সূরা আলে ইমরান;আয়াত ৯০-৯৪
সূরা আলে ইমরানের ৯০ এবং ৯১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بَعْدَ إِيمَانِهِمْ ثُمَّ ازْدَادُوا كُفْرًا لَنْ تُقْبَلَ تَوْبَتُهُمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الضَّالُّونَ (৯০) إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْ أَحَدِهِمْ مِلْءُ الْأَرْضِ ذَهَبًا وَلَوِ افْتَدَى بِهِ أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ وَمَا لَهُمْ مِنْ نَاصِرِينَ (৯১)
"নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপনের পর অবিশ্বাসী হয়েছে,তারপর অবিশ্বাস বৃদ্ধি করেছে,তাদের ক্ষমা প্রার্থনা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং তারাই বিভ্রান্ত।" (৩:৯০)
"নিশ্চয়ই যারা তওবা করা ছাড়া অবিশ্বাসী অবস্থায় মারা গেছে,তাদের পক্ষ থেকে পৃথিবী ভরা স্বর্ণ বিনিময় হিসেবে দেয়া হলেও তা নেয়া হবে না। ওদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে এবং ওদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না।" (৩:৯১)
মানুষ তার পথ নির্বাচনের ব্যাপারে স্বাধীন। তারা বিশ্বাস ও কুফুরী বা অবিশ্বাসের মধ্যে যে কোন পথ বেছে নিতে পারে। কোন কোন মানুষ তাদের পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুসরণ করতে গিয়ে অথবা খেয়ালীপনার বশে কিংবা পরিবেশের চাপে পড়ে ঈমান আনে। কিন্তু তাদের ঈমান সঠিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় বলে তারা খুব সহজেই ঈমান হারিয়ে ফেলে পুনরায় অবাধ্যতা বা কুফরিতে লিপ্ত হয়। এমনকি কুফরির ক্ষেত্রে তারা অন্যান্য কাফেরদের চেয়েও অগ্রণী হয়। এইসব মানুষ বিভ্রান্তির এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে,তারা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সুপথে ফিরে আসার কোন উপায় খুঁজে পায় না। মৃত্যুর ভয় অথবা মুসলমানদের বিজয় ছাড়া অন্য কিছুই তাদেরকে অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী করে না। আর এটা স্বাভাবিক যে ভয় পেয়ে অথবা জীবন রক্ষার খাতিরে ক্ষমা চাওয়ার কোন মূল্য নেই এবং এ ধরনের ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ করা হবে না। কারণ মনের দিক থেকে অনুতপ্ত হওয়া ছাড়া ভয় অথবা মৃত্যুর মত বাহ্যিক চাপের মুখে ক্ষমা প্রার্থনাকে প্রকৃত ক্ষমা প্রার্থনা বলা যায় না। তাই শুধু মৌখিক ক্ষমা প্রার্থনা তো দূরের কথা,ধন-সম্পদ দিয়েও কিয়ামতের দিন ধর্ম-ত্যাগীরা আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না। কোন সাহায্যকারী বা বন্ধুও তাদেরকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাতে পারবে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : ঈমানের চেয়ে ঈমান রক্ষা করা ও বজায় রাখাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঈমান থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীতে বহু মানুষ কাফের হয়েছে।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহ তওবা বা ক্ষমা গ্রহণ করেন। কিন্তু কেউ কেউ অবাধ্যতা ও কুফরির ওপর অটল থেকে তওবার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়।
তৃতীয়ত : আমরা আমাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে যেন সন্তুষ্ট না থাকি। কারণ যেকোন মুমিন কাফের হয়ে মারা যাবার বিপদে পড়তে পারেন।
সূরা আলে ইমরানের ৯২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (৯২)
"তোমরা যা ভালোবাসো তা থেকে ব্যয় না করা পর্যন্ত কখনও পূণ্যলাভ করতে পারবে না । তোমরা যা কিছু ব্যয় কর আল্লাহ তা জানেন।" (৩:৯২)
আরবীতে ‘বের'শব্দটির অর্থ সব ধরনের পূণ্য বা সৎকাজ। সৎ চিন্তাও এর অন্তর্ভূক্ত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস,নামাজ,জিহাদ ও অঙ্গীকার পূর্ণ করার ক্ষেত্রেও ‘বের' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এই আয়াতে ‘বের' বা সৎকাজের অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে আল্লাহর পথে নিজের প্রিয় জিনিস দান করার কথা বলা হয়েছে । মানুষ যা নিজে ভালোবাসেন বা যে জিনিস মানুষের দরকার নেই তা মানুষকে দান করলে পূণ্য হবে না। খাতুনে জান্নাত,নবী নন্দীনী ফাতেমা (সাঃ)'র বিয়ের রাতে এক অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি তাঁর কাছে একটি পুরনো জামা চাইলে তিনি তাঁর নতুন বিয়ের পোশাকই অভাবগ্রস্তকে দান করেন। এ থেকে বোঝা যায় দরিদ্র ব্যক্তিরা তীব্র অভাবের কারণে খুব তুচ্ছ জিনিস পেয়েও খুশী হতে পারে,কিন্ত তাদেরকে এমন জিনিসই দেয়া উচিত,যা আমরা নিজেদের জন্যেও ভালোবাসি। অবশ্য এনফাক বা দান শব্দের অর্থও ব্যাপক । যেকোন ধরনের দান,খয়রাত,সুদ বিহীন ঋণ,ওয়াকফ ও নাজর এনফাকের কিছু দৃষ্টান্ত ।
এবারে এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো একে একে তুলে ধরছি-
প্রথমত: ইসলামের দৃষ্টিতে শুধু নামাজ ও ইবাদতই পূণ্য কাজ নয়। অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করা এবং সমাজের অর্থনৈতিক শূন্যতা পূরণও মুমিনের কর্তব্য ।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহ আমাদের দানকে লক্ষ্য করছেন। তাই সবচেয়ে ভালো কিছুই দান করা উচিত এবং দানের পরিমাণ ও বৈচিত্রের ক্ষেত্রে কার্পণ্য করা উচিত নয়।
তৃতীয়ত : ‘বের'বা পূণ্য কাজের মধ্যে আল্লাহর পথে শাহাদতের মর্যাদা সবচেয়ে বেশী । কারণ মানুষের সবচেয়ে প্রিয় পুঁজি হলো জীবন বা প্রাণ ।
চতুর্থত : এনফাক বা দানের ক্ষেত্রে পরিমাণের চেয়ে গুণগত মান বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাই পরিমাণে কম হলেও ভালো জিনিস দান করা উচিত ।
পঞ্চমত : ইসলামের দানের উদ্দেশ্য শুধু ক্ষুধার্তের ক্ষুধা মেটানো নয়। দাতার উন্নয়নও এর অন্যতম উদ্দেশ্য । প্রিয়বস্তুর প্রতি অন্তরের মায়ার বাঁধন ছিন্ন করা দানশীলতার মনোভাবকে বৃদ্ধি করে এবং এরফলে ত্যাগের চেতনাও বৃদ্ধি পায়।
সূরা আলে ইমরানের ৯৩ ও ৯৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
كُلُّ الطَّعَامِ كَانَ حِلًّا لِبَنِي إِسْرَائِيلَ إِلَّا مَا حَرَّمَ إِسْرَائِيلُ عَلَى نَفْسِهِ مِنْ قَبْلِ أَنْ تُنَزَّلَ التَّوْرَاةُ قُلْ فَأْتُوا بِالتَّوْرَاةِ فَاتْلُوهَا إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ ( (৯৩فَمَنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ (৯৪)
"তাওরাত অবতীর্ণ হবার আগে,হযরত ইয়াকুব (আঃ) তথা বনী ইসরাইলীরা নিজেদের জন্যে যা অবৈধ করেছিল তা ছাড়া সব ধরনের খাবার ইসরাইলের বংশধরদের জন্য হালাল ছিল। হে নবী,আপনি মদীনার ইহুদীদের বলুন যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তবে তাওরাত এনে পড়ে দেখ।" (৩:৯৩)
"এরপরও যারা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলবে তারাই অত্যাচারী বা সীমা লংঘনকারী।" (৩:৯৪)
মদীনার ইহুদিরা ইসলামের নবীর কাছে যেসব আপত্তি তুলে ধরেছিল তার মধ্যে অন্যতম আপত্তি ছিল ইসলামের শরিয়ত বা আইন হযরত ঈসা ( আঃ ) ও মূসা (আঃ)'র শরিয়তের বিরোধী। উদাহরণ হিসেবে তারা বলতো পূর্ববর্তী নবীদের শরিয়ত বা বিধানে উটের গোশত ও দুধ খাওয়া হারাম ছিল,অথচ ইসলাম ধর্মের বিধানে তা হালাল। এ আয়াতে ইহুদীদের এই আপত্তির জবাবে বলা হয়েছে মূসা নবীর যুগেও উটের দুধ ও গোশত হালাল ছিল। শুধু হযরত ইয়াকুব (আঃ) শারীরিক সমস্যার কারণে উটের দুধ ও গোশত খেতেন না। কিন্তু ইহুদীরা ইয়াকুব নবীর এই ব্যক্তিগত অভ্যাসকে শরীয়তের বিধান বলে ভুল ধারণা করে। আসলে এটা ছিল ইয়াকুব (আঃ)'র ব্যক্তিগত পদক্ষেপ।আল্লাহর বিধানের সাথে এর কোন সম্পর্ক ছিল না। এই আয়াতে ইহুদীদের উদ্দেশ্যে আরও বলা হয়েছে,মূসা নবীর শরীয়ত বা আইনের উৎস হলো তাওরাত,তোমাদের শোনা কথা ও বক্তব্য নয় । যদি তাওরাতে কোন কিছু হারাম বা অবৈধ বলে উল্লেখ করা হয়,সেটাই হারাম। তাওরাত কিতাবে যা অবৈধ নয় তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবৈধ বলার অধিকার কারো নেই ।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,
প্রথমত : আল্লাহ যা হালাল করেছেন,তাকে হারাম করা যাবে না এবং আল্লাহ যা হারাম করেছেন তাকেও হালাল করা যাবে না। ধর্মে যাকে হালাল বা হারাম করা হয়েছে শুধু তাই নির্ভরযোগ্য। মানুষের কথা ও কোন সমাজের প্রথা এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয় ।
দ্বিতীয়ত : কোন খাদ্য-দ্রব্যের হালাল হবার ব্যাপারে যুক্তি দেখাতে হবে। নতুন খাদ্য-দ্রব্য,হালাল-হারামের ব্যাপারে এটাই মূলনীতি।
তৃতীয়ত : নিজের ব্যক্তিগত চিন্তাধারাকে ধর্মের বিধান বলে চালিয়ে দেয়া ধর্ম,ধর্মীয় নেতা,আল্লাহ ও জনগণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অপরাধ।