সূরা আন নিসা; আয়াত ১০০-১০৩
সূরা নিসার ১০০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَمَنْ يُهَاجِرْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يَجِدْ فِي الْأَرْضِ مُرَاغَمًا كَثِيرًا وَسَعَةً وَمَنْ يَخْرُجْ مِنْ بَيْتِهِ مُهَاجِرًا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَحِيمًا ((১০০
"যে কেউ আল্লাহর পথে দেশ ত্যাগ করে,সে এর বিনিময়ে প্রশস্ত স্থান ও সচ্ছলতা পাবে৷ এছাড়া কেউ যদি আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করে এবং পথে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তবে তার প্রতিদান আল্লাহর ওপর ন্যস্ত আছে৷ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময় ৷" (৪:১০০)
এর আগের পর্বে আমরা বলেছি, ঈমানদার মুসলমানরা তাদের শহর ও দেশের প্রতি অন্ধ অনুরক্ত নন৷ তাদের কাছে দেশ প্রেমের চেয়ে খোদাপ্রেম অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ৷ সুতরাং কারো যদি তার শহরে নিজের ধর্ম রক্ষা ও মেনে চলতে অসুবিধা হয়, তাহলে তাকে হিজরত করতে হবে৷ কিন্তু এই আয়াতে বলা হচ্ছে, তোমরা ভেবো না যে পৃথিবী শুধু তোমার শহর ও দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বরং আল্লাহর পৃথিবী অনেক বড় এবং যে কেউ ধর্ম রক্ষার জন্য হিজরত করলে নিশ্চিতভাবে ধর্মের জন্য কাজ করা তার পক্ষে সহজ হবে এবং কাজের সুযোগও বৃদ্ধি পাবে৷ এছাড়া পৃথিবীতেও সে আরো ব্যাপক সুযোগ সুবিধার অধিকারী হবে৷ অন্যদিকে কেউ যদি হিজরত করতে গিয়ে পথে মৃত্যুবরণও করে, তাহলে আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করবে এবং এই মৃত্যু তার জন্য ক্ষতিকর নয়৷ এই আয়াতে হিজরত বলতে ধর্ম রক্ষার জন্য দেশত্যাগকে বোঝানো হলেও ইসলাম ধর্মে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সব ধরনের দেশ ত্যাগই হিজরতের সমতুল্য৷ উদাহরণ স্বরুপ জ্ঞান অর্জন ও ধর্ম প্রচারের জন্য দেশত্যাগও হিজরতের অন্তর্ভূক্ত৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: মানুষের কাজ হলো নিষ্ঠার সঙ্গে তার দায়িত্বগুলো পালন করা৷ এ ক্ষেত্রে সফল হবার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ অর্থাৎ মানুষকে প্রথমে হিজরতের জন্য ঘর থেকে বের হতে হবে; লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে না পারলেও অসুবিধা নেই৷
দ্বিতীয়ত: ঘরে বসে থেকে কোন ধরনের উন্নতি করা সম্ভব নয়৷ উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালাতে হবে, তৎপর হতে হবে এবং হিজরত করতে হবে ৷
তৃতীয়ত: কাজ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে এবং এমন কোন কাজ নির্বাচন করতে হবে যা সম্পন্ন করতে গিয়ে মৃত্যু ঘটলেও তা আল্লাহর পথে মৃত্যু হিসাবে বিবেচিত হবে এবং তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার রয়েছে ৷
সূরা নিসার ১০১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَإِذَا ضَرَبْتُمْ فِي الْأَرْضِ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَنْ تَقْصُرُوا مِنَ الصَّلَاةِ إِنْ خِفْتُمْ أَنْ يَفْتِنَكُمُ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنَّ الْكَافِرِينَ كَانُوا لَكُمْ عَدُوًّا مُبِينًا ((১০১
"তোমরা যখন সফর কর তখন নামায সংক্ষেপ করলে তোমাদের কোন ক্ষতি নেই; যদি তোমরা আশংকা কর যে, কাফেররা তোমাদের ক্ষতি করবে৷ নিশ্চয় কাফেররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু ৷" (৪:১০১)
এ আয়াতে জিহাদে অংশগ্রহণকারী ও সফরকারীদের নামায সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা নামায সংক্ষেপ করাকে অপরাধ বা গোনাহ মনে করতেন৷ আল্লাহ কোরআনের এই আয়াত নাযিলের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে জিহাদ ও হিজরতের সময় শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য নামায সংক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন যাতে শত্রুরা মুসলমানদের কোন ক্ষতি করার সুযোগ না পায় ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: নামাযেও শত্রুদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, উদাসীন হলে চলবে না৷ কারণ ইসলাম শুধু এবাদত সর্বস্ব ধর্ম নয় ৷ মুসলমান সৈন্যরা বিপদের মধ্যে থাকলে প্রয়োজনে নামায সংক্ষেপ করতে হবে, যাতে শত্রুরা কোন ক্ষতি করতে না পারে ৷
দ্বিতীয়ত: কোন অবস্থাতেই নামায ত্যাগ করা যায় না৷ এমনকি কঠিন বিপদের সময়ও সংক্ষেপে নামায আদায় করতে হবে ৷
সূরা নিসার ১০২ ও ১০৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَإِذَا كُنْتَ فِيهِمْ فَأَقَمْتَ لَهُمُ الصَّلَاةَ فَلْتَقُمْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا أَسْلِحَتَهُمْ فَإِذَا سَجَدُوا فَلْيَكُونُوا مِنْ وَرَائِكُمْ وَلْتَأْتِ طَائِفَةٌ أُخْرَى لَمْ يُصَلُّوا فَلْيُصَلُّوا مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا حِذْرَهُمْ وَأَسْلِحَتَهُمْ وَدَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُمْ مَيْلَةً وَاحِدَةً وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِنْ كَانَ بِكُمْ أَذًى مِنْ مَطَرٍ أَوْ كُنْتُمْ مَرْضَى أَنْ تَضَعُوا أَسْلِحَتَكُمْ وَخُذُوا حِذْرَكُمْ إِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْكَافِرِينَ عَذَابًا مُهِينًا (১০২) فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلَاةَ فَاذْكُرُوا اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِكُمْ فَإِذَا اطْمَأْنَنْتُمْ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا ((১০৩
"হে নবী! আপনি যখন তাদের সঙ্গে জিহাদে অংশ নেবেন ও তাদের সঙ্গে নামায আদায় করবেন তখন তাদের একদল যেন আপনার সঙ্গে নামাযে দাঁড়ায় ও নিজেদের অস্ত্র সঙ্গে রাখে ৷ যাদের সেজদা সম্পন্ন হলো তারা যেন সরে গিয়ে পেছনে দাঁড়ায় এবং অপর দল যারা নামাযে শরীক হয়নি, তারা নামাযে অংশ নেবে-তারা যেন সতর্ক ও সশস্ত্র থাকে৷ কাফেররা চায় তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্রের ব্যাপারে অসতর্ক থাক, যাতে তারা তোমাদের উপর হঠাৎ আক্রমণ চালাতে পারে ৷ যদি তোমরা বৃষ্টির জন্য কষ্ট পাও অথবা অসুস্থ থাক,তাহলে অস্ত্র রেখে দিলে তোমাদের জন্য কোন গোনাহ নেই, শুধুমাত্র আত্মরক্ষার অস্ত্র সঙ্গে রাখবে ৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফেরদের জন্য অবমাননাকর শাস্তি রেখেছেন ৷"(৪:১০২)
"এরপর যখন নামায শেষ করবে তখন দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে ৷ যখন তোমরা নিরাপদ হবে, তখন যথাযথভাবে নামায আদায় করবে৷ নির্ধারিত সময়ে নামায আদায় করা মুসলমানদের জন্য ফরজ ৷" (৪:১০৩)
এর আগের আয়াতে জিহাদে অংশগ্রহণকারী ও সফরকারীদের জন্য নামায সংক্ষেপ করার নির্দেশ দেবার পর এই আয়াতে জিহাদের ময়দানে জামায়াতে নামায আদায়ের পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হয়েছে ৷
এই আয়াতে বলা হয়েছে, জিহাদের ময়দানে নামায পড়ার জন্য মুসলিম সৈন্যদেরকে প্রথমে পৃথক দু'টি দলে বিভক্ত হতে হবে৷ এরপর একটি দল জামায়াতের ইমামের সাথে নামাযে দাঁড়াবে ও নিজেদের অস্ত্র সাথে রাখবে এবং প্রথম রাকাতের দ্বিতীয় সেজদা শেষ হবার পর তারা নিজেরাই ব্যক্তিগতভাবে খুব দ্রুত দ্বিতীয় রাকাত শেষ করবে৷ জিহাদে অংশগ্রহণকারীদের জন্য ফরজ নামায যেহেতু দুই রাকাতের বেশী নয়, সেহেতু প্রথম দলের নামায এখানেই শেষ হবে৷ এরপর প্রথম দল দ্রুত সরে গিয়ে দ্বিতীয় দলের স্থলাভিষিক্ত হবে, যাতে দ্বিতীয় দল দ্বিতীয় রাকাতের নামাযে অংশ নিয়ে জামায়াতে নামায পড়ার ফজিলতের অংশীদার হতে পারেন৷ এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জিহাদের ময়দানেও অবশ্যই নামায পড়তে হবে৷ আর সম্ভব হলে তখনও জামায়াতে নামায আদায় করতে হবে এবং বিশেষ ঐ পদ্ধতির কারণে সব মুজাহিদরাই জামায়াতে নামায পড়তে পারছেন৷ এছাড়াও এই আয়াতে যে কোন পরিস্থিতিতে শত্রুদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার এবং অস্ত্র সাথে রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ৷
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে,
প্রথমত: জামায়াতে নামায পড়ার গুরুত্ব এত বেশী যে, যুদ্ধের ময়দানেও এক রাকাত নামাযের মাধ্যমে হলেও তাতে অংশ নিতে বলা হয়েছে ৷
দ্বিতীয়ত: মুসলমানদেরকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে এমনকি নামাযেও শত্রুদের বিপদ সম্পর্কে উদাসীন হলে চলবে না ৷
তৃতীয়ত: নামাযের জন্য বিশেষ সময় নির্ধারণের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে সময়ানুবর্তী ও সুশৃঙ্খল হবার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে ৷