সূরা আলে ইমরান; আয়াত ৭২-৭৬
সূরা আলে ইমরানের ৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَقَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ آَمِنُوا بِالَّذِي أُنْزِلَ عَلَى الَّذِينَ آَمَنُوا وَجْهَ النَّهَارِ وَاكْفُرُوا آَخِرَهُ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
"আহলে কিতাবদের মধ্যে একদল বলে যে,বিশ্বাসীদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে দিনের শুরুতে তা বিশ্বাস কর ও দিনের শেষে অবিশ্বাস কর। তাহলে তারা হয়তো ইসলাম থেকে ফিরে যাবে।" (৩:৭২)
গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম,অবিশ্বাসীরা মুসলমানদের ঈমান দুর্বল করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল। আর ঐসব ষড়যন্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ কৌশল ছিল,সত্যের সাথে মিথ্যাকে মিশিয়ে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করা। এই আয়াতে শত্রুদের এ ধরনের আরো একটি ষড়যন্ত্রের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে,অবিশ্বাসীদের নেতৃবৃন্দ তাদের অনুসারীকে বাহ্যিকভাবে মুসলমান সাজার নির্দেশ দিয়েছিল,যাতে মুসলমানদের মধ্যে তারা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। আর এ ষড়যন্ত্র অনুযায়ী ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কিছুকাল পরে তারা এই ধর্ম ত্যাগ করবে। তারা মুসলমানদেরকে বলবে যে,আমরা ভুল করেছি আর তোমাদের ধর্মের চেয়ে আমাদের ধর্মই উত্তম এবং এ জন্যে আমরা আগের ধর্মেই ফিরে গেলাম। এটা স্পষ্ট যে,এ ধরনের তৎপরতায় মুসলমানদের ঈমান দুর্বল হয়ে পড়তো এবং নিজ ধর্মের সত্যতার ব্যাপারে তারা সন্দিহান হয়ে পড়তো,অন্যান্য কাফেররাও এর ফলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কোন যুক্তি খুঁজে পেত না।
এই আয়তের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : মুসলমানদের সরল বিশ্বাসী ও সরলমনা হওয়া উচিত নয়। বরং কপট বিশ্বাসীদের সম্পর্কে তাদের সব সময় সাবধান হওয়া উচিত।
দ্বিতীয়ত : শত্রুরা চায় মুসলমানরা তাদের ধর্ম ত্যাগ করুক এবং এ জন্য তারা সব সময়ই ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তাই শত্রুদের সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র মোকাবেলার জন্য মুসলমানদেরকে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে।
সূরা আলে ইমরানের ৭৩ ও ৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلَا تُؤْمِنُوا إِلَّا لِمَنْ تَبِعَ دِينَكُمْ قُلْ إِنَّ الْهُدَى هُدَى اللَّهِ أَنْ يُؤْتَى أَحَدٌ مِثْلَ مَا أُوتِيتُمْ أَوْ يُحَاجُّوكُمْ عِنْدَ رَبِّكُمْ قُلْ إِنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (৭৩) يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ ((৭৪
"বিভ্রান্ত আহলে কিতাব নেতৃবৃন্দ তাদের অনুসারীকে বলত: নিজস্ব ধর্মের অনুসারী ছাড়া কাউকেও বিশ্বাস করো না এবং তোমাদের যা দেয়া হয়েছে,অন্য কাউকেও সে রকম কিছু দেয়া হয়েছে এমনটিও বিশ্বাস করো না। হে নবী আপনি বলুন আল্লাহর পথই সুপথ,যা আপনাকে দেয়া হয়েছে,তদ্রুপ অন্যকেও দেয়া হতে পারে । এটা কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা বংশের একচেটিয়া অধিকার নয়। অথবা যদি তারা আপনার প্রতিপালক সম্পর্কে আপনার সাথে ঝগড়া করে,তবে আপনি বলুন,গৌরব আল্লাহরই হাতে।" (৩:৭৩)
"তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন এবং আল্লাহ প্রশস্ত ও মহান দাতা।" (৩:৭৪)
পূর্ববর্তী আয়াতে আমরা আলোচনা করেছিলাম ইহুদী নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের ঈমান দুর্বল করার জন্য প্রথমে ইসলামের নবীর প্রতি ঈমান এনে পরে আবার বিশ্বাসী হবার ষড়যন্ত্র এটেছিল। এ দুই আয়াতে তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে যে,তারা একে অপরকে বলতো এই ষড়যন্ত্র যেন সম্পূর্ণ গোপন থাকে এবং ইহুদীরা ছাড়া অন্য কেউ এমনকি মুশরিকরাও যেন তা না জানতে পারে। কারণ,এর ফলে ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়ে তাদের বলেছেন পথ প্রদর্শন বা মুক্তি দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। সুপথ বা সত্যধর্ম কোন বংশের একচেটিয়া সম্পদ নয়। তাই এসব ষড়যন্ত্র ঐশী হেদায়াত বা পথ প্রদর্শনের ওপর কোন প্রভাব ফেলবে না। তাই সত্য ধর্মের বিরুদ্ধে অযথা ষড়যন্ত্র ও নেতিবাচক তৎপরতা চালানো পণ্ডশ্রম মাত্র। আয়াতের পরবর্তী অংশে ইহুদী নেতৃবৃন্দের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে । তারা বলত ইহুদীদের কাছে যেরকম ঐশী গ্রন্থ এসেছে সেরকম ঐশী গ্রন্থ আর কোন জাতির কাছে আসবে না। বিচার দিবসে আল্লাহর সামনে ইহুদীদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে কেউ জয়ী হতে পারবে না। ইহুদীরাই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। একমাত্র ইহুদীরাই নবী বা নবুওত পেয়েছে এবং জ্ঞানের দিক থেকে তারাই শ্রেষ্ঠ। ইহুদীদের এসব ভিত্তিহীন দাবির জবাবে আল্লাহ বলছেন,আল্লাহর সমস্ত অনুগ্রহ ও নেয়ামত,নবুওত থেকে শুরু করে যুক্তি তর্কের শক্তি এসবই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দান করেন। অর্থাৎ আল্লাহ যাদেরকেই যোগ্য মনে করেন,তাদেরকে এসব সম্পদ দান করেন। কারণ,কারা অনুগ্রহ পাবার যোগ্য তা আল্লাহই ভালো জানেন। তাই অহেতুক হিংসা করা এবং আল্লাহকে একমাত্র নিজেদের অধিকারভুক্ত মনে করা ঠিক নয়।
এই দুই আয়াতে শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা বংশের একচেটিয়া অধিকার নয়। যারাই আল্লাহর অনুগ্রহ চায় এবং যাদের যোগ্যতা আছে তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ ও মুক্তি পাবে।
দ্বিতীয়ত : ঐশী গ্রন্থের নেতৃবৃন্দ ইসলাম ধর্মের প্রতি তাদের অনুসারীর ক্রমবর্ধমান আগ্রহে আতঙ্কিত। আর তারা সব সময়ই বিভিন্ন কর্মসূচি ও পরিকল্পনা তৈরী করছে।
সূরা আলে ইমরানের ৭৫ ও ৭৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَمِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مَنْ إِنْ تَأْمَنْهُ بِقِنْطَارٍ يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَنْ إِنْ تَأْمَنْهُ بِدِينَارٍ لَا يُؤَدِّهِ إِلَيْكَ إِلَّا مَا دُمْتَ عَلَيْهِ قَائِمًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الْأُمِّيِّينَ سَبِيلٌ وَيَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُمْ يَعْلَمُونَ (৭৫) بَلَى مَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ وَاتَّقَى فَإِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ (৭৬)
"আহলে কিতাবদের মধ্যে এমন লোক আছে,যার কাছে ধনরাশি আমানত রাখলে সে তোমাকে তা ফেরত দেবে এবং তাদের মধ্যে এমন লোকও আছে যার কাছে এক দিনার আমানত রাখলেও সে তোমাকে তা ফিরিয়ে দেবে না,যে পর্যন্ত তুমি তার পিছে লেগে না থাক। কারণ,তারা বলে যারা আমাদের ধর্মের অনুসারী নয়,তাদের সাথে আমরা যে আচরণই করি না কেন তাতে পাপ নেই। আসলে তারা জেনে শুনে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলে।" (৩:৭৫)
"কেউ নিজ অঙ্গীকার পূর্ণ করলে ও সংযত হলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের অর্থাৎ খোদা-ভীরুদের ভালবাসেন।" (৩:৭৬)
এই দুই আয়াতে বিরোধীদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার বজায় রাখতে মুসলমানদের উপদেশ বা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদী ও খ্রিস্টানদের মধ্যেও সৎ ও বিশ্বস্ত মানুষ পাওয়া যায় এবং তাদের কাছে কোন কিছু আমানত রাখলে তারা তা ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু আধিপত্যবাদী ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে অনেক ইহুদী মনে করতো অইহুদীদের সম্পদের কোন মর্যাদা নেই এবং ইহুদীরা অন্য ধর্মের অনুসারীদের সম্পদ বা অর্থ আত্মসাতের অধিকার রাখে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- এ ভুল দৃষ্টিভঙ্গীকে তারা ধর্মীয় রং দিয়েছিল এবং তারা বলত আল্লাহই তাদেরকে অইহুদীদের সম্পদ দখলের অনুমতি দিয়েছেন। এই দুই আয়াতের মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ আরো বলছেন মুসলমানরা যেন তাদের অধিকার আদায়ের জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি না করে,বরং তারা যেন দখলদারদের কাছ থেকে নিজেদের অধিকার ও সম্পদ ফিরিয়ে আনতে সংগ্রাম করে ও শক্তি প্রয়োগ করে। বর্তমানেও বর্ণবাদী ইহুদীরা ফিলিস্তিন দখল করে সেখানে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। অবৈধ এই দেশটি বিশ্বের কোন নিয়ম নীতি ও মানবিক রীতি মেনে চলে না এবং প্রতিদিনই মুসলিম দেশগুলোর নতুন ভূমি দখলের চেষ্টা করছে এই বিষাক্ত ক্যান্সার ইসরাইল। তাই মুসলমানদের উচিত ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ও মুসলমানদের ভূমি ছেড়ে দিতে ইসরাইলকে বাধ্য করা। সম্প্রতি মুসলমানদের প্রতিরোধের কাছে হার মেনে ইহুদীবাদী ইসরাইল ১৮ বছর পর দক্ষিণ লেবানন থেকে জবর দখল উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : শত্রুদের সাথেও অন্যায় আচরণ করা যাবে না ও তাদের সবাইকে বিশ্বাসঘাতক মনে করা উচিত নয়।
দ্বিতীয়ত : আমানত রক্ষা করা সব সময়ই ভালো কাজ। শত্রুর কাছ থেকে নেয়া আমানতও রক্ষা করতে হবে এবং এক্ষেত্রেও বিশ্বাস ভঙ্গ করা সব সময়ই নিন্দনীয়।
তৃতীয়ত : অপরাধ বা পাপ করার চেয়ে পাপের পক্ষে যুক্তি দেখানো আরো বড় অপরাধ। ইহুদীরা অন্যায়ভাবে জনগণের সম্পত্তি আত্মসাৎ করতো এবং এই নিকৃষ্ট কাজ আল্লাহর নির্দেশেই করেছে বলে প্রচার করতো।
চতুর্থত : ব্যক্তি ও সামাজিক চুক্তি মেনে চলা এবং আমানত রক্ষা করা খোদাভীতির পরিচয় বহন করে। আল্লাহ আমানত ও ওয়াদা রক্ষাকারীদের ভালোবাসেন।