে মেনে নিতেতো পারেই না বরং ঝগড়া-বিবাদ ও বিশৃঙ্খলার আশ্রয় নেয়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. পবিত্র কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত ও শ্রবণ করার বিষয়টি কেবল তখনি গুরুত্বপূর্ণ যখন তা মানুষের মনে প্রভাব ফেলে। কারণ মুশরিকরাও রাসূলের মুখ থেকে কুরআনের আয়াত শুনতেন কিন্তু তারা সৎপথে ফিরে আসেনি।
দুই. পবিত্র কুরআন ও ইসলামের যুক্তির মোকাবেলা করার কোন মতো পাল্টা যুক্তি কাফেরদের কাছে নেই। একারণে তারা সংলাপের পথ বাদ দিয়ে অপবাদ, গালিগালাজ ও ঝগড়ার পথ বেছে নেয়।
সূরা আন’আমের ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَهُمْ يَنْهَوْنَ عَنْهُ وَيَنْأَوْنَ عَنْهُ وَإِنْ يُهْلِكُونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ
"তারা অন্যকেও তার (মুহাম্মদ সা. এর অনুসরণ) থেকে বিরত রাখে ও নিজেরাও তার থেকে দূরে থাকে এবং (এর মাধ্যমে) তারা নিজেরাই শুধু নিজেদের ধ্বংস করে, অথচ তারা তা উপলব্ধি করে না।" (৬:২৬)
আগের আয়াতের মতো এ আয়াতেও মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হচ্ছে। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, মুশরিক বা অংশীবাদীরা কেবল নিজেরাই রাসূল (সা.) থেকে দূরে থাকে তাই নয় বরং তারা অন্যদেরকেও রাসূল (সা.) থেকে দূরে রাখে এবং তাদেরকে রাসূল (সা.)এর বাণী ও কুরআনের আয়াত শুনতে বাধা দেয়। কিন্তু সত্যকে সব সময়ের জন্য আড়াল করে রাখা যায় না, তা একদিন না একদিন প্রকাশিত হয়ইনি এবং মিথ্যার ওপর সত্যের জয় নিশ্চিত। এ কারণে অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে বিভ্রান্তকারীরা ব্যর্থ হয় এবং তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বিভ্রান্ত ব্যক্তিরা সত্য ও বাস্তবতাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
এক. আমাদেরকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যে, যারা চিন্তা ও বাক স্বাধীনতার নামে নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতার পথ বেছে নেয়, তারা সত্যকামীদেরকে স্বাধীনভাবে কথা বলতে দেয় না, যাতে সত্য অনুসন্ধানীরা তা শুনে সঠিক পথ পেতে পারে।
দুই.অবিশ্বাসী ও অংশীবাদী নেতারা অন্যদের ধ্বংস নিশ্চিত করতে যেয়ে নিজেদেরকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। হয়তো তারা এ বিষয়টি বুঝতে পারে না।
সূরা আন’আমের ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَوْ تَرَى إِذْ وُقِفُوا عَلَى النَّارِ فَقَالُوا يَا لَيْتَنَا نُرَدُّ وَلَا نُكَذِّبَ بِآَيَاتِ رَبِّنَا وَنَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
"যদি আপনি দেখতেন, যখন (আখিরাতে) তাদেরকে দোজখের আগুনের পাশে দাঁড় করানো হবে এবং তারা বলবে, ‘হায়! যদি আমাদের (পুনরায় দুনিয়াতে) প্রত্যাবর্তন ঘটতো তবে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহকে (আর) অস্বীকার করতাম না এবং আমরা মুমিনদের অর্ন্তভূক্ত হতাম।" (৬:২৭)
এর আগের আয়াতে, সৎ পথের দিকে নবী-রাসূলদের আহ্বানের মোকাবেলায় এক দল মানুষের অন্যায় আচরণ ও বক্তব্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এ আয়াতে কিয়ামতের দিন তাদের লজ্জাজনক পরিণতির কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে, তারা তাদের কাজের পরিণতি ভোগ করবে না, এমনটি ভাবার সুযোগ নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে। এর ফলে তারা ভ্রান্তির ঘুম থেকে জেগে ওঠবে। কিন্তু তখন আর পৃথিবীতে ফিরে আসে ভুল সংশোধনের সুযোগ থাকবে না। মন্দ লোকেরা কিয়ামতের আগে মৃত্যুর সময় ও কবরে প্রবেশের সময়ও একই কামনা করে । কিন্তু তাতে কোন কাজ হয় না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক.জীবদ্দশাতেই আমাদেরকে অতীত ভুলের সংশোধন করতে হবে এবং সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। ভবিষ্যতের কাজের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। মৃত্যুর পর পৃথিবীতে ফিরে আসার এবং অতীতের ভুল সংশোধনের কোনো সুযোগ থাকবে না।
দুই.কিয়ামত বা পুণরুত্থান দিবস হচ্ছে অনুতাপ ও অনুশোচনার দিবস। যেসব কাজ করা উচিত ছিল,তা করতে না পারা এবং যেসব কাজ করা উচিত হয়নি,তা করার কারণে মানুষ অনুশোচনা করবে।
সূরা আন’আমের ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
بَلْ بَدَا لَهُمْ مَا كَانُوا يُخْفُونَ مِنْ قَبْلُ وَلَوْ رُدُّوا لَعَادُوا لِمَا نُهُوا عَنْهُ وَإِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ
"বরং পূর্বে যা তারা গোপণ করতো তা এখন (কিয়ামতে) তাদের কাছে প্রকাশিত হয়েছে। আর তারা (দুনিয়াতে) প্রত্যাবর্তিত হলেও যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল পুনরায় তারা তা-ই করবে, আর তারা তো নিশ্চিত মিথ্যাবাদী।" (৬:২৮)
এ আয়াতে মানুষের আচরণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মানুষ কখনো কখনো নিজের সঙ্গেই প্রতারণা করে। সে তার নিজের বিবেককেও ফাঁকি দেয় এবং খারাপ কাজে চালিয়ে যায়। অন্যায় কাজ করছে এটা বুঝতে পেরেও সে বিবেকের পীড়া থেকে মুক্ত থাকতে অবুঝের ভান করে এবং বিষয়টিকে ভুলে থাকার চেষ্টা চালায়। পবিত্র কুরআনে বহু বার বলা হয়েছে, মন্দ লোকদের অন্যায় কাজের বিষয়টি এবং তাদের নোংরামি কিয়ামতের দিন প্রকাশ হয়ে পড়বে।
এ আয়াতে বলা হচ্ছে, তাদের অপরাধ ও নোংরামি প্রকাশ হয়ে পড়ার পর ভুল সংশোধনের জন্য পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করতে চাইবে। কিন্তু তাদের এ সচেতনতা বা অনুশোচনা ক্ষণিকের জন্য। তাদেরকে যদি আবারও পৃথিবীতে ফিরে আসার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলেও তারা তাদের খারাপ স্বভাবের কারণে আবারও ঘৃণ্য ও অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়বে।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. যাদের সংশোধিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,কেবল তাদেরকেই সুযোগ দেয়া যায়। যেমনিভাবে পৃথিবীতে পাপাচারীদেরকে তওবা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু যাদের মনে-প্রাণে অপবিত্রতা ও নোংরামি বদ্ধমূল হয়ে যায়,তারা স্বচক্ষে নরকের যন্ত্রণা দেখার পরও সংশোধন হবে না।
দুই. পৃথিবীতে আমরা যা কিছু গোপন করে রাখি, তার সব কিছুই কিয়ামতের দিন প্রকাশ হয়ে পড়বে। কাজেই গোপনে বা প্রকাশ্যে কোনোভাবেই অন্যায় করা যাবে না।