সূরা বাকারাহ;(৬৭তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা বাকারাহ;(৬৭তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:2:36 2-10-1403

সূরা বাকারাহ;আয়াত ২৬৮-২৭২

সূরা বাকারাহ'র সূরার ২৬৮ ও ২৬৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-

 

الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَاءِ وَاللَّهُ يَعِدُكُمْ مَغْفِرَةً مِنْهُ وَفَضْلًا وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (২৬৮) يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ

 

"দান খয়রাতের সময় শয়তান তোমাদেরকে অভাবের ভয় দেখায় এবং লোভ ও কৃপণতার মত বিভিন্ন জঘন্য কাজে উৎসাহ দেয়। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আল্লাহ প্রশস্ত মহাজ্ঞানী। (২:২৬৮)

"তিনি যাকে ইচ্ছা জ্ঞান বা প্রজ্ঞা দান করেন এবং যাকেই তিনি প্রজ্ঞা দেন,সে নিশ্চিতভাবে প্রচুর কল্যাণ লাভ করে। জ্ঞানীরা ছাড়া কেউই উপদেশ গ্রহণ করে না।" (২:২৬৯)

শয়তান ও শয়তানের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষেরা বিভিন্ন উপায়ে দান-খয়রাত ও অন্যকে সাহায্য করা থেকে মানুষকে বিরত রাখে। শয়তান এ কুমন্ত্রণা দেয় যে,তোমার নিজেরই তো অর্থ সম্পদের দরকার হবে। আবার কখনো এ কুমন্ত্রণা দেয় যে,কেন তুমি কষ্ট করছ বা কেন তাকে সাহায্য করছ ? যদি আল্লাহ চাইতেন তাহলে সে দরিদ্র ও অভাবী হত না। এ জাতীয় স্বভাবের লোকেরা অন্যদেরকে দান-খয়রাত করতে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করে এবং মানুষকে সম্পদ জমা করতে প্ররোচিত করে,একইসাথে তারা মানুষকে অভাব ও দারিদ্রের ভয় দেখায়। অথচ এ দুনিয়ায় আমাদের যতটুকু খোদার অনুগ্রহ দরকার,তার চেয়ে বেশী অনুগ্রহ দরকার হবে বিচার দিবসে। এছাড়াও যারা আল্লাহর রাস্তায় গরীবদের দান খয়রাত করে আল্লাহ তাদের ভবিষ্যত কল্যাণের নিশ্চয়তা দিয়েছেন অথাৎ তারা দারিদ্রের মোকাবেলায় বীমার সুবিধে পাবে। দুঃখজনক বিষয় হলো,অনেকেই এই কৌশলপূর্ণ দিকের প্রতি গুরুত্ব দেন না এবং শয়তানের প্ররোচনার শিকার হয়। তারা শুধু অর্থ সম্পদকেই কল্যাণ বলে মনে করে। অথচ প্রকৃত কল্যাণ হলো,প্রজ্ঞা বা দূরদর্শীতার অধিকারী হওয়া এবং সঠিক পথ বাছাইয়ের ক্ষমতা লাভ করা। তাই প্রকৃত জ্ঞানীরা আল্লাহর ক্ষমার ওয়াদা সত্ত্বেও শয়তানের কুমন্ত্রণায় কান দেন না।

 

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক গুলো হলো-

প্রথমত : দারিদ্রের ভয়ে কৃপনতা করা উচিত নয়। কারণ,শয়তানই দারিদ্রের ভয় দেখায় যাতে আমরা দান-খয়রাত না করি। তাই আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করার মাধ্যমে দারিদ্রের ভয় মন থেকে দূর করতে হবে।

দ্বিতীয়ত : সুস্থ বিবেকের অধিকারী ব্যক্তি শয়তানের প্রলোভন ও কুমন্ত্রণায় কান না দিয়ে আল্লাহর ওয়াদায় বিশ্বাস করে। ইসলামের দৃষ্টিতে সেই জ্ঞানী যে আল্লাহর অনুগত। যে নিজের খেয়াল খুশী তথা প্রবৃত্তি,শয়তান ও খোদা বিরোধী লোকদের অনুসরন করে তাকে প্রকৃত জ্ঞানী বলা যায় না।

 

এরপর ২৭০ ও ২৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 

وَمَا أَنْفَقْتُمْ مِنْ نَفَقَةٍ أَوْ نَذَرْتُمْ مِنْ نَذْرٍ فَإِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُهُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ (২৭০) إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

 

"যা কিছু তোমরা দান কর বা মানত কর আল্লাহ তা জানেন। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই।" (২:২৭০)

"তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান কর,তবে ভাল। আর যদি তা গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তকে দাও,তবে তা তোমাদের জন্য আরো ভাল। এতে তোমাদের অনেক অকল্যাণ বা পাপ দূর হবে। তোমরা যা কর,আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন।" (২:২৭১)

 

দান-খয়রাতের পথে একটি বড় বাধা হলো,অধিকাংশ দাতা এটা চান যে,দানের জন্য তার প্রশংসা করা হোক। তাই,এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন,তোমার ভালো কাজের দিকে কেউ লক্ষ্য না করুক কিংবা কেউ কৃতজ্ঞতা না জানাক,কিন্তু আমি আল্লাহ তো তোমার ভাল কাজের সাক্ষী রইলাম এবং আমার কাছে তোমার কাজ লিপিবদ্ধ বা রেকর্ড হয়ে রইল। তবে কি তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করছ না? যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দান করে থাকো তবে কেন মানুষের কাছে প্রতিদানের আশা করছ? তাই মানুষের জানা উচিত,আল্লাহ তাদের সব কাজই দেখছেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিই হলো সৎকাজের মূল লক্ষ্য। কোরআনের ভাষায় দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের প্রতি উদাসীনতা ‌এক ধরনের জুলুম বা অন্যায়। জালেম লোকেরা বিচার দিবসে সব ধরনের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে। দান করার ক্ষেত্রে যাকাতের মত ফরজ বা অবশ্য পালনীয় দান প্রকাশ্যে করা ভাল,কিন্তু মুস্তাহাব বা ইচ্ছাধীন দান গোপনে করা ভাল। সম্ভবত: এর যুক্তি হলো ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কাজ করা সবারই দায়িত্ব এবং এতে সাধারণত: লোক দেখানোর প্রবণতা থাকে না এবং অন্যরা ফরজ আদায়ের ব্যাপারে সচেতন হয়।

 

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-

প্রথমত : আল্লাহ আমাদের দানের খবর রাখেন। তাই সবচেয়ে ভালো সম্পদ থেকে আল্লাহর রাস্তায় দান করতে হবে এবং দানের উদ্দেশ্য হতে হবে সবচেয়ে মহৎ আর সবচেয়ে মহৎ উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।

দ্বিতীয়ত : দান করতে হবে কখনো প্রকাশ্যে এবং কখনো গোপনে। প্রকাশ্য-দানে অন্যরা দান করতে উৎসাহী হয়। আর গোপনে দানের মাধ্যমে অহংকার ও নিজেকে জাহির করা থেকে দূরে থাকা যায়।

তৃতীয়ত : দান-খয়রাত হলো গোনাহ মাফ বা ক্ষমা লাভের একটি মাধ্যম। তওবা ও ক্ষমা লাভের জন্য অনেক সময় দান খয়রাত করা উচিত যাতে আল্লাহ আমাদের গোনাহ বা পাপ ক্ষমা করে দেন।

 

এরপর ২৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 

لَيْسَ عَلَيْكَ هُدَاهُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَلِأَنْفُسِكُمْ وَمَا تُنْفِقُونَ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللَّهِ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تُظْلَمُونَ

 

"হে নবী,তাদেরকে (মানুষকে) সৎপথে আনার দায় আপনার নয়। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। যে মাল তোমরা ব্যয় কর,তা নিজ উপাকারার্থেই কর। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে ব্যয় কর না। তোমরা যে,অর্থ ব্যয় করবে,তার পুরস্কার পুরোপুরি পেয়ে যাবে এবং তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে না।" (২:২৭২)

 

বিভিন্ন তাফসীরের বর্ণনায় দেখা যায়,মুসলমানরা দরিদ্র মুশরিকদের দান করার ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। যখন তাঁরা রাসুল (সঃ)- কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করল তখন এ আয়াত নাজেল হয়। এ আয়াতে বলা হয়েছে,জোর করে ধর্ম চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। তাই প্রকৃত মুসলমানের সাহায্য পাওয়ার জন্য মুসলমান হওয়ার সার্টিফিকেট দেখাতে হয় না। আল্লাহ যেমন এ পৃথিবীতে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সবাইকে জীবিকা ও অন্যান্য অনুগ্রহ দিয়ে থাকেন,তেমনি কোন প্রকৃত মুসলমান অভাবী ও দরিদ্রকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে কে মুসলমান ও কে অমুসলমান তা দেখেন না। কারণ,সব মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি বলে সাহায্য পাবার অধিকার রাখে। আর ইসলামের শত্রু নয় এমন দরিদ্র অমুসলিমদের সাহায্য করলেও বিচার দিবসে এর পূর্ণ প্রতিদান পাওয়া যাবে। ইসলাম মানব প্রেমের ধর্ম ও মানব দরদী ধর্ম।

 

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-

প্রথমত : ধর্ম বিশ্বাস গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা যাবে না,এমনকি নবীরাও কাউকে ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করতে পারেন না।

দ্বিতীয়ত : ইসলাম মানব সেবার ধর্ম। কোন অমুসলিমও দরিদ্র থাকুক ইসলাম তা চায় না।

তৃতীয়ত : কেউ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করে,তাহলে সে তার সৎ কাজের প্রতিদান পৃথিবীতে ও পরকালে অবশ্যই পাবে।