সূরা আল মায়েদা;(৩১তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আল মায়েদা;(৩১তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 21:30:34 2-10-1403

সূরা আল মায়েদা; আয়াত ১০৯-১১৩

সূরা মায়েদার ১০৯ ও ১১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

يَوْمَ يَجْمَعُ اللَّهُ الرُّسُلَ فَيَقُولُ مَاذَا أُجِبْتُمْ قَالُوا لَا عِلْمَ لَنَا إِنَّكَ أَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ (১০৯) إِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ اذْكُرْ نِعْمَتِي عَلَيْكَ وَعَلى وَالِدَتِكَ إِذْ أَيَّدْتُكَ بِرُوحِ الْقُدُسِ تُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلًا وَإِذْ عَلَّمْتُكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَالتَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ وَإِذْ تَخْلُقُ مِنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ بِإِذْنِي فَتَنْفُخُ فِيهَا فَتَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِي وَتُبْرِئُ الْأَكْمَهَ وَالْأَبْرَصَ بِإِذْنِي وَإِذْ تُخْرِجُ الْمَوْتَى بِإِذْنِي وَإِذْ كَفَفْتُ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَنْكَ إِذْ جِئْتَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ إِنْ هَذَا إِلَّا سِحْرٌ مُبِينٌ ((১১০

"যেদিন (অর্থাৎ কেয়ামতের দিন) আল্লাহ সব পয়গম্বরকে একত্রিত করবেন, বলবেন: (আল্লাহর রাস্তায়) আহবানের জবাবে আপনারা কি উত্তর পেয়েছিলেন? তাঁরা বলবেন : (সত্যি বলতে) আমরা অবগত নই; আপনিই অদৃশ্য বিষয়ে মহাজ্ঞানী।" (৫:১০৯)

"যখন আল্লাহ বলবেন : হে ঈসা ইবনে মরিয়ম, তোমার ও তোমার মায়ের প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ করো, যখন আমি তোমাকে পবিত্র আত্মা দিয়ে সাহায্য করেছি। তুমি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে দোলনায় ও পরিণত বয়সে এবং যখন আমি তোমাকে কিতাব, প্রগাঢ় জ্ঞান, তাওরাত ও ইঞ্জিল শিক্ষা দিয়েছি এবং যখন তুমি আমার আদেশে কাদামাটি দিয়ে পাখির প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে, এরপর তুমি তাতে ফুঁ দিতে; ফলে তা আমার আদেশে পাখি হয়ে যেত এবং তুমি আমার আদেশে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে নিরাময় করে দিতে এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে (জীবিত অবস্থায়) বের করে আনতে এবং যখন আমি বনী-ইসরাইলের (জুলুম) থেকে তোমাকে রক্ষা করেছিলাম যখন তুমি তাদের কাছে প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলে, কিন্তু তাদের মধ্যে যারা কাফের ছিল, তারা বলল : এটা প্রকাশ্য যাদু ছাড়া কিছুই নয়।" (৫:১১০)

এ দুই আয়াতে নবী-রাসূলদের সঙ্গে আল্লাহর কথোপকথন বর্ণিত হয়েছে। এখানে নবী-রাসূলদের উম্মতের প্রতি মহান আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত এবং তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর ধর্ম কতখানি মেনে নেয়া হয়েছে- সে কথা বর্ণিত হয়েছে। পয়গম্বরদের যখন এ প্রশ্ন করা হয় যে, সাধারণ মানুষ তাদের প্রদর্শিত ধর্ম তাদের জীবদ্দশায় এবং তাদের মৃত্যুর পর কতখানি গ্রহণ করেছে- তখন নবী-রাসূলগণ উত্তর দেন : মহান আল্লাহই প্রকৃত জ্ঞানের অধিকারী এবং তিনিই মানুষের অন্তরের খবর রাখেন। আমরা জানি না, আমাদের মৃত্যুর পর আমাদের প্রদর্শিত পথ তারা কতখানি অনুসরণ করবে। এ দুই আয়াতে হযরত ঈসা (আ.)'এর সঙ্গে মহান আল্লাহর কথোপকথন বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ'র নবী ঈসা'র সঙ্গে এ সংলাপ সূরা মায়েদার শেষ আয়াত পর্যন্ত বর্ণনা করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রথম আয়োতে বলা হচ্ছে : আল্লাহর এই রাসূলের প্রতি তার নেয়ামতের সংখ্যা প্রচুর। হযরত ঈসা (আ.)'এর প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ শুরু হয়েছিল তার জন্মের পরপরই এবং তা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। স্বামীহীন মায়ের গর্ভে জন্ম, দোলনায় থাকা অবস্থায় কথা বলা, মাটি থেকে পাখির প্রতিকৃতি তৈরি করে তাকে জীবনদান, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রোগমুক্তি এবং কবরে শায়িত মৃত ব্যক্তিদের জীবিত করে দেয়া- ইত্যাদি ছিল হযরত ঈসা (আ.) এর মোজেযা বা অলৌকিক ঘটনা। মহান আল্লাহর অনুগ্রহে তিনি এ সব কাজ অবলীলায় করতে পারতেন।

তবে আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, এতসব অলৌকিক ঘটনা দেখানোর পরও বহু মানুষ ঈসা (আ.) ও তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি ঈমান আনেনি বরং এ সবকে যাদুমন্ত্র আখ্যায়িত করে কুফরি করেছে।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো :

এক. পবিত্র ও সতি-সাধ্বী মায়ের প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ থাকে এবং তার গর্ভ থেকে জন্ম নেয় সৎ ও নেককার সন্তান।

দুই. মানুষের অন্তর যদি কলুষিত হয়ে যায় তবে তা মাটি ও পাথরের চেয়েও কঠিন হয়ে পড়ে। হযরত ঈসা (আ.)'এর অন্তর পবিত্র ছিল বলে তিনি মাটির তৈরি পাখিতে ফুঁ দিয়ে তা জীবন্ত করে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কাফেরদের অন্তর অপবিত্র ছিল বলে তারা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারেনি।

তিন. আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদেরকে মানুষের রোগমুক্তির ক্ষমতা প্রদান করেছেন। কাজেই মানুষ নিজেদের রোগমুক্তির জন্য অলি-আউলিয়াদের কাছে ধর্ণা দিতে পারে এবং এতে ধর্মীয় দৃষ্টিতে দোষের কিছু নেই।

চার. বনী-ইসরাইল হযরত ঈসা (আ.)কে হত্যা করতে চাইলেও মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

সূরা মায়েদার ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى الْحَوَارِيِّينَ أَنْ آَمِنُوا بِي وَبِرَسُولِي قَالُوا آَمَنَّا وَاشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُونَ

"আর যখন আমি হাওয়ারীদের (বা ঈসা'র একান্ত অনুগতদের) অন্তরে ওহীর মাধ্যমে বার্তা পাঠালাম যে, আমার প্রতি এবং আমার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো, তখন তারা বলতে লাগলো, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমার আনুগত্যশীল।" (৫:১১)

এ আয়াতে হযরত ঈসা (আ.)'এর প্রতি মহান আল্লাহর আরেকটি অনুগ্রহের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, আমি পবিত্র অন্তরের অধিকারীদের বলে দিয়েছি, তারা যেন তোমার প্রতি ঈমান আনে। তারা আমার আদেশ পালন করে তোমার প্রদর্শিত পথ মেনে নিয়েছে। ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসেছে- হযরত ঈসা (আ.) এর একান্ত অনুগত অনুসারীর সংখ্যা ছিল ১২ জন। তাদের অন্তরের বিশুদ্ধতা এবং সমাজ সংস্কারে তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে তাদেরকে হাওয়ারি বা বার্তাবহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. মানুষের অন্তর পবিত্র ও বিশুদ্ধ হলে তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সঠিক পথ অনুসরণের নির্দেশনা লাভ করতে পারে।

দুই. মহান আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার মাধ্যমে প্রকৃত ঈমানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ঈমান ও আমল পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

সূরা মায়েদার ১১২ ও ১১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِذْ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ أَنْ يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ قَالَ اتَّقُوا اللَّهَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (১১২) قَالُوا نُرِيدُ أَنْ نَأْكُلَ مِنْهَا وَتَطْمَئِنَّ قُلُوبُنَا وَنَعْلَمَ أَنْ قَدْ صَدَقْتَنَا وَنَكُونَ عَلَيْهَا مِنَ الشَّاهِدِينَ

"যখন হাওয়ারীরা বলল : হে মরিয়ম-তনয় ঈসা, আপনার প্রতিপালক কি এরূপ করতে পারেন যে, আমাদের জন্য আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতারণ করে দেবে? ঈসা বলল : যদি তোমরা ঈমানদার হও, তবে আল্লাহকে ভয় করো (এবং এ ধরনের দাবি থেকে বিরত থাকো)।" (৫:১১২)

"তারা বললো : (আমরা নিছক অজুহাত সৃষ্টি করতে চাই না বরং) আমরা তা থেকে খেতে চাই; আমাদের অন্তর পরিতৃপ্ত হবে, আমরা জেনে নেব যে, আপনি সত্য বলেছেন এবং আমরা (অন্যদের কাছে গিয়ে) এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবো।" (৫:১১৩)

আগের আয়াতে বলা হয়েছে, হাওয়ারিরা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে হযরত ঈসা (আ.) এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। তবে তারা তাদের ঈমানকে পাকাপোক্ত করার এবং অন্তরকে আল্লাহর প্রতি আরো বেশি অনুগত করার জন্য হযরত ঈসা (আ.)কে কিছু অলৌকিক ঘটনা দেখাতে বলেছিলেন। তারা আসমান থেকে তাদের জন্য খাবার আনারও অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের এ সংক্রান্ত অনুরোধ আল্লাহর রাসূলের কাছে উপস্থাপনের ধরন শিষ্ঠাচার পরিপন্থী ছিল। তারা এমনভাবে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছিলো যেন মনে হয়েছে, আল্লাহর পক্ষে এ সব কাজ করা সম্ভব নয়। এ কারণে হযরত ঈসা (আ.) তাদের বলেন, তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পরেও কেন এ ধরনের কথা বলছো এবং এ রকম আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছো? জবাবে তারা বললো : আমরা আমাদের ঈমানকে সুদৃঢ় করার জন্য এ আবেদন জানিয়েছি। সেইসঙ্গে আমরা সাধারণ মানুষকে এ কথা বলতে চাই যে, দেখো, ঈসার খোদা কত অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী!

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. মানুষের ঈমানের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। ঈমানের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে এক সময় মানুষের অন্তরে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা তৈরি হয়। প্রতিটি মানুষের উচিত সে পর্যায়ে পৌঁছার চেষ্টা করা।

দুই. আল্লাহকে পরীক্ষা করতে যাওয়া মুমিন ব্যক্তির উচিত নয়। এমন কথা বলাও উচিত নয় যে, ‘আল্লাহ যদি সত্যিই থেকে থাকে, তবে অমুক কাজটি করে দিক'। বরং আল্লাহর কাছে চাওয়া উচিত, তিনি যেন তার প্রতি আমাদের বিশ্বাস শক্তিশালী করে দেন।