সূরা আন নিসা;(৩০তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আন নিসা;(৩০তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 21:15:46 2-10-1403

সূরা আন নিসা; আয়াত ১১০-১১৪

সূরা নিসার ১১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَمَنْ يَعْمَلْ سُوءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللَّهَ يَجِدِ اللَّهَ غَفُورًا رَحِيمًا ((১১০

"যে মন্দ কাজ করে কিংবা নিজেই নিজের ওপর জুলুম করে, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তার ব্যাপারে আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং করুণাময়।" (৪:১১০)

গত পর্বে আমরা বলেছিলাম যে, আল্লাহ মুমিনদেরকে সর্বপ্রকার খেয়ানত, গোপন কাজকর্ম কিংবা খেয়ানতকারীদের সহায়তা করা থেকে ফিরিয়ে রাখেন এবং তাদেরকে কিয়ামতের কঠিন শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। এই আয়াতে তাদের জন্যে তওবার পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে বলেছেনঃ যে কেউ অপরের সাথে অন্যায় করবে কিংবা গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে নিজের ক্ষতি ডেকে আনবে,সে যদি আল্লাহর দরবারে কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা চায় আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন এবং তার ওপর তাঁর রহমত বর্ষণ করবেন। সে কি গুনাহে সগিরা করলো না গুনাহে কবিরা-তাতে কোনো তারতম্য হবে না। কেননা আল্লাহর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হলো গুনাহ থেকে মুক্তি চেয়ে তওবা করার অবস্থা। তওবার মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে তাঁর রহমত লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি কারো জান কিংবা মালের ক্ষয়ক্ষতি করার মতো গুনাহ করে থাকে, তাহলে তার ক্ষতিপূরণ দেয়া ছাড়া তওবা কবুল হবে না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : গুনাহ মানে মূলত নিজেই নিজের ক্ষতি করা,আর নিজের ক্ষতি করার অধিকার মানুষের নেই।

দ্বিতীয়ত : আল্লাহ যে কেবল মন্দ কাজগুলোই ক্ষমা করে দেন তাই নয়,বরং তওবাকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন এবং তার প্রতি আল্লাহ বেশ সদয়।

সূরা নিসার ১১১ এবং ১১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَنْ يَكْسِبْ إِثْمًا فَإِنَّمَا يَكْسِبُهُ عَلَى نَفْسِهِ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا (১১১) وَمَنْ يَكْسِبْ خَطِيئَةً أَوْ إِثْمًا ثُمَّ يَرْمِ بِهِ بَرِيئًا فَقَدِ احْتَمَلَ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا ((১১২

"যে কেউ পাপ করে, প্রকৃতপক্ষে সে নিজেই নিজের ক্ষতি করে,আর আল্লাহ্ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।" (৪:১১১)

"যে ব্যক্তি নিজে ভুল করে কিংবা গোনাহ করে অন্য কোন নিরপরাধ ব্যক্তির ওপর দোষ চাপায়,সত্যিকার অর্থে সে প্রকাশ্য গুনাহ এবং অপবাদের বোঝা আপন কাঁধে বয়ে বেড়ায়।"(৪:১১২)

এ আয়াতে গুনাহের ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, গুনাহগার ব্যক্তি অন্যদের বা সমাজের ক্ষতি করার চেয়ে নিজেরই ক্ষতি করে বেশি। কেননা গুনাহের মাধ্যমে সে আল্লাহর দেয়া নিজের পবিত্র সত্ত্বাটাকে কলুষিত করে ফেলে এবং অন্তরাত্মার পবিত্রতার সুযোগ হাতছাড়া করে। এটা অনেক বড়ো ধরনের ক্ষতি। তাছাড়া ঐশী সমাজের রীতি বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী জনগণের ওপর যে-কোনো প্রকার জুলুম নির্যাতন-চাই তা সুদূরপ্রসারী হোক কিংবা সাময়িক-তার পরিণতি কিন্তু স্বয়ং জুলুমকারীকেই ভোগ করতে হয়। এই পৃথিবীতেই তাকে সেই জুলুমের নাগপাশে আবদ্ধ থাকতে হয়।

এ আয়াতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলোঃ

নিজেকে দোষমুক্ত মনে করা এবং অন্যদের ওপর অপবাদ চাপানো খুবই অন্যায়। কোরআনের ব্যাখ্যা অনুসারে এটা এক ধরনের আগ্রাসন এবং অন্যদের ওপর আক্রমণ বা তাদের মান সম্মানের ওপর আঘাত হানার শামিল।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

প্রথমতঃ গুনাহ এমন কোনো জিনিস নয় যা আঞ্জাম দিতে হয় এবং শেষ করতে হয়। বরং গুনাহ এমন এক জিনিস যা মানুষের মন ও আত্মার ওপর থেকে যায়।

দ্বিতীয়তঃ যে অপবাদ দেয় সে গুনাহের ভারি বোঝা আপন কাঁধে বয়ে বেড়ায়। কেননা সে জনগণের সম্মানে আঘাত হানে।

সূরা নিসার ১১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ وَرَحْمَتُهُ لَهَمَّتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ أَنْ يُضِلُّوكَ وَمَا يُضِلُّونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَضُرُّونَكَ مِنْ شَيْءٍ وَأَنْزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا ((১১৩

"যদি আপনার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না থাকত, তবে তাদের একদল আপনাকে পথভ্রষ্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল। কিন্তু তারা আসলে নিজেদেরকেই পথভ্রষ্ট করে, আপনার কোন অনিষ্ট করতে পারে না। আল্লাহ্ আপনার প্রতি ঐশী গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা অবতীর্ণ করেছেন এবং আপনাকে এমন বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন,যা আপনি জানতেন না। আপনার প্রতি আল্লাহর করুণা অসীম।" (৪:১১৩)

ইতিহাসে এসেছে- মুশরিকদের একটি দল রাসূলে খোদার কাছে এসে বললোঃ "আমরা দু'টি শর্তে তোমার হাতে বাইয়াত করতে এবং তোমার দ্বীনের প্রতি ঈমান আনতে রাজি আছি। এক. মূর্তিগুলোকে নিজ হাতে ভাঙবো না। দুই. আরো এক বছর আমরা মূর্তি পূজা করবো।" তাদের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়,যেখানে নবীজীকে সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ "তারা নিজেরা হেদায়াত লাভ করার পরিবর্তে আপনাকে গোমরাহির দিকে টেনে নিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা আপনাকে কিতাব এবং প্রজ্ঞা শিখিয়েছেন এবং তাঁর অশেষ দয়ায় সর্বপ্রকার বিচ্যুতি থেকে আপনাকে রক্ষা করেছেন।"

এ আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলোঃ

প্রথমতঃ আল্লাহ তায়ালা তাঁর পয়গাম্বরকে সর্বপ্রকার ভুল ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করেছেন। তার মানে নিষ্পাপ হওয়াটা নবীদের বৈশিষ্ট্য।

দ্বিতীয়তঃ আল্লাহ তায়ালা নিজেই নবীদের শিক্ষক। স্বাভাবিকভাবেই এই শিক্ষায় কোনো ধরনের ভুল ভ্রান্তির অবকাশই নেই।

সূরা নিসার ১১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاةِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا ((১১৪

"তাদের অধিকাংশ গোপন কথাবার্তা কিংবা সলা-পরামর্শে মঙ্গল বা কল্যাণ নেই; তবে সদকা দেয়া বা পূণ্য কাজকর্ম করা এবং জনগণের মাঝে সংস্কারের আদেশ দেয়া অবশ্যই ভিন্ন ব্যাপার। যে আল্লাহর সন্তূষ্টির জন্যে এ কাজ করে আমি তাকে শীঘ্রই বড়ো রকমের পুরস্কারে ভূষিত করবো।" (৪:১১৪)

এই আয়াতে অপছন্দনীয় একটি নৈতিক দিকের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাহলো গোপনে বা কারো অগোচরে কথা বলা। অবশ্য এমন কিছু কথা আছে যা গোপনে বলাই সমীচিন,সেকথা আলাদা। কিন্তু প্রয়োজনীয় ঐ গোপনীয়তা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে গোপন কথা বলাটা পছন্দনীয় কাজ নয়। এ আয়াত অনুসারে যেসব কাজ গোপনে করা অন্যায় নয়,সেসব কাজের মধ্যে রয়েছে কাউকে দান খয়রাত করা,বঞ্চিতদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা ইত্যাদি।অন্যান্য আয়াতে দান খয়রাত গোপনে করার জন্যে আদেশ দেয়া হয়েছে।একইভাবে যে সমস্ত ক্ষেত্রে আমরে বিল মারুফ অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ দেয়ার দায়িত্বটা গোপনে পালন করার মধ্যেই বেশি বেশি কল্যাণ নিহিত বলে মনে করা হয়,সেখানেও গোপনে এ কাজ করা ভালো। তবে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো পরিবার এবং জনগণের মাঝে সংস্কার কাজ চালানোর ক্ষেত্রে ব্যক্তির মান মর্যাদা রক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে গোপনেই তা করা সমীচিন।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

এক,সামাজিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো মানুষের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করার পাশাপাশি অন্যান্য দিকের প্রতিও লক্ষ্য রাখা।

দুই,নিষ্ঠা ও একাগ্রতার ওপরেই কাজের মূল্যায়ন নিহিত।পূণ্য কাজে গোপনীয়তা রক্ষা করা ঐকান্তিক নিষ্ঠার অনুগামী।