সূরা আলে ইমরান;(১৮তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আলে ইমরান;(১৮তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 15:10:11 2-10-1403

সূরা আলে ইমরান;আয়াত ৯৫-৯৯

সূরা আলে ইমরানের ৯৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


قُلْ صَدَقَ اللَّهُ فَاتَّبِعُوا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ (৯৫)


"হে নবী,আহলে কিতাবদের প্রতি আপনি বলুন,এখন এটা প্রমাণিত হলো যে,আল্লাহ সত্য বলেছেন,সুতরাং তোমরা ইব্রাহীমের সুদৃঢ় ধর্ম গ্রহণ কর,ইব্রাহীম অংশবাদী বা মুশরিক ছিল না।" (৩:৯৫)

পূর্ববর্তী আয়াতে বলা হয়েছিল- ইহুদিরা নিজেদের পক্ষ থেকে কোন কোন খাবারকে হারাম ঘোষণা করে এবং আল্লাহই সেসব খাবার অবৈধ করেছেন বলে দাবি করে। এজন্যে ইসলামের নবী তাদেরকে ঐসব খাবার হারাম হবার ব্যাপারে তাওরাত থেকে প্রমাণ দেখাতে বলেন। আর এই আয়াতে ইহুদিদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলছেন,তোমরা যদি ইবরাহিমের ধর্ম মানার দাবি করে থাক,তাহলে বাস্তবেও ইবরাহীমের মত সত্য-সন্ধানী এবং সত্যের অনুসারী হও। আর কোরআনের বিধানই হল সত্য,নিজেদের খেয়ালিপনা অথবা পূর্বপুরুষদের প্রথা কিংবা কুসংস্কারের অনুসরণ আল্লাহর সাথে শিরকের সমান ।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : সত্যকে খোঁজা এবং সত্যের প্রতি ভালোবাসা ও সমর্থন মহাপুরুষদের সবচেয়ে বড় গুণ । আমাদেরও উচিত মহৎ লোকদের এই আদর্শ অনুসরণ করা।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর আইনের পাশাপাশি অন্য কোন আইন বা প্রথা মেনে চলার অর্থ হলো আইন-প্রণয়নের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শিরক করা ।

সূরা আলে ইমরানের ৯৬ ও ৯৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-


إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِلْعَالَمِينَ (৯৬) فِيهِ آَيَاتٌ بَيِّنَاتٌ مَقَامُ إِبْرَاهِيمَ وَمَنْ دَخَلَهُ كَانَ آَمِنًا وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ (৯৭)

"মক্কাতেই মানবজাতির জন্য সর্ব প্রথম ঘর তৈরি হয়েছিল। ঐ ঘর বিশ্ববাসীদের জন্য হেদায়াত ও বরকতের উৎস।" (৩:৯৬)
"আর তাতে অনেক স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে। যেমন মাকামে ইব্রাহীম বা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর স্থান এবং যারাই এ ঘরের মধ্যে আশ্রয় নেয় তারাই নিরাপদ। আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ ঘরের হজ্ব সমাপন করা তাদের অবশ্যই কর্তব্য। যারা সেখানে যাবার সামর্থ রাখে এবং যদি কেউ অবিশ্বাস করে অর্থাৎ সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হজ্ব না করে তাহলে সে জেনে রাখুক আল্লাহ বিশ্বজগতের কোন কিছুরই মুখাপেক্ষী নন।" (৩:৯৭)

মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদের অন্যতম অভিযোগ ছিল- হযরত ইসা (আঃ)র জন্মের প্রায় এক হাজার বছর আগে হযরত সোলায়মান (আঃ) বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ নির্মাণ করার পরও মুসলমানরা কেন কাবা ঘরকে তাদের কেবলা হিসেবে স্থির করেছে? তাদের মতে,কাবা ঘরের বয়স খুব বেশী নয়। পবিত্র কোরআন এর জবাবে বলছে,কাবাঘরই হচ্ছে প্রথম ঘর যা মানুষের ইবাদতের জন্যে নির্মিত হয়েছে এবং যে কোন মসজিদ বা উপাসনালয়ের চেয়ে কাবা ঘর বেশি প্রাচীন। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী,প্রথম মানব হযরত আদম (আঃ)-ই কাবা ঘরের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সমস্ত নবীই এই ঘর যিয়ারত করেছেন। পরবর্তীকালে হযরত ইবরাহীম (আঃ) কাবা ঘর পুনর্নিমাণ করেন এবং এই ঘর যিয়ারতের বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়। কাবাঘর আল্লাহর ক্ষমতার অন্যতম নিদর্শন। মুসলমানরা কাবাঘরের দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রতিদিন ৫ বার নামাজ পড়া ছাড়াও প্রতি বছর কাবাঘরে সমবেত হয়। যেসব মুসলমানের আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ রয়েছে,তারা জীবনে অন্তত একবার মুসলমানদের এই বার্ষিক হজ্ব সম্মেলনে অংশ নেয়। কাবাঘরের দেয়াল উঁচু করার সময় হযরত ইবরাহীম (আঃ) একটা বড় পাথরের ওপর দাঁড়াতেন। তাই ইব্রাহীম (আঃ) র স্মৃতিবাহী এই পাথরকেও মানুষ পরম শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং এটিই 'মাকামে ইব্রাহীম' নামে পরিচিত। হযরত মুসা (আঃ)'র জন্মের কয়েকশ' বছর আগে কাবাঘর পুনর্নিমিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কয়েকশ' বছরের বন্যা ও বিভিন্ন পরিবর্তনের পরও ঐ পাথরটি অক্ষত থেকে আল্লাহর নিদর্শনে পরিণত হয়েছে। কাবাঘর যিয়ারতকারীদের জন্য এটা একটা শিক্ষণীয় দিক। অন্যদিকে মক্কা ও কাবাঘর আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষিত নিরাপদ স্থান। এখানে জীবন্ত কোন কিছুর প্রাণ হরণ নিষিদ্ধ,তা লতা-পাতা,পাখী,মশা ও মাছি যাই হোক না কেন। এমনকি কোন অপরাধীও যদি কাবাঘরে প্রবেশ করে তাহলেও এর প্রতিবাদ করা যাবে না। তবে তার জন্য এমন ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে,যাতে সে নিজেই কাবাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : বর্তমান যুগে জাতিসমূহের প্রতিনিধি সমাবেশের জন্য জাতিসংঘ বা রাষ্ট্র সংঘ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ মানব সৃষ্টির সূচনা লগ্নেই মানবজাতির ঘর হিসেবে কাবা ঘর প্রতিষ্ঠা করেছেন। এইঘর বিভিন্ন জাতির প্রতিনিধিদের মিলনের স্থান এবং এবাদতের কেন্দ্র।
দ্বিতীয়ত : সামর্থের চেয়ে বেশি ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। কারণ মহান আল্লাহ আর্থিক ও শারীরিক ক্ষমতা অনুযায়ী ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন।
তৃতীয়ত : আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা আমাদের নিজেদের জন্যেই কল্যাণকর । আল্লাহ আমাদের সৎকাজ বা ইবাদত বন্দেগীর কারণে উপকৃত হন না বলে তিনি সেসবের মুখাপেক্ষী নন। যেমনটি আল্লাহ আমাদের অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল নন।

সূরা আলে ইমরানের ৯৮ ও ৯৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-


قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَكْفُرُونَ بِآَيَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ شَهِيدٌ عَلَى مَا تَعْمَلُونَ (৯৮) قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ مَنْ آَمَنَ تَبْغُونَهَا عِوَجًا وَأَنْتُمْ شُهَدَاءُ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ (৯৯)

"হে নবী! আপনি বলুন- হে আহলে কিতাব,তোমরা কেন আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে বিশ্বাস বা অস্বীকার করছো? অথচ তোমরা যা করছো,আল্লাহ তার সাক্ষী।" (৩:৯৮)
"এবং আপনি তাদেরকে বলুন,হে আহলে কিতাব,যারা বিশ্বাস করেছে অর্থাৎ ঈমান এনেছে,তাদেরকে কেন আল্লাহর পথ ও সরল পথ থেকে বিচ্যুত করছ? অথচ তোমরা নিজেরাই জান যে এটাই সত্যের পথ। জেনে রাখ,তোমরা যা করছ,আল্লাহ সে সম্পর্কে অজ্ঞ নন।" (৩:৯৯)

ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরব দেশে ঐশী ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যাই ছিল বেশি। ইহুদিরা ইনজিল ও তাওরাত গ্রন্থের সুসংবাদ অনুযায়ী শেষ নবীর আগমনের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মহানবী (সাঃ) যখন মদীনায় এলেন,তখন অধিকাংশ ইহুদিই মহানবী ও পবিত্র কোরআনের ওপর ঈমান আনার পরিবর্তে মুসলমানদের শত্রুদের সাথে সংঘবদ্ধ হয় এবং অন্যদেরকেও ঈমান আনার পথে বাধা দিতে থাকে। ইহুদিরা গোপনে ইসলাম ধর্মকে বিকৃতভাবে প্রচার করতো,যাতে কেউ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট না হয় এবং মহানবী (সাঃ)র ওপর ঈমান না আনে।
আল্লাহ এ আয়াতে মহানবী (সাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলেন,হে নবী! আপনি ইহুদিদেরকে বলুন,তোমরা কি জানো যে,আল্লাহ তোমাদের গোপন তৎপরতা সম্পর্কে জানেন এবং কখনোই তোমাদের ব্যাপারে অনবহিত বা অচেতন নন। তাই কেন আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করছ? এবং কেন মুমিনদেরকে সরল পথ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা চালাচ্ছো ?

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : আমরা যদি আল্লাহকে নিজের তৎপরতার সাক্ষী বলে বিশ্বাস করি,তাহলে অনেক খারাপ কাজ থেকেই বিরত থাকতে পারবো। আল্লাহ সবকিছু দেখছেন এ বিশ্বাস মানুষকে অধিকাংশ পাপ থেকে রক্ষা করার শ্রেষ্ঠ উপায় ।
দ্বিতীয়ত : ইসলাম ধর্মের অধিকাংশ শত্রুই এর সত্যতা এবং নিজেদের বিভ্রান্তি সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। কারণ,তারা দুনিয়ার স্বার্থকে অন্যসব কিছুর ওপর প্রাধান্য দেয়।