সূরা আন'আম; আয়াত ১০-১৪
সূরা আন'আমের ১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَلَقَدِ اسْتُهْزِئَ بِرُسُلٍ مِنْ قَبْلِكَ فَحَاقَ بِالَّذِينَ سَخِرُوا مِنْهُمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ
"হে রাসূল! আপনার সঙ্গে মুশরিকদের অশোভন আচরণে উদ্বিগ্ন হবেন না, কারণ, কাফেররা আপনার পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদেরও উপহাসের পাত্র বানিয়েছিল। কিন্তু তারা যে বিষয়ে উপহাস করেছিল শেষ পর্যন্ত তাই তাদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল (এবং তারা আল্লাহ'র মহাক্রোধের শিকার হয়েছিল)।" (৬:১০)
আগের পর্বে বলা হয়েছিল, যে সব ব্যক্তি নিছক গোঁড়ামির কারণে সত্য গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল- তারা ঈমান গ্রহণ না করার জন্য নানা অজুহাত তুলে ধরে বলতো : সৃষ্টিকর্তা কেন পয়গম্বরের সঙ্গে একজন ফেরেশতাও পাঠান না? ফেরেশতা পাঠালে তারা নবুওয়াতের পক্ষে সাক্ষ্য দিত এবং আমরাও তাদেরকে সরাসরি দেখতে পেয়ে ঈমানকে মজবুত করতে পারতাম! সূরা আন'আমের এ আয়াতে কাফেরদের এ ধরনের অযৌক্তিক আবদারের জবাব দিতে গিয়ে বলা হয়েছে : হে রাসূল, ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় সব সময়ই কিছু মানুষ আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো ধর্ম গ্রহণ না করে তা নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করেছে। কাজেই আপনি এ ব্যাপারে ধৈর্য ধরুন এবং তাদের বিষয়টি আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিন। যেদিন তারা দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর কঠিন আজাবের সম্মুখীন হবে সেদিন বুঝবে, আজ তারা যা নিয়ে উপহাস করছে তা কোন অমূলক বিষয় ছিল না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :
এক- কাফেরদের বক্তব্যে কোন যুক্তি নেই। আল্লাহর বাণী এবং ঈমানদার ব্যক্তিদের অবজ্ঞা করাই তাদের কাজ।
দুই- অন্যদের উপহাস বা অবজ্ঞা করা থেকে আমাদের বিরত থাকা উচিত। কারণ, কাফের ও মুশরিকরা এ জঘন্য পন্থা অবলম্বন করতো।
সূরা আন'আমের ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ ثُمَّ انْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِينَ
"(হে রাসূল, আপনি তাদের) বলে দিন : পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াও এবং দেখ যারা আল্লাহ'র আয়াতকে অস্বীকার করেছিল, তাদের কি পরিণতি হয়েছে?" (৬:১১)
যারা অবহেলার চরম সীমায় পৌঁছে যাওয়ার কারণে সত্য উপলব্ধি করতে পারেনি, তাদেরকে জাগিয়ে তোলার জন্য এ আয়াতে পবিত্র কুরআন বলছে, তারা যেন অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করে কাফের ও মুশরিকদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়। অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস দেখার অন্যতম উপায় হচ্ছে, তাদের রেখে যাওয়া ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোতে ভ্রমণ করা। দেশে দেশে এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা আজও পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। অবশ্য শুধুমাত্র এসব নিদর্শন দেখাই যথেষ্ট নয় বরং এসব নিদর্শন যারা তৈরি করেছে তাদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়া জরুরী।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :
এক. ইসলামে দেশ ভ্রমণ এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন ঘুরে দেখার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অতীত জাতিগুলোর পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী।
দুই. কোন কিছু দেখার ক্ষেত্রে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, মানুষকে কোন কিছু দেখার পর তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
সূরা আন'আমের ১২ ও ১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
قُلْ لِمَنْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ قُلْ لِلَّهِ كَتَبَ عَلَى نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ لَيَجْمَعَنَّكُمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَا رَيْبَ فِيهِ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ (12) وَلَهُ مَا سَكَنَ فِي اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (13)
"(হে রাসূল আপনি তাদের) জিজ্ঞেস করুন : আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তার মালিকানা কার? বলুন, এর মালিকানা আল্লাহর। তিনি অনুকম্পা প্রদর্শনকে নিজ দায়িত্বরূপে লিপিবদ্ধ করে নিয়েছেন। তিনি অবশ্যই কিয়ামতের দিন তোমাদের সবাইকে একত্রিত করবেন। কেয়ামতের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। যারা তাদের কু-প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারাই ঈমান আনেনি।" (৬:১২)
"যা কিছু রাত ও দিনে স্থিতি লাভ করে, তা তাঁরই। তিনিই মহাজ্ঞানী শ্রোতা।" (৬:১৩)
আগের আয়াতের সূত্র ধরে এ আয়াতে বলা হচ্ছে : দৃশ্যমান সব বস্তুর মালিক আল্লাহ। তিনি তার অশেষ করুণায় আসমান ও জমিনসহ এর ভেতরে যা কিছু আছে সব সৃষ্টি করেছেন। তিনি তোমাদেরকে বিনা কারণে পৃথিবীতে ছেড়ে দেননি এবং মৃত্যু তোমাদের জীবনের শেষ নয়। বরং, তোমাদের সবাইকে কেয়ামতের দিন একত্রিত করা হবে। এরপর তোমাদের স্থান হবে জাহান্নাম অথবা জান্নাতে।
এ আয়াতের শেষাংশে বলা হচ্ছে, যারা তাদের পবিত্র সত্ত্বাকে অস্বীকার করে নিজেদের ক্ষতির কারণ হয়েছে, তারা সত্য গ্রহণে প্রস্তুত নয় এবং তারা কখনো ঈমান আনবে না।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে :
এক. কেয়ামতের দিন মানুষের পুনরুত্থান যে কেবল ন্যায়বিচার করার জন্য প্রয়োজন তাই নয় সেইসঙ্গে দয়াময় আল্লাহ মৃত্যুর পর মানুষকে চিরস্থায়ী একটি জগতে নিয়ে যাবেন তার রহমতের নিদর্শন দেখানোর জন্য।
দুই. আমরা আল্লাহকে দেখতে এবং তার কথা শুনতে না পেলেও তিনি আমাদের উদ্দেশে কথা বলেছেন। তিনি আমাদের কথা শোনেন এবং আমাদের প্রতিটি কাজ দেখতে পান।
সূরা আন'আমের ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
قُلْ أَغَيْرَ اللَّهِ أَتَّخِذُ وَلِيًّا فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ يُطْعِمُ وَلَا يُطْعَمُ قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ أَوَّلَ مَنْ أَسْلَمَ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
"(হে রাসূল আপনি তাদের) বলে দিন : আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করতে পারি যিনি আসমান ও জমিনের স্রস্টা এবং যিনি সবাইকে আহার দান করেন ও কারো কাছ থেকে আহার গ্রহণ করেন না? আপনি বলে দিন : আমি সবার আগে মুসলমান হওয়ার নির্দেশ পেয়েছি। (এবং আল্লাহ আমাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন যে) আপনি কখনো শিরক করবেন না।" (৬:১৪)
মক্কার কোন কোন মুশরিক এ কথা বলে বেড়াতো যে, আল্লাহর নবী মুহাম্মদ দারিদ্রের কারণে নিজেকে নবী হিসেবে দাবি করছে। তারা রাসূলুল্লাহ (সা.)'কে বলতো, তোমাকে আমরা আমাদের সম্পদের কিছু অংশ দিয়ে দিচ্ছি, তুমি শুধু নবুওয়াতের দাবি থেকে সরে দাঁড়াও। এ অবস্থায় মহান আল্লাহ বিশ্বনবীকে কাফেরদের উদ্দেশে বলতে বলেন : তোমরা যা কিছু খাও এবং যে সম্পদের বড়াই করছো- তার প্রকৃত মালিক আল্লাহ। তোমাদের নিজস্ব সম্পদ বলে তো কিছু নেই যে আমি আল্লাহকে ছেড়ে তোমাদের কাছে ধর্ণা দেব। আমি সেই আল্লাহ'র প্রতিনিধি মনোনিত হয়েছি যিনি আসমান ও জমিনের মালিক। আমি কখনোই তার সঙ্গে কাউকে শরীক করবো না এবং তাঁর সবগুলো নির্দেশ সবার আগে আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :
এক.আল্লাহ ছাড়া এ পৃথিবীতে কোন আশ্রয়স্থল নেই। ধনী-গরীব, জ্ঞানী-নির্বোধ, ছোট-বড় নির্বিশেষে সব মানুষ এক আল্লাহর পক্ষ থেকে দান করা খাবার খায় এবং সবাই তারই মুখাপেক্ষী।
দুই. আমাদের রাসূলের ধর্ম ইসলাম। ইসলাম গ্রহণের শর্ত হচ্ছে আল্লাহর কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ এবং তার নির্দেশাবলী মেনে চলা।