সূরা আলে ইমরান;(২২তম পর্ব)
  • শিরোনাম: সূরা আলে ইমরান;(২২তম পর্ব)
  • লেখক:
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 13:35:48 2-10-1403

সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১১৬-১২০ (পর্ব ২২)

সূরা আলে ইমরানের ১১৬ ও ১১৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَنْ تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (১১৬) مَثَلُ مَا يُنْفِقُونَ فِي هَذِهِ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَثَلِ رِيحٍ فِيهَا صِرٌّ أَصَابَتْ حَرْثَ قَوْمٍ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ فَأَهْلَكَتْهُ وَمَا ظَلَمَهُمُ اللَّهُ وَلَكِنْ أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ (১১৭)

"যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছে অর্থাৎ কাফের হয়েছে তাদের সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদ আল্লাহর মোকাবেলায় কোন কাজে আসবে না। তারা দোজখের আগুনে পুড়বে এবং সেখানে চিরস্থায়ী হবে।" (৩:১১৬)

"তারা দুনিয়ার জীবনে যা ব্যয় করে, তার দৃষ্টান্ত উত্তপ্ত বাতাসের মত যা এমন কোন সম্প্রদায়ের শস্য ক্ষেত্রে আঘাত হেনে তা ধ্বংস করে যে সম্প্রদায় নিজের ওপরই অত্যাচার করে। আল্লাহ তাদের প্রতি অত্যাচার করেনি, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছে।"(৩:১১৭)

আল্লাহকে অস্বীকার করার ব্যাপারে যেসব চিন্তাভাবনা বা অনুভূতি কাজ করে তার মধ্যে অন্যতম হলো, সম্পদ ও ক্ষমতার কারণে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা অনুভব না করা। অনেকে মনে করে, সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি থাকলে আল্লাহকে মানার কোন প্রয়োজন হয় না। এই আয়াতে এই বোকামীসুলভ ধারণা নাকচ করে দিয়ে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে সন্তান ও সম্পদ তাদেরকে রক্ষা করবে বলে ধরে নেয়া হলেও কেয়ামতের দিন তারা কী করবে? কেয়ামত বা বিচার দিবসে তাদের প্রচ্ছন্ন কুফরী দোযখের আগুনের মাধ্যমে প্রকাশিত হবে এবং আল্লাহকে অস্বীকার করার কারণে তারা জাহান্নামী হবে। ১১৭ নম্বর আয়াতে কাফেরদের কিছু ভালো কাজের পরিণামের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন তাদের দান খয়রাতের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তারা এই পথে যা ব্যয় করে, তা এমন অনুপযোগী কৃষিক্ষেত্রে বোণা বীজের মত, যেখানে তীব্র তুফান, শীত ও গরম বাতাসের কারণে কোন ফসল ফলে না। কুফরী বা খোদাদ্রোহিতা এমন এক ঝড়ের মত যা কাফেরদের সৎ কাজগুলোকেও বিনষ্ট করে দেয়। কারণ, তাদের কাজের উদ্দেশ্য মহৎ নয়। কুফরীর মাধ্যমে যারা তাদের সৎ কাজকে ধ্বংস করে, তারা নিজেরাই তাদের ওপর জুলুম করে। আল্লাহ তাদের ওপর জুলুম করেন না । আল্লাহ কারো ওপর কখনও জুলুম করেন না।

এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় দিক হলো:

প্রথমত : সন্তান-সন্ততি ও সম্পদের বড়াই করা এবং আল্লাহর প্রয়োজন অনুভব না করা কুফরী ও অকৃতজ্ঞতার নিদর্শন।

দ্বিতীয়ত : ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষুধার্তের পেট ভরিয়ে দেয়াই দান খয়রাতের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। যদি এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য হতো, তাহলে কাফের ও মুসলমানের দান খয়রাতের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকতো না। ইসলামের দৃষ্টিতে দাতার উন্নতি ও বিকাশও জরুরী। কুফরী বা খোদাদ্রোহীতা মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে অন্তরায়।

তৃতীয়ত : খোদায়ী শাস্তি ও গজব আমাদেরই কর্মফল । এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন অবিচার নয়।

সূরা আলে ইমরানের ১১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا بِطَانَةً مِنْ دُونِكُمْ لَا يَأْلُونَكُمْ خَبَالًا وَدُّوا مَا عَنِتُّمْ قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَاءُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ وَمَا تُخْفِي صُدُورُهُمْ أَكْبَرُ قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآَيَاتِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْقِلُونَ ((১১৮

"হে বিশ্বাসীগণ, তোমাদের মুমিনদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদেরকে ধ্বংস করতে চেষ্টার ত্রুটি করবে না। তোমাদেরকে কষ্ট দেয়া ও বিপদে ফেলাই তাদের একান্ত কামনা। তাদের মুখেই বিদ্বেষ ও শত্রুতা প্রকাশ পাচ্ছে, আর তাদের হৃদয়ে যা গোপন আছে তা আরো ভয়ংকর। তোমাদের জন্য নিদর্শন তথা শত্রুদের চক্রান্ত বিশদভাবে বণর্না করেছি, যদি তোমরা বুঝতে পার।" (৩:১১৮)

মুসলিম দেশগুলোর জন্য একটি বড় বিপদ হলো, রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে বিজাতীয়দের অনুপ্রবেশ এবং এর ফলে মুসলমানদের বিভিন্ন গোপন তথ্য শত্রুদের কাছে চলে যাওয়া। বিজাতীয়রা মুখে মুখে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার কথা বললেও বাস্তবে তারা মুসলমানদেরকে পছন্দ করে না এবং তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির বিরোধী। মুসলমানদেরকে দুর্বল ও ধ্বংস করার জন্য সামান্যতম সুযোগকেও তারা হাতছাড়া করতে চায় না। এমনকি কেউ কেউ ইসলামের প্রতি তাদের বিদ্বেষের কথা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : মুমিনদেরকে অদূরদর্শী ও সরল বিশ্বাসী হলে চলবে না। আমাদের বিবেককে কাজে লাগাতে হবে এবং শত্রুদের মোকাবেলায় সচেতন ও কুশলী হতে হবে।

দ্বিতীয়ত : কোন মুসলিম দেশে বিজাতীয় সেনাদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ। কারণ, এতে করে শত্রুরা মুসলিম দেশের গোপন রহস্য জেনে ফেলবে।

তৃতীয়ত : অমুসলমানদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রাখা বৈধ হলেও এটা মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম ও কুফরী শক্তি পরস্পরের বন্ধু হতে পারে না।

সূরা আলে ইমরানের ১১৯ ও ১২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

هَا أَنْتُمْ أُولَاءِ تُحِبُّونَهُمْ وَلَا يُحِبُّونَكُمْ وَتُؤْمِنُونَ بِالْكِتَابِ كُلِّهِ وَإِذَا لَقُوكُمْ قَالُوا آَمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا عَضُّوا عَلَيْكُمُ الْأَنَامِلَ مِنَ الْغَيْظِ قُلْ مُوتُوا بِغَيْظِكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ (১১৯) إِنْ تَمْسَسْكُمْ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكُمْ سَيِّئَةٌ يَفْرَحُوا بِهَا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا لَا يَضُرُّكُمْ كَيْدُهُمْ شَيْئًا إِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ ((১২০

"হে মুসলমানরা! তোমরা সতর্ক হও, তোমরা কাফেরদেরকে ভালবাস, অথচ তারা তোমাদেরকে ভালবাসেনা এবং তোমরা সমস্ত ঐশী গ্রন্থই বিশ্বাস কর, অথচ তারা তোমাদের ধর্মীয় গ্রন্থের সত্যতায় বিশ্বাস করেনা। তারা যখন তোমাদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে আমরা ঈমান এনেছি। কিন্তু যখন তারা নির্জনে আপন লোকদের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন কাফেররা তোমাদের প্রতি ক্রোধে ও আক্রোশে নিজেদের আঙ্গুল দংশন করে। হে নবী! আপনি তাদেরকে বলুন তোমরা নিজেদেরই আক্রোশে মরে যাও। নিশ্চয়ই তাদের অন্তরে যা আছে আল্লাহ তা জানেন।" (৩:১১৯)

"হে মুসলমানরা! তোমরা জেনে রাখ, তোমাদের কোনো মঙ্গল হলে তারা মর্মাহত হয়, আর যদি তোমাদের অমঙ্গল হয়,তারা হয় আনন্দিত। কিন্তু তোমরা যদি ধৈর্যশীল ও সংযমী হও, তবে তাদের চক্রান্ত তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা করে,নিশ্চয়ই তা আল্লাহর আয়ত্ত্বের অধীন।" (৩:১২০)

এই আয়াতে শত্রুদের নোংরা চিন্তাধারা ও ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়ে মুসলমানদের বলা হচ্ছে, এমনটি ভেবো না যে, তোমরা কাফেরদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে, তাদের প্রতি বন্ধুত্বের প্রকাশ ঘটালে তারাও তোমাদের সাথে শত্রুতা বন্ধ করবে এবং তোমাদের ব্যাপারে মত পরিবর্তন করবে। এমনকি তারা মুখে ঈমান আনার কথা বললেও তাদের অন্তরে রয়েছে তোমাদের প্রতি অসীম বিদ্বেষ। মুসলমানদের উন্নতি ও অগ্রগতির খবরে কাফেররা মর্মপীড়া অনুভব করে। আর মুসলমানরা কষ্ট ও সমস্যার সম্মুখীন হলে তাদের খুশীর সীমা থাকে না। তাই শত্রুদের চক্রান্তের মোকাবেলায় মুসলমানদেরকেও প্রতিরোধকামী হতে হবে এবং আল্লাহর বিধি-বিধান পালনে ধৈর্যশীল হতে হবে। ধৈর্য ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সুদৃঢ় থাকলে শত্রুদের শত চক্রান্তেও মুসলমানদের কোন ক্ষতি হবে না এবং তারা তোমাদের কোনভাবেই কষ্ট দিতে পারবে না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো,

প্রথমত : অমুসলিম দেশগুলোর সাথে মুসলিম দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে না হলে মুসলমানদের ভাগ্যে অবমাননা ও লাঞ্ছনা জুটবে।

দ্বিতীয়ত : দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় মুসলমানদের তুষ্ট হওয়া উচিত নয়।

তৃতীয়ত : শত্রুরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রোশ গোপন না রাখলে মুসলমানদেরও উচিত কঠোর ভাষায় শত্রুর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা।

চতুর্থত : খোদার ভয় না থাকলে কিংবা শত্রুদেরকে ভয় পেলে অথবা তাদের ব্যাপারে কোনরকম স্বার্থলোভী হলে শত্রুরা প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। ধৈর্য ও খোদাভীতি শত্রুদের কর্তৃত্বের পথ বন্ধ করে দেয়।