সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১২৬-১৩১
সূরা আলে ইমরানের ১২৬ ও ১২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمَا جَعَلَهُ اللَّهُ إِلَّا بُشْرَى لَكُمْ وَلِتَطْمَئِنَّ قُلُوبُكُمْ بِهِ وَمَا النَّصْرُ إِلَّا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ (১২৬) لِيَقْطَعَ طَرَفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَوْ يَكْبِتَهُمْ فَيَنْقَلِبُوا خَائِبِينَ (১২৭)
"আল্লাহ যুদ্ধের সময় ফেরেশতা পাঠানোকে তোমাদের জন্য সুসংবাদ করেছেন,যাতে তোমাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। আর বিজয় বা নিরাপত্তা তো মহাজ্ঞানী ও পরাক্রমশালী আল্লাহর পক্ষ থেকেই।"(৩:১২৬)
"যারা অবিশ্বাসী হয়েছে,তাদের একাংশকে তিনি নির্মূল করেন,অথবা তাদেরকে ব্যর্থ বা লাঞ্ছিত করেন যাতে তারা হতাশ হয়ে নিজ শহরে ফিরে যায়।"(৩:১২৭)
এর আগে আমরা আলোচনা করেছিলাম,যুদ্ধ ক্ষেত্রে খোদায়ী সাহায্যের অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো,ফেরেশতা পাঠানো। শুধু নবীদের ওপরই ফেরেশতা নাজেল হয় না। আল্লাহ দৃঢ় বিশ্বাসী বা মুমিনদের কাছেও ফেরেশতা পাঠান,যাতে তাদের অন্তর দৃঢ়তর ও প্রশান্ত হয় এবং তারা হয় আশান্বিত ও উৎফুল্ল। কাফের ও জালেম শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে শয়তান সব সময়ই মুমিনদেরকে হতাশ করার চেষ্টা চালায়। অন্যদিকে ফেরেশতারা মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি সৃষ্টি করে যাতে তারা ক্লান্ত ও ভগ্ন হৃদয় না হয়ে বরং আরো দৃঢ় মনোবল নিয়ে শত্রুদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে নির্মূল করে দেয়,অথবা অন্তত শত্রুদেরকে পরাজিত করে যাতে শত্রুরা পরবর্তীকালে হামলা চালাবার সাহস না পায়।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : যেসব বক্তব্য ও লেখা ইসলামের সৈনিকদের হতাশ এবং হীনবল করে তা শয়তানেরই মন্ত্রণা। আর যেসব কথা ও কাজ ইসলামের সৈনিকদের আনন্দিত করে বা সুসংবাদ দেয় তা খোদায়ী প্রেরণা।
দ্বিতীয়ত : যদিও আল্লাহ মুসলমানদেরকে সব সময়ই বিজয়ী করার ক্ষমতা রাখেন,কিন্তু তিনি প্রজ্ঞা অনুযায়ী কাজ করেন। তাই মুসলমানরা যখন অলস বা ভীত ও হতাশ হয়ে পড়ে,তখন তারা পরাজিত হয়।
তৃতীয়ত : মুসলমানদের সাহসিকতা,ঐক্য ও শক্তি এমন হওয়া উচিত,যেন শত্রুরা তাদের ওপর কর্তৃত্ব বা প্রভাব সৃষ্টির ব্যাপারে আশাবাদী না হয় এবং মুসলমানদের কাছে লাঞ্ছিত হয়।
সূরা আলে ইমরানের ১২৮ ও ১২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذِّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُونَ (১২৮) وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ يَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ((১২৯
"হে নবী,কাফেরদেরকে শাস্তি বা দয়া দেখানোর ব্যাপারে আপনার কিছুই করণীয় নেই। আল্লাহই তাদেরকে ক্ষমা করবেন অথবা শাস্তি দেবেন।" (৩:১২৮)
"আকাশ ও ভূমিতে যা কিছু আছে সমস্তই আল্লাহর। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন ও যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।" (৩:১২৯)
বিভিন্ন তাফসীরের বর্ণনা থেকে জানা যায়,ওহুদ যুদ্ধের সময় কাফেরদের পাথরের আঘাতে মহানবী (সা.)'র দাঁত ভেঙ্গে যায় এবং কপাল ফেটে রক্তের ধারা প্রবাহিত হয়েছিল। তখন আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেনঃ এই মানুষেরা কীভাবে সত্যের পথে আসবে? আর এ অবস্থায় এই দুই আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং এতে রাসূল (সা.)কে বলা হলো,মানুষের কল্যাণ বা হেদায়াত আল্লাহরই হাতে রয়েছে। আপনার দায়িত্ব হলো,শুধু আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়া। যে তা গ্রহণ করবে,মুক্তি পাবে আর যে তা গ্রহণ করতে চাইবে না,সে মুক্তি পাবে না। যারা আল্লাহর বাণী প্রত্যাখ্যান করেছে,অথবা আল্লাহর অনুগ্রহে তা গ্রহণ করেছে,তাদেরকে আল্লাহই শাস্তি দিবেন অথবা ক্ষমা করবেন। আর এখানেই কোরআন ও মহানবীর সত্যতার প্রমাণ মেলে। মানুষকে ক্ষমা করা ও পুরস্কার দেয়ার দায়িত্ব মহানবীর নয়। মহানবী (সা.) যদি আল্লাহর নবী না হতেন তাহলে এমন কথা তিনি বলতেন না। আল্লাহর নবী না হলে তিনি এ ধরনের আয়াত মানুষের কাছে গোপন রাখতেন। কারণ এই সব আয়াতে মানুষের ব্যাপারে রাসূল (সা.)'র দায়িত্ব সীমিত করা হয়েছে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : নবী ও তাঁর পরবর্তী ধর্মীয় নেতাদের পক্ষে দায়িত্ব পালন করে যাওয়াটাই জরুরী,ফলাফলের দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত করা হয়নি। মানুষের কাছে সত্যের বাণী পৌঁছে দেয়াই তাঁদের দায়িত্ব। মানুষ সত্যের বাণী গ্রহণ করল কি করলো না বা আল্লাহ তাদের সাথে কোন ধরনের আচরণ করবেন সে ব্যাপারেও ধর্ম প্রচারকদের কোন দায়িত্ব নেই।
দ্বিতীয়ত : তওবার পথ কখনোই এবং কারো জন্যেই বন্ধ নয়। যুদ্ধ থেকে পলাতক মুসলমান অথবা যুদ্ধের ময়দানেও কোন কাফের যদি তওবা করে আল্লাহ তা গ্রহণ করবেন।
তৃতীয়ত : ক্ষমা ও শাস্তির সিদ্ধান্ত শুধু আল্লাহর জন্যে নির্ধারিত। আল্লাহর প্রিয় বান্দা বা আওলিয়ারাও আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো জন্যে ক্ষমা বা মুক্তির সুপারিশ করার অধিকার রাখেন না।
চতুর্থত : খোদায়ী শাস্তির উৎস হলো,মানুষের নিজেদের জুলুম,কুফরী ও অকৃতজ্ঞতা।
সূরা আলে ইমরানের ১৩০ ও ১৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُضَاعَفَةً وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (১৩০) وَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ ((১৩১
"হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ গ্রহণ করবে না এবং আল্লাহকে ভয় কর,যাতে তোমরা সফল হও।" (৩:১৩০)
"আর সেই আগুনকে ভয় কর,যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।"(৩:১৩১)
এই দুই আয়াতের ব্যাখ্যা হলো,ইসলাম ধর্মে যুদ্ধ বা জিহাদ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয় থেকে আলাদা নয়। আর এ জন্যেই ওহুদ যুদ্ধ সম্পর্কিত আয়াতের মধ্যে সুদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মানব জাতির জন্য সুদ একটি বৃহত্তর সংকট। কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে সুদকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই দুই আয়াতের প্রথমে মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে- সুদ খাওয়া ঈমানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তোমরা তাকওয়া সম্পন্ন বা খোদাভীরু হবার চেষ্টা কর। আর যদি খোদাভীরু হতে চাও,তবে সুদ তোমাদের জন্য উপযোগী নয়। দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে,সফল হতে হলে সুদ থেকে দূরে থাক। অর্থাৎ ইহকালীন ও পরকালীন সৌভাগ্য অর্জন করতে চাইলে সুদ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। সুদের বিভিন্ন ধরন রয়েছে এবং সব ধরনের সুদের ব্যাপারে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। তবে এ আয়াতে পুঁজি খাটিয়ে তা থেকে অতিরিক্ত লাভ বা অত্যধিক পাবার আকাঙ্ক্ষাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ,এর ফলে সমাজের মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষের কাছে সম্পদের পাহাড় গড়ে ওঠে। অন্যদিকে সমাজের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র বা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। যে বিপ্লবী সমাজ বা শ্রেণী শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে চায়,তাদেরকে ত্যাগী ও দানশীল হতে হবে। কৃপণ বা অর্থ পূজারী হওয়া তাদের জন্য মোটেই শোভনীয় নয়।
এবারে এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : শুধু যুদ্ধ বা ইবাদতের ব্যাপারে খোদাভীরু হলে চলবে না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তাকওয়া বা খোদাভীতি জরুরী।
দ্বিতীয়ত : অর্থনীতির সুস্থতা ঈমান,খোদাভীতি,এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুসরণের ওপর নির্ভর করে।
তৃতীয়ত : মুক্তি ও সৌভাগ্য ধন-সম্পদের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। বরং মানুষের অধিকার পালনের মাধ্যমে সৌভাগ্য অর্জিত হয়।
চতুর্থত : সুদ গ্রহণ এক ধরনের কুফরী ও অকৃতজ্ঞতা। মুসলমান সুদখোরদেরকেও কাফেরদের মত দোযখের শাস্তি পেতে হবে।