সূরা আলে ইমরান; আয়াত ৬১-৭১
সূরা আলে ইমরানের ৬৬৬ ও ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تُحَاجُّونَ فِي إِبْرَاهِيمَ وَمَا أُنْزِلَتِ التَّوْرَاةُ وَالْإِنْجِيلُ إِلَّا مِنْ بَعْدِهِ أَفَلَا تَعْقِلُونَ (৬৫) هَا أَنْتُمْ هَؤُلَاءِ حَاجَجْتُمْ فِيمَا لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ فَلِمَ تُحَاجُّونَ فِيمَا لَيْسَ لَكُمْ بِهِ عِلْمٌ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (৬৬)
"হে আহলে কিতাব ! তোমরা কেন ইব্রাহীম সম্পর্কে বিবাদ করছ? অথচ তাওরাত ও ইঞ্জীল তার পরেই নাযিল হয়েছে। তবুও কি তোমরা বোঝ না?" (৩:৬৫)
"হ্যাঁ তোমরাই তারা,যারা ঈসা সম্পর্কে জ্ঞান থাকার পরও তা নিয়ে ঝগড়া করেছ। এখন ইব্রাহীম সম্পর্কে তোমাদের জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও তা নিয়ে কেন ঝগড়া করছ ? অথচ আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।" (৩:৬৬)
বিভিন্ন ঐশী ধর্মের অনুসারীরা নিজ নিজ ধর্মের সত্যতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ঝগড়া বিবাদ করেছে। অথচ সব নবী আল্লাহর পক্ষ থেকেই মনোনীত হয়েছেন এবং তাদের কাছে অবতীর্ণ গ্রন্থগুলোর মধ্যেও মিল রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ধর্মীয় বা জাতিগত বিদ্বেষের কারণে এক শ্রেণীর কথিত ধার্মিক মানুষ যুক্তি দিয়ে মানুষকে আল্লাহর ধর্মের দিকে আহবান না জানিয়ে তুচ্ছ ও সাধারণ বিষয় নিয়ে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। যেমন,হযরত ঈসা (আ.)'র আগমনের পর তাঁর অনুসরণ করা মুসা নবীর অনুসারীদের জন্যেও জরুরী দায়িত্ব হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা অহংকার ও বিদ্বেষের কারণে তা করেনি। এমনকি তারা অর্থাৎ ইহুদীরা হযরত ইব্রাহীম (আ.)কেও নিজেদের ধর্মের অনুসারী বলে দাবী করতে থাকে। অথচ ঐতিহাসিক বিবেচনায় এই দাবী কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আল্লাহ ইহুদী ও খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্যে বলেছেন এই ধর্মীয় বিবাদের উৎস হলো বিদ্বেষ ও গোঁড়ামী । কারণ,তোমরা ঈসা নবীর জন্ম ও তাঁর জীবন সম্পর্কে সরাসরি জানা সত্ত্বেও ঈসাকে নিয়ে ঝগড়া করেছ। আর এখনও ইব্রাহীম ও তাঁর ধর্ম সম্পর্কে কোন জ্ঞান না রেখেই এ নিয়ে বিবাদ করছ এবং তাঁকে নিজেদের ধর্মের অনুসারী বলে দাবী করছ। তোমরা একটা জানা ও স্পষ্ট বিষয়েও যখন একমত হতে পারছ না,তখন কেন এমন বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ যে বিষয়ে তোমাদের কোন জ্ঞানই নেই ?
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত: যুক্তি দিয়েই ধর্মের সত্যতা প্রমাণ করতে হবে। অমুক ব্যক্তি অমুক ধর্মের অনুসারী ছিলেন,অথবা অমুক ধর্ম অন্যান্য ধর্মের চেয়ে প্রাচীন এসব কথা ধর্মের সত্যতা প্রমাণের ক্ষেত্রে যুক্তি হতে পারে না।
দ্বিতীয়ত: তর্ক ও সংলাপ তখনই গুরুত্বপূর্ণ যখন এর উদ্দেশ্য হয় সত্য পথ খোঁজা। তা না হলে তর্কের ফলে দ্বন্দ্ব ও মতভেদই বৃদ্ধি পায়।
সূরা আলে ইমরানের ৬৭ ও ৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ (৬৭) إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِإِبْرَاهِيمَ لَلَّذِينَ اتَّبَعُوهُ وَهَذَا النَّبِيُّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَاللَّهُ وَلِيُّ الْمُؤْمِنِينَ (৬৮)
"ইব্রাহীম ইহুদীও ছিলেন না,খ্রিস্টানও ছিলেন না। তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ ও আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনকারী তথা মুসলমান এবং সে কখনও অংশীবাদী ছিলেন না।" (৩:৬৭)
"যারা ইব্রাহীমের অনুসরণ করেছিল তারা এবং এই নবী ও বিশ্বাসীগণ ইব্রাহীমের ঘনিষ্ঠতম। আল্লাহ বিশ্বাসীদের অভিভাবক।" (৩:৬৮)
পূর্ববর্তী দুই আয়াতে ইব্রাহীম (আ.)'র পরিচয় সম্পর্কে খ্রিস্টান ও ইহুদীদের অজ্ঞতাসুলভ বিতর্কের কথা উল্লেখের পর এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে,হযরত ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন সত্যসন্ধানী এবং তিনি যে কোন ধরনের শির্ক ও মূর্তিপূজা থেকে দূরে ছিলেন। ইব্রাহীম (আ.) একমাত্র আল্লাহর কাছেই আত্মসমর্পন করেছিলেন। এই আয়াতে ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে এটা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে যে,তারাও যেন ধর্মীয় বিদ্বেষে না জড়িয়ে সত্যসন্ধানী হয় এবং শুধু সত্যের কাছেই যেন নত হয়। তাদের মতভেদের উৎস হলো আত্মঅহংকার,আল্লাহর উপাসনা নয়। আত্মপূজা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় শিরক। ইহুদী ও খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্য করে এ দুই আয়াতে আল্লাহ আরো বলেছেন,তোমরা যদি ইব্রাহীমের ঘনিষ্ঠ হতে চাও তাহলে তাঁকে ভালবেসে তার আদর্শও অনুসরণ কর। শুধু মৌখিক দাবীর নামই ধর্ম নয়। যারা বাস্তবে অর্থাৎ কাজেকর্মে ইব্রাহীমের পছন্দীয় পন্থা অনুসরণ করে তারাই ইব্রাহীমের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন। মহানবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা কাজের মাধ্যমে ইব্রাহীমের প্রতি তাদের ভালবাসার প্রমাণ দিয়েছেন। মহানবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা ইব্রাহীম (আ.) কে নিজেদের ধর্মের অনুসারী বলে দাবী না করে বরং নিজেদেরকেই ইব্রাহিমী ধর্মের অনুসারী বলে মনে করেন।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : চিন্তাগত ও ধর্মীয় বন্ধনকে জাতিগত ও আত্মীয়তার বন্ধনের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া উচিত। সমধর্মীরা নিজেদের মধ্যে আত্মীয় না হলেও ভিন্ন চিন্তার ও ভিন্ন বিশ্বাসের আত্মীয়ের চেয়েও বেশী ঘনিষ্ঠ।
দ্বিতীয়ত : ধমীর্য় নেতা ও অনুসারীরা একই জাতীয় হতে হবে এমন কোন ধরা বাধা নিয়ম নেই এবং তার দরকারও নেই। বিশ্বাসের ভিত্তি হলো ধর্ম,ভাষা কিংবা গোত্র নয়। যেমন,সালমান ফারসি আরব না হওয়া সত্ত্বেও রাসুল (সা.) বলেছেন সালমান আমাদেরই মানুষ।
সূরা আলে ইমরানের ৬৯,৭০ ও ৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন-
وَدَّتْ طَائِفَةٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يُضِلُّونَكُمْ وَمَا يُضِلُّونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ (৬৯) يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَكْفُرُونَ بِآَيَاتِ اللَّهِ وَأَنْتُمْ تَشْهَدُونَ (৭০) يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَلْبِسُونَ الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ (৭১)
"আহলে কিতাবদের মধ্যে একদল তোমাদেরকে বিপথগামী করতে চেয়েছিল,অথচ তারা তাদের নিজেদেরকেই বিপথগামী করেছে। কিন্তু তারা তা বোঝে না।" (৩:৬৯)
"হে নবী আপনি তাদেরকে বলুন,হে আহলে কিতাব কেন আল্লাহর নিদর্শন তথা ইসলামের নবীর নবুওতের প্রমাণকে অবিশ্বাস করছ? অথচ তোমরাই সাক্ষ্য দিচ্ছ যে,তাওরাত ও ইঞ্জিলে ইসলামের নবীর নিদর্শন রয়েছে।" (৩:৭০)
"হে আহলে কিতাব,সত্য জানা সত্ত্বেও কেন সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশাচ্ছো এবং সত্য গোপন করছ? " (৩:৭১)
এই কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ ধর্মের শত্রুদের গোপন উদ্দেশ্য উন্মোচন করে সত্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া মিথ্যার আবরণ বা পর্দা সরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ বলছেন আল্লাহর উপাসক ও আহলে কিতাব হবার দাবিদার একদল লোক নিজেদের মত মুসলমানদেরকেও বিভ্রান্ত করার ইচ্ছা রাখে। তাওরাত ও ইঞ্জিলে ইসলামের নবীর নিদর্শন ও তাঁর আসার ব্যাপারে বক্তব্য রয়েছে। তাওরাত ও ইঞ্জিল থেকে ঐসব আহলে কিতাবরা এটাও জানতো যে,ইসলামের নবী আসার পর তাঁর ওপর ঈমান আনা ও তাঁর আনুগত্য করা জরুরী। কিন্তু বিদ্বেষ ও গোঁড়ামীর কারণে তারা এসব সত্যকে গোপন করেছে অথবা এমনভাবে এ সম্পর্কে কথা বলেছে যাতে অন্যরাও তাদের মত বিভ্রান্ত হয়। তাই এসব আয়াতে মুসলমানদের সাবধান করে দিয়ে বলা হচ্ছে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে তারা যেন প্রভাবিত না হয় এবং মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে তাদের অশুভ লক্ষ্য সম্পর্কে মুসলমানরা সচেতন থাকে।
এই কয়েকটি আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হলো,
প্রথমত : সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে হলে শত্রুদেরকে চিনতে হবে এবং তাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে হবে। মুসলিম যুবক ও তরুণরা যেন অন্য ধর্মের বা মতবাদের মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত না হয়,সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
দ্বিতীয়ত : যারা অন্যদের বিভ্রান্ত করছে,তারা প্রথমে নিজেদেরকেই বিভ্রান্ত করছে। কারণ,ধোঁকা,প্রতারণা ও বিদ্বেষ বা হিংসার পরিণতি বিভ্রান্ত ছাড়া অন্য কিছু নয়।
তৃতীয়ত : মুমিনদেরকে সবসময় মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করতে হবে। ফলে শত্রুরা তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।