সূরা আল মায়েদা; আয়াত ১১৮-১২০
সূরা মায়েদার ১১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
"(হযরত ঈসা (আ.) বললেন, হে আল্লাহ ) যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা তো আপনারই দাস এবং যদি আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত, মহাবিজ্ঞ।" (৫:১১৮)
গত পর্বে বলা হয়েছে যে, হযরত ঈসা (আ.)-কে যারা আল্লাহর সমতুল্য মনে করে কেয়ামতের দিন তিনিই তাদের সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করবেন এবং তাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিবেন যে তারা যে বিশ্বাস লালন করেছে তা ছিল সকল পয়গম্বরদের প্রচারিত ঐশি ধর্মের বিপরিত।
এই আয়াতে বলা হচ্ছে, কেয়ামতের দিন হযরত ঈসা (আ.) তাঁর অনুসারীদের জন্যে ক্ষমার আর্জি জানিয়ে বলবেন, হে আল্লাহ আপনি যদি তাদেরকে শাস্তি দেন-তারা অবশ্য শাস্তি পাওয়ার যোগ্য এবং আপনারও তা দেয়ার অধিকার রয়েছে, কিন্তু আপনি যদি তাদের অপরাধগুলো উপেক্ষা করে ক্ষমা করে দেন তাহলে তা হবে আপনার অসীম দয়া ও অনুগ্রহের সাথে সামঞ্জস্যশীল।
উম্মতের প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিক সম্পর্কের কারণে পয়গম্বররা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ বা শাফাআত করে থাকে। তবে তাদের জন্যই শাফাআত করা হয় যারা এর জন্য উপযুক্ত।
যেমন- কোন ছাত্র যদি নিয়মিত লেখাপড়া করার পর কোন কারণে পাস নাম্বার পেতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে তার যোগ্যতা ও পড়াশোনায় নিষ্ঠার বিষয়টি বিবেচনা করে শিক্ষক তাকে পাস নাম্বার দিতে পারেন। তেমনি একজন ঈমানদার মানুষ যখন অনেক নেক কাজের পাশাপাশি দু'একটি গুনাহ করে ফেলে তখন সে ক্ষেত্রে অলি-আউলিয়া, বিশেষকরে পয়গম্বরদের শাফায়াত বা সুপারিশে তার মুক্তি মিলতে পারে।
সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)ও তাঁর উম্মাতের জন্য দোয়া করতেন, হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) যখনই এই আয়াতটি তেলাওয়াত করতেন, তখনই দু হাত উপরের দিকে উঠিয়ে গুনাহগার উম্মতের মুক্তির জন্য ফরিয়াদ জানাতেন।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
এক. শাস্তি দেয়া, ক্ষমা করা এবং পুরস্কৃত করার এখতিয়ার একমাত্র আল্লাহর। কাজেই আমরা কাউকে জাহান্নামী বলতে পারি না বা গুনাহগার সাব্যস্ত করতে পারি না। কারণ বহু মানুষ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাওবা করে সুপথে ফিরে আসতে পারে এবং বেহেশতে যেতে পারে।
দুই. আল্লাহ তা'লা অহেতুক কাউকে স্বর্গ বা নরকে নিক্ষেপ করেন না, তিনি তা করেন নিজের প্রজ্ঞা ও হেকমত অনুসারে।
তিন. নবী-রাসূলরা শাফায়াত করার অধিকার রাখেন, তবে শুধু তাদের জন্যই যারা শাফায়াত লাভের যোগ্য।
এ সূরার ১১৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-
قَالَ اللَّهُ هَذَا يَوْمُ يَنْفَعُ الصَّادِقِينَ صِدْقُهُمْ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
"আল্লাহ (হযরত ঈসার জবাবে) বললেনঃ আজকের দিনে সত্যবাদীদের সত্যবাদিতা তাদের উপকারে আসবে। তাদের জন্যে উদ্যান রয়েছে, যার তলদেশে নির্ঝরিনী প্রবাহিত হবে; তারা তাতেই চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। এটিই মহান সফলতা।" (৫:১১৯)
সত্য ও সততাই কেবল মাত্র কেয়ামতের দিন কাজে আসবে। সত্যবাদিতা ও সততার কারণেই মানুষ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবী হাসিল করতে পারে।
এই আয়াতে ঈমান ও সৎকর্মের স্থলে সত্যতার কথা বলা হয়েছে, পবিত্র কোরআনের অন্যত্র সত্যতাকে মুক্তি ও সৌভাগ্যের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে সত্যতা বলতে ঈমান ও কর্মের ক্ষেত্রে খাঁটি বা নিখাদ হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ঈমান শুধু মুখে বলা নয়, বরং তা মনের গভীরে গ্রথিত হওয়া, তেমনি সৎকর্মও হতে হবে সম্পূর্ণ খাঁটি মনে, এক্ষেত্রে লোক দেখানো বা মানুষের প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে হলে হবে না। কাজেই এই আয়াতে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষ যা করবে তার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। কারণ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হলে তিনিও আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন। আর প্রত্যেক মানুষের কামনাই হচ্ছে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
ঈমানদারদেরকে যদি তাদের সত্যবাদিতার কারণে দুনিয়াতে নিগ্রহের শিকার হতে হয় তাহলে এই সততা বা সত্য পথে অবিচল থাকাটা আখেরাতে তাদের জন্য সাফল্যের চাবিকাঠিতে পরিণত হবে।
এ সূরার সর্বশেষ আয়াত অর্থাৎ ১২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا فِيهِنَّ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
"আকাশ ও ভূমণ্ডলে এবং তাদের মধ্যে যা কিছু আছে তার সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই এবং তিনি সর্ব বিষয়ে শক্তিমান।" (৫:১২০)
সূরা মায়েদার সর্বশেষ এই আয়াতে বিশ্ব জগতের বিশালতা এবং মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে, কারো এটা মনে করার উপায় নেই যে আল্লাহর কর্তৃত্বের বাইরে যাওয়া বা আল্লাহর ইচ্ছার ব্যতিক্রম কিছু করা সম্ভব। কেউ যদি এই পার্থিব জগতকেই প্রাধান্য দেয় তাহলে তার জানা দরকার যে এই ক্ষুদ্র ও নশ্বর জগতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। তাঁরই আনুগত্য করা উচিত।