সূরা আন'আম; আয়াত ৪-৯
সূরা আন'আমের ৪ ও ৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-
وَمَا تَأْتِيهِمْ مِنْ آَيَةٍ مِنْ آَيَاتِ رَبِّهِمْ إِلَّا كَانُوا عَنْهَا مُعْرِضِينَ (৪) فَقَدْ كَذَّبُوا بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُمْ فَسَوْفَ يَأْتِيهِمْ أَنْبَاءُ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ ((৫
"তাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহের এমন কোন আয়াত তাদের কাছে আসে না, যা থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে না নেয়।" (৬:৪)
"এভাবেই তারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে যখনই তা তাদের কাছে আসে। কিন্তু তাদের কাছে সেই (আযাবের) যথার্থ সংবাদ অচিরেই আসবে যা নিয়ে তারা উপহাস করতো।" (৬:৫)
এর আগের আয়াতে আল্লাহ তায়ালার কয়েকটি মহান সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পৃথিবীতে মানুষ যে একটা নির্দিষ্টকাল বেঁচে থাকবে এবং তার আয়ু যে অত্যন্ত সীমিত, ওই সব আয়াতে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। কোনো কোনো মানুষ বিশ্বসৃষ্টি এমনকি তার নিজের অস্তিত্বের মধ্যেও আল্লাহর নির্দশন খুঁজে পাওয়ার পরও তা অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করার পথ বেছে নেয়। অন্য কথায়, অনেকেই আছেন যারা আল্লাহ’র নিদর্শন দেখতে পেলেও আল্লাহকে মেনে নিতে চান না। আসলে সে ওই ব্যক্তির মতো, যিনি ঘুমে না থেকেও ঘুমের অভিনয় করছেন এবং শত ডাকাডাকির পরও তিনি সাড়া দিচ্ছেন না। হাত দিয়ে নাড়া দেয়ার পরও যিনি জেগে ওঠেন না এবং এমন ভাব দেখান যে, তিনি ঘুমে রয়েছে। কিন্তু যিনি প্রকৃতপক্ষেই ঘুমিয়ে পড়েছেন, তিনি ডাক পাবার পরপরই জেগে ওঠেন।
পবিত্র কুরআনের এ আয়াতে ওই সব ব্যক্তিকেই সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছে, এমন অবস্থা বেশি দিন চলবে না। তারা তাদের খারাপ চিন্তা ও কাজের জন্য বিপদগ্রস্ত হবে এবং তখন তারা তাদের লোক দেখানো ঘুম থেকে জেগে ওঠতে বাধ্য হবে। কিন্তু তখন আর সংশোধনের সময় থাকবে না। এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. যারা সত্যকে স্বীকার করতে চায় না,তাদের কাছে কুরআনের আয়াত ও যুক্তির কোনো মূল্য নেই। তারা সব কিছুকেই প্রত্যাখ্যান করে।
দুই. অজুহাত সৃষ্টিকারী কাফেররা কোনো যুক্তির তোয়াক্কা করে না বরং মুমিন ব্যক্তি ও তাদের ধর্মবিশ্বাসকে নিয়ে উপহাস করাই তাদের উদ্দেশ্য।
সূরা আন’আমের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
أَلَمْ يَرَوْا كَمْ أَهْلَكْنَا مِنْ قَبْلِهِمْ مِنْ قَرْنٍ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ مَا لَمْ نُمَكِّنْ لَكُمْ وَأَرْسَلْنَا السَّمَاءَ عَلَيْهِمْ مِدْرَارًا وَجَعَلْنَا الْأَنْهَارَ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمْ فَأَهْلَكْنَاهُمْ بِذُنُوبِهِمْ وَأَنْشَأْنَا مِنْ بَعْدِهِمْ قَرْنًا آَخَرِينَ
"তারা কি দেখে না যে, আমি তাদের পূর্বে কত মানবগোষ্ঠীকে বিনাশ করে দিয়েছি? তাদেরকে দুনিয়াতে (শক্তি সামর্থে) এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম যেমন তোমাদেরকেও করিনি। আর তাদের উপর মুষলধারে বারিপাত করেছিলাম এবং তাদের পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত করেছিলাম। অতপর আমি তাদের পাপের কারণে তাদেরকে ধ্বংস করেছি এবং তাদের পরে পরবর্তী মানবগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছি।" (৬:৬)
যেসব ব্যক্তি তার জেদ ও একগুঁয়েমির কারণে সত্যকে মেনে নিতে রাজি নয়, তাদের উদ্দেশে এ আয়াতে বলা হচ্ছে, তোমরা কি অতীতের মানব গোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করনি? যেসব মানব গোষ্ঠী ও সভ্যতা অতীতে ধ্বংস হয়েছে তোমরা কি তাদের বিষয়ে জানতে পারনি? তোমরা কি ভাবছো যে, তোমরা তাদের চেয়েও বেশি শক্তি ও সামর্থের অধিকারী, যা আল্লাহর শক্তি-সামর্থ ও প্রভাবকেও ছাড়িয়ে গেছে? কিন্তু বাস্তবতা হলো, অতীতের কোনো কোনো জাতিকে এমন শক্তি-সামর্থ ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছিল, যা বর্তমান মানব জাতিকে দেয়া হয়নি। কিন্তু তারপরও তারা আল্লাহর দেয়া সুযোগ-সুবিধা ও অনুগ্রহকে অপব্যবহার করেছে এবং পাপ ও অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছিল। আর এ কারণেই আল্লাহ ওই সব মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং অন্য জাতিকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছে।
প্রতিটি মানুষ আলাদা আলাদাভাবে তার কাজের জবাব দেবে এবং এ জন্য পুরস্কার বা শাস্তি লাভ করবে। তবে অধিকাংশ মানুষের কাজের কারণেও সামষ্টিকভাবে একটি জাতি শাস্তির সম্মুখীন হয় এবং এ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই।
এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করা এবং অতীতের মানব গোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়াটা মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়ার একটি উপযুক্ত পন্থা এবং পবিত্র কুরআনের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক নেতারাও এ বিষয়ক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
দুই. মানুষের আচরণ ইতিহাসের নানা পরিবর্তন ও ঘটনার কারণ হয়েছে এবং পাপাচারে পরিপূর্ণ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া আল্লাহর রীতি।
তিন. বৈষয়িক প্রাচুর্য ও সুযোগ-সুবিধা, চূড়ান্ত কল্যাণ ও পরিপূর্ণতার চাবিকাঠি নয় বরং এর ফলে অনেকেই উদাসীন,অহংকারি ও নির্যাতনকারীতে পরিণত হয় এবং গোটা মানব গোষ্ঠীর ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সূরা আন’আমের ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَوْ نَزَّلْنَا عَلَيْكَ كِتَابًا فِي قِرْطَاسٍ فَلَمَسُوهُ بِأَيْدِيهِمْ لَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَذَا إِلَّا سِحْرٌ مُبِينٌ
"(হে মুহাম্মদ!) আমি যদি আপনার প্রতি কাগজে লিখিত কিতাবও নাযিল করতাম,যা তারা তা হাত দিয়ে স্পর্শও করত পারতো, তারপরও কাফিররা বলতো, ‘এতো সুস্পষ্ট যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।" (৬:৭)
বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে, মক্কার এক দল মুশরিক আল্লাহর রাসূলকে বলতেন- আমরা কেবল তখনি তোমার প্রতি ঈমান আনবো যখন আল্লাহর বাণী কাগজে লিখিত অবস্থায় আমাদের ওপর নাজিল হবে। যেমনিভাবে আল্লাহতায়ালা পাথরে লেখা অবস্থায় হযরত মূসা (আ.) এর কাছে তাওরাত নাজিল করেছিল এবং তিনি সিনাই পর্বত থেকে মানুষের কাছে তাওরাতের ফলকগুলো নিয়ে এসেছিলেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে পবিত্র কুরআন মক্কার ওই মুশরিকদের কথার জবাবে বলেছে, তাওরাতের মতো কুরআনকে লিখিতভাবে নাজিল করা হলেও তারা অন্য কোনো অজুহাত খুঁজে বের করতো এবং বলতো-এটা সুস্পষ্ট জাদু এবং এটা কোনো ঐশী মোজেজা নয়। কারণ সে সময়ই পাথরে লিখিত তাওরাত দেখেও অনেকেই মূসা (আ.)কে বিশ্বাস করেননি এবং তারা এটাকে জাদু বলেছিল।
সূরা আন’আমের ৮ ও ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَقَالُوا لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْهِ مَلَكٌ وَلَوْ أَنْزَلْنَا مَلَكًا لَقُضِيَ الْأَمْرُ ثُمَّ لَا يُنْظَرُونَ (৮) وَلَوْ جَعَلْنَاهُ مَلَكًا لَجَعَلْنَاهُ رَجُلًا وَلَلَبَسْنَا عَلَيْهِمْ مَا يَلْبِسُونَ ((৯
"তারা বলে, তার (মুহাম্মদ সা. এর) কাছে (প্রকাশ্যে) কোন ফেরেশতা কেন (তার নবুয়তের সাক্ষীরূপে) পাঠানো হয় না?’ যদি আমি (এভাবে) ফেরেশতা পাঠাতাম তাহলে (সকল পরীক্ষার) চূড়ান্ত ফয়সালাতো হয়েই যেতো, এরপর তাদেরকে আর কোনো অবকাশ দেয়া হতো না।" (৬:৮)
"আর যদি তাকে (মুহাম্মদ সা. কে) ফেরেশতা বানাতাম তবু তাকে মানুষ আকারেই বানাতাম। এতেও ওই সন্দেহই করতো, এখন যা করছে।" (৬:৯)
মুশরিকরা ঈমান না আনার অজুহাত হিসেবে আরেকটি আবেদন জানিয়েছিল। তারা বলেছিল, যে ফেরেশতা ওহি নিয়ে আসে তাকে প্রকাশ্যে আসতে হবে, যাতে সবাই তাকে দেখতে পায় অথবা রাসূলকেই ফেরেশতা বানাতে হবে। তাদের এ অজুহাতের জবাবে আল্লাহ বলেছেন, যদি তোমরা ফেরেশতাকে দেখতে চাও, তাহলে ওই ফেরেশতাকেও মানুষের আকার দেয়া হবে। সে অবস্থাতেও তাকে ফেরেশতা হিসেবে চিনে নেয়া তোমাদের জন্য কঠিন হবে। এ অবস্থাতেও তোমরা বলবে যে, ওই ফেরেশতাও তোমাদের মতোই একজন মানুষ। আল্লাহতায়ালা আরো বলছেন, তোমাদের অজুহাত সৃষ্টির যে প্রবণতা রয়েছে তাতে এটা নিশ্চিত যে, ঈমান আনার মানসিকতা তোমাদের নেই। এ অবস্থায় তোমাদের কথা শুনে মোজেজা সংঘটিত করা হলে আল্লাহর শাস্তি পাওয়া ছাড়া তোমাদের আর কোন উপায় থাকতো না এবং এ অবস্থায় তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য ছিল। কাজেই আল্লাহ তোমাদের ওই দাবি বাস্তবায়ন না করে এর মাধ্যমে তোমাদেরকে অনুগ্রহ করেছেন।
এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, অনেক ব্যক্তির অহংকার ও হিংসা তাদেরকে এমন অবস্থায় নিয়ে যায় যে, তারা স্বজাতি অর্থাত কোনো মানুষকে রাসূল হিসেবে মেনে নিতে পারে না। তারা ভাবে, রাসূল হবেন ফেরেশতাদের মধ্য থেকে অথবা মানব জাতির চেয়ে উচ্চতর কোন সৃষ্টিকূল থেকে। কিন্তু রাসূলতো শুধু ঐশী বার্তা বহনকারী নয় বরং তিনি মানব জাতির আচার-আচরণ ও কাজ-কর্ম কেমন হবে,তার আদর্শ প্রতিষ্ঠাকারী। কিন্তু কোনো ফেরেশতাই মানুষের জন্য আদর্শ হতে পারবে না। কারণ মানুষ ও ফেশেরতাদের চাওয়া-পাওয়া এবং স্বভাব-প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
এক. কেউ যদি সত্যের সন্ধানে থাকে তাহলে সে খুব ছোটখাটো যুক্তি ও অলৌকিকতা উপলব্ধি করেই ওই সত্যকে মেনে নেয়। কিন্তু যার মধ্যে শুধু অজুহাত সৃষ্টির প্রবণতা রয়েছে, তার সামনে ফেরেশতাকে এনে উপস্থিত করা হলেও সে তা প্রত্যাখ্যান করবেই।
দুই. আল্লাহর পথে আসতে নবী-রাসূলগণ মানুষকে আহ্বান জানাতেন। মানুষকে কল্যাণের দিকে আনার জন্য আল্লাহর প্রেরিত ওহি সবার সামনে তুলে ধরতেন এবং মানুষকে তা মেনে চলার জন্য সুযোগ ও সময় দিতেন। কিন্তু ওই সব মানুষের আহ্বানে যদি কোনো মোজেজা বা অলৌকিক কিছু ঘটানো হতো তাহলে তখন আর মানুষের জন্য ঈমান আনা ছাড়া ভিন্ন কোন উপায় থাকতো না। এর ব্যত্যয় ঘটলে তখন তাদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়তো।