সূরা আলে ইমরান;(পর্ব ৩১)
  • শিরোনাম: সূরা আলে ইমরান;(পর্ব ৩১)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 15:17:36 2-10-1403

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১৬৪-১৬৮

সূরা আলে ইমরানের ১৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ ((১৬৪

"তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই তাদের কাছে রাসূল পাঠিয়ে আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন,তিনি তাদের কাছে আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শনাবলী পাঠ করেন,তাদেরকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করেন এবং গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেন। নিশ্চয়ই এর আগে তারা প্রকাশ্য ভ্রান্তির মধ্যে ছিল।" (৩:১৬৪)

সৃষ্টি জগতের সব সৃষ্টির প্রতি বিশেষ করে মানুষের প্রতি আল্লাহ বিশেষ দয়া বা অনুগ্রহ করেছেন। মানুষের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত বা অনুগ্রহের মধ্যে সবচেয়ে বড় নেয়ামত হলো জীবনের পথ নির্দেশনা। মূলত হেদায়াত তথা পথ নির্দেশনা ছাড়া মানুষের সমস্ত প্রতিভা,চিন্তা-ভাবনা,ত্যাগ,শ্রম এসবই পণ্ডশ্রম ও পথ ভ্রষ্টতার শিকার হতে বাধ্য। যেমনটি আমরা বর্তমান যুগেও দেখছি,বিবেক ও ওহীর মাধ্যমে প্রদর্শিত খোদায়ী পথ নির্দেশনার প্রতি গুরুত্ব না দেয়ার ফলে বহু মানুষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক অশান্তি,সামাজিক উত্তেজনা,সহিংসতা এবং হতাশার শিকার । অথচ আল্লাহ মানব সমাজকে সব ধরনের বিভ্রান্তির পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করে তার উন্নতি ও বিকাশের জন্য যুগে যুগে অনেক নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁরা মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী ব্যাখ্যা করেন এবং মানুষকে বিভিন্ন জ্ঞান শিক্ষা দিয়ে বিবেক ও প্রকৃতিগত স্বভাবের বিকাশের মাধ্যমে পথভ্রষ্টতা থেকে তাদের রক্ষা করেন।

এই আয়াতে শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো-
প্রথমত : মানুষের পথ-নির্দেশনার জন্য নবী রাসূলদের মনোনয়ন মানবজাতির জন্য শ্রেষ্ঠ খোদায়ী উপহার। তাই সবারই এই নেয়ামতের গুরুত্ব বোঝা উচিত ।
দ্বিতীয়ত : জ্ঞানের চেয়ে আত্মসংশোধন বা পবিত্রতা বেশি জরুরী। পবিত্র উৎসের জ্ঞানই কল্যাণকর বা উপকারী।
তৃতীয়ত : কোরআনের শিক্ষা ও রাসূল (সা.) এর আদর্শ অনুযায়ী আত্মগঠন ও আত্মসংশোধনের চেষ্টা চালাতে হবে। এ দুই পথ নির্দেশনা বাদ দিয়ে আত্মগঠন ও আত্ম সংশোধনের যত প্রচেষ্টাই চালানো হোক না কেন তা ব্যর্থ হতে বাধ্য ।

সূরা আলে ইমরানের ১৬৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أَوَلَمَّا أَصَابَتْكُمْ مُصِيبَةٌ قَدْ أَصَبْتُمْ مِثْلَيْهَا قُلْتُمْ أَنَّى هَذَا قُلْ هُوَ مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ((১৬৫ 

"যখন তোমাদের উপর বিপদ উপস্থিত হয়-তার চেয়ে দ্বিগুণ বিপদ তোমাদের মাধ্যমে শত্রুদের ওপর আসা সত্ত্বেও-তোমরা বলো এ বিপদ কোত্থেকে এলো? কেন আমরা পরাজিত হলাম? আপনি বলুন! তোমাদের নিজেদের দোষেই তোমরা পরাজিত হয়েছিলে । আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।" (৩:১৬৫)

ওহুদ যুদ্ধে যখন ৭০ জন মুসলমান শহীদ হলো এবং মুসলমানরা পরাজিত হলো তখন একদল মুসলমান মহানবী (সা.)কে প্রশ্ন করেন,কেন আমরা পরাজিত হলাম? পবিত্র কোরআনে আল্লাহ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন,তোমরা গত বছর বদর যুদ্ধে ১৪০ জন শত্রু সেনার ওপর আঘাত হেনেছিলে। অর্থাৎ ৭০ জন শত্রুসেনা নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়েছিল। আর এ বছর রাসূলের নির্দেশ অমান্য করাসহ অন্তর্দ্বন্দ্ব ও হতাশার কারণেই তোমরা পরাজিত হয়েছ। এমনটি ভাবা উচিত নয় যে,আল্লাহ তোমাদের বিজয়ী করতে অক্ষম ছিলেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। কিন্তু আল্লাহর সাহায্যের শর্ত হলো,নবীর প্রতি তোমাদের আনুগত্য। তোমরা নবীর নির্দেশ অমান্য করেও আল্লাহর সাহায্য পাবার এবং বিজয়ী হবার আশা করতে পার না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : কোন বিষয়ে বিচার বিবেচনার সময় ঐ বিষয়ের তিক্ত ও মিষ্ট উভয় দিককে পাশাপাশি রাখা উচিত। তাই শুধু ওহুদের পরাজয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত নয়,বদর যুদ্ধে বিজয়ের দিকেও দৃষ্টি দেয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত : পরাজয়ের কারণ নির্ণয়ের সময় প্রথমে অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর সন্ধান করতে হবে। পরাজয়ের জন্য অন্যদের দায়ী করার আগে নিজের দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করে সেসব দিক সংশোধন করতে হবে।

সূরা আলে ইমরানের ১৬৬ ও ১৬৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَا أَصَابَكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ فَبِإِذْنِ اللَّهِ وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ (১৬৬) وَلِيَعْلَمَ الَّذِينَ نَافَقُوا وَقِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا قَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوِ ادْفَعُوا قَالُوا لَوْ نَعْلَمُ قِتَالًا لَاتَّبَعْنَاكُمْ هُمْ لِلْكُفْرِ يَوْمَئِذٍ أَقْرَبُ مِنْهُمْ لِلْإِيمَانِ يَقُولُونَ بِأَفْواهِهِمْ مَا لَيْسَ فِي قُلُوبِهِمْ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا يَكْتُمُونَ ((১৬৭

"ওহুদের যুদ্ধে দু'দলের সংঘর্ষে তোমাদের ওপর যে বিপর্যয় নেমে এসেছিল,তা আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটেছিল,যাতে জানা যায়,কারা প্রকৃত মুমিন এবং মোনাফিকদের চরিত্রও স্পষ্ট হয়।" (৩:১৬৬) 

"তাদের বলা হয়েছিল- এস আল্লাহর পথে সংগ্রাম কর,অথবা অন্ততঃ নিজেদের শহর ও ঘরবাড়ীর প্রতিরক্ষা কর। তারা বলেছিল- যদি আমরা যুদ্ধবিদ্যা জানতাম,তাহলে আমরা অবশ্যই তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে যেতাম। সেদিন তারা ঈমানের চেয়ে কুফরীর নিকটবর্তী ছিল,তাদের অন্তরে যা নেই,তা তারা মুখে বলে থাকে। কিন্তু তারা যা গোপন করে আল্লাহ তা জানেন।" (৩:১৬৭)

আগের কয়েকটি পর্বে বলা হয়েছে,মক্কার মুশরিকরা মদীনা আক্রমণ করতে আসছে এই খবর পাবার পর রাসূল (সা.) এক পরামর্শ সভা ডাকেন এবং অধিকাংশের পরামর্শ অনুযায়ী শহরের বাইরে ওহুদ ময়দানে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অবশ্য মদীনার কোন কোন প্রবীণ ব্যক্তি শহরের ভেতরে থেকে ঘর বাড়ীকে দূর্গ বানিয়ে শত্রু মোকাবেলা করার পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) যুবকদের মতামত ও অধিকাংশের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় তারা খুব দুঃখিত হন। ওহুদ প্রান্তরের দিকে রওনা হবার সময় তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ফিরে আসেন। তাদের পিছুহটা দেখে আরো কিছু মুসলমান অর্ধেক পথ পর্যন্ত গিয়ে সরে পড়ে। অর্থাৎ তারা এভাবে অন্যদের মনোবল দুর্বল করার ব্যাপারেও ভূমিকা রেখেছিল। এই দুই আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের বলছেন যদিও ওহুদ যুদ্ধ ছিল খুবই তিক্ত ঘটনা। কিন্তু এরফলে প্রকৃত মুমিন ও মুমিন হবার দাবিদারদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,কারা রাসূল (সা.)'র নির্দেশ মেনে নিতে রাজী ছিল এবং কারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য রাসূল (সা.)কে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো-
সুখ ও দুঃখের ঘটনা মানুষকে চেনার জন্য খোদায়ী পরীক্ষা মাত্র। এসব পরীক্ষায় আমরা যেন ব্যর্থ না হই সেজন্যে সাবধান ও সচেতন হতে হবে। কপটতা বা দ্বিমুখী নীতি মানুষকে কুফরী ও অবাধ্যতার দিকে টেনে নেয়। বহুরূপী সাজা তথা সবদলের সাথে থাকাকে ভাল কৌশল বা চালাকি মনে করা ঠিক নয়। বরং সততা ও সৎ নীতির ওপর অটল থাকা অর্থাৎ একরূপ নিয়ে থাকাটাই বিজয় ও সাফল্যের মূল শর্ত ।

সূরা আলে ইমরানের ১৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


الَّذِينَ قَالُوا لِإِخْوَانِهِمْ وَقَعَدُوا لَوْ أَطَاعُونَا مَا قُتِلُوا قُلْ فَادْرَءُوا عَنْ أَنْفُسِكُمُ الْمَوْتَ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ ((১৬৮

"মোনাফিকরা নিজেদের ঘরে বসেছিল। আর নিজ ভাইদের সম্পর্কে তারা বলছিল যদি তারা আমাদের কথা শুনতো,তবে নিহত হতো না। হে নবী! আপনি তাদের বলুন যদি তোমরা সত্যবাদী হও,তবে নিজেদেরকেই মৃত্যু হতে রক্ষা কর।" (৩:১৬৮)

ওহুদ যুদ্ধের আগে যারা বিভিন্ন তালবাহানা করে মুসলমানদের মনোবল দুর্বল করে দিয়েছিল,তারা যুদ্ধের পরও হতাশা সৃষ্টির প্রচারণা অব্যাহত রাখে। তারা শহর রক্ষার ব্যাপারে অবহেলা করার জন্যে কিংবা যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য অনুতপ্ত না হয়ে বরং যারা যুদ্ধে গেছে এবং শহীদ হয়েছে তাদেরকেই তিরস্কার ও বিদ্রূপ করতে থাকে। অথচ যুদ্ধের কারণেই কারো মৃত্যু হয় এমন ধারণা সত্য নয়। যাদের মৃত্যু অবধারিত তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়েও বাঁচতে পারে না। তাই আল্লাহও তাদেরকে বলছেন এমনটা মনে কর না যুদ্ধ থেকে পালিয়ে গিয়েই মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পারবে। সব মানুষকেই একদিন মরতে হবে কিন্তু যারা আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে গিয়ে মারা যায় তাদের বীরত্বপূর্ণ মৃত্যু,মৃত্যুর হাত থেকে পালিয়ে যাবার প্রত্যাশী লোকদের কাপুরুষোচিত মৃত্যুর চেয়ে সব দিক থেকেই শ্রেষ্ঠ।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলোঃ
শত্রুদের হামলার সময় ঘরে বসে থাকা এবং মুসলিম সমাজের জন্য বিপদ সৃষ্টি করা কপটতা ও ঈমানহীনতার লক্ষণ। যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের মনোবল দুর্বল করাও মুসলিম সমাজের মোনাফেকদের কাজ। মোনাফেকরা নিজেদেরকে অন্যান্য মানুষের চেয়ে উন্নত পর্যায়ের বলে মনে করে। তাই তারা আশা করে,অন্যরাও তাদের চিন্তাধারার অনুসরণ করবে।